শিল্প ও সাহিত্য

ক্রমাগত হত্যার সেরেনাদে: মহাকাব্যিক বেদনার আখ্যান

শুবার্টের সেরেনাদ আমার খুব প্রিয়! কিন্তু এখন কোনো সন্ধ্যাবেলা শুনতে গেলেই আমার অদিতি ফাল্গুনীর লেখা ‘ক্রমাগত হত্যার সেরেনাদে’ উপন্যাসটির কথা মনে পড়ে, যেন পিয়ানোর রিডে হত্যার সেরেনাদ বাজছে আমাকে ঘিরে। বইটি পড়তে গেলে চোখ জলে ভরে ওঠে; যেন খুব চেনা দৃশ্য। আমার চোখের সামনেই ঘটেছে বলা যায়। যেহেতু এটা একটা উপন্যাস তাই মূল চরিত্রগুলোর নামধাম পাল্টে দিয়েছেন লেখক। তবু প্রতিটি চরিত্র স্বনামে চোখের সামনে চলে আসে।

সক্রেটিসের হত্যাকাণ্ড দিয়ে উপন্যাসের শুরু। সক্রেটিসকে হেমলক খাইয়ে কেন হত্যা করা হয়েছিল বলাবাহুল্য। না, এই উপন্যাসের মূল পটভূমি সক্রেটিস নন। এই উপন্যাস আমাদের সময়ের বাংলাদেশ। এই শুরুটা আসলে ভূমিকা বলা যায়। এর পরের পর্বকেই শুরু হিসেবে নিই আমি, পর্বের নাম ‘অলৌকিক অ্যাম্বুলেন্স’। এই পর্বে অধ্যাপক আকবর আসাদের নামের আড়ালে পেয়ে যাই হুমায়ূন আজাদকে।  

উপন্যাসে গত কুড়ি বছরে মৌলবাদ ও ফ্যাসিবাদের কাঁধে পা রেখে জঙ্গিবাদের উত্থান, ক্রমাগত লেখক, মুক্তচিন্তক, ব্লগারদের হত্যা প্রচেষ্টা আর হত্যার কাহিনি, পেয়ে যাই শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের সেই সোনালি আর উত্তাল দিন- এ এক প্রামাণ্য-আখ্যান। কিন্তু আমার কাছে এটা তারও বেশি কিছু; একটা জ্বলন্ত সময়ের সত্য ইতিহাসের ভূমিকা। 

মহাভারতে যেমন প্রসঙ্গক্রমে মূল পটের বাইরে নানা কাহিনি, সূত্র আর সম্পর্কের উল্লেখ পাই, এই উপন্যাসেও প্রসঙ্গক্রমে এসেছে ১৪০০ বছর আগের ইসলামি খেলাফত, ভারতবর্ষ, মধ্যযুগে গির্জা ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক-সহ নানা বিষয় ও ঘটনা। অপরিহার্যভাবে এসেছে দর্শন, কবিতা, গান ইত্যাদি।

২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সাল। এই দিন আমি ভুলতে পারি না। বইমেলা থেকে বের হয়ে বাসে বাসায় ফিরছিলাম। বাসায় পৌঁছার আগে বাসে বসেই জেনে গেলাম ঘটনা। এখনও ভাবি এমন অসহায় কি নিজেকে আমার আর কখনো মনে হয়েছিলো? ওই দিন সন্ধ্যার পরে অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সেদিনের আগে অনলাইনে আলাপ থাকলেও, সেদিনই বইমেলায় প্রথম দেখা হয়েছিলো। না, দীর্ঘ কোনো আলাপ নয়, কেমন আছেন, ভালো আছি ইত্যাদি।

কেবল বইমেলা ছাড়া আর কোনো মেলাই আমার ভালো লাগে না। প্রতিবছর আমি বইমেলায় যাই। রাস্তার বামপাশের ফুটপাথ ধরে হাঁটতে থাকি। টিএসসির সামনে আসতেই আমার গায়ে অভিজিৎ রায়ের রক্ত লেগে যায়। কাঁচা রক্তের রং ও গন্ধ নিয়ে আমি বইমেলায় ঢুকি। এই রং আর কেউ দেখে না, এই গন্ধ আর কেউ পায় না। বিকেল থেকে রাত্রি পর্যন্ত হাঁটতে হাঁটতে গায়ের রক্ত গায়েই শুকিয়ে যায়। মেলা শেষ হলে বের হই। রাস্তার বামপাশের ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে ঘরের দিকে যাই। পরমাণু শক্তি কমিশনের সামনে আসতেই আমার গায়ে হুমায়ুন আজাদের রক্ত লেগে যায়। এই রক্তের ভার আমি একাই বহন করি নিজের রক্তের ভিতর। 

গুলশানের হলি আর্টিজানের হত্যাকাণ্ডের কথাও আমি ভুলতে পারি না। ২০১৬ সালের ১ জুলাই ২২ জনকে হত্যা করা হয়েছিলো। তার মধ্যে আমার বন্ধু ইশরাত ছিলো। মনে আছে এর আগের দিন রাতেও তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছিলো, সেই বছর প্রকাশিত আমার ‘রাজহাস যেভাবে মাছ হয়’ গল্পের বইটা নিয়ে আমরা কথা বলেছিলাম।

বইয়ের প্রথম ফ্ল্যাপে লেখা অধ্যাপক অজয় রায়ের মন্তব্য থেকে জানতে পারি লেখক উপন্যাসে ক্রমাগত নিহত চরিত্রগুলির নামের আড়ালে প্রকৃত প্রস্তাবে যাদের কথা লিখেছেন দেশে গত দুই দশকে নিহত প্রায় সব মুক্তচিন্তক, মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আত্মীয় পরিবার পরিজনের সঙ্গে কথা বলে নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে সেইসব তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে রচনা করেছেন এই উপন্যাস। এ কথা জেনে ভাবনা জাগে মনে এত মনোবল, এত শক্তি, এত সাহস লেখক কোথায় পেলেন? লেখক এ উপন্যাসে প্রিন্ট, ইলেট্রনিক ও সোশ্যাল মিডিয়ায় পাওয়া খবর-প্রতিবেদনসহ নানা নথিপত্র, বই ইত্যাদির সমন্বয়ে ফিল্টার করেছেন কাহিনির সত্যতা। বইয়ের শেষ পাতায় কিছু তথ্যসূত্রের উল্লেখও আছে।  

বইটি আমি কয়েকবার পড়েছি। প্রথম ২০১৫ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের ঈদ সংখ্যায় উপন্যাসিকা আকারে। তারপরে যখন ২০২০ সালে তিনশো পৃষ্ঠার উপন্যাস হিশেবে প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত উপন্যাসের মধ্যে ঢুকে পড়ে ২০১৫ সালের পরে সংঘটিত হলি আর্টিজানে হত্যাকাণ্ডসহ আরো কতিপয় হত্যার আখ্যান। এখন আবারও পড়তে পড়তে লিখছি এই লেখা। আবারও ক্ষণে ক্ষণে চোখ ভিজে যাচ্ছে, রোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। ভাবছি কেমন করে লেখক লিখতে পারলেন এত দীর্ঘ বেদনার আখ্যান?

এই উপন্যাস তীব্র আর বোল্ড। এই উপন্যাস অসহনীয়। এই উপন্যাস রোমহর্ষক। এই উপন্যাস মূলত মহাকাব্যিক বেদনার অনন্য গাথা।