মতামত

ফুটবল ভালোবাসার অরণ্যে

নিঝুম রাত। আকাশে চাঁদ ছিল কী? নাকি অন্ধকার আরও জমাট বাঁধিয়েছিল উঠোনের কোণের হলদে বাতি! সেই আলো-আঁধারে, এক চিলতে উঠোনে, মাঝরাত্তিরে উৎসবের আবহ। ২০ ইঞ্চির ছোট্ট এক সাদা-কালো টেলিভিশন ঘিরে- বিশ্বকাপ ফুটবলের ম্যাচ যে!

ছোট্ট এক বালককে ঘুম থেকে টেনে তুলে নিয়ে আসা হলো উঠোনে। আশপাশের বাড়ির খেলাপাগল বেশ কয়েকজনের সঙ্গে বসে টিভিতে চোখ রাখে সে। ঘুম ঘুম ফোলা ফোলা চোখে। খুব শৈশবের ওই ম্যাচের স্মৃতি বলতে কিচ্ছুটি নেই আর। কেবল মনে আছে, একটি দল পেনাল্টি পেলে বালকটি বলেছিল, ‘ওরা তো গোল করতে পারবে না।’ বড় হয়ে পরে সে জানতে পারে, সেটি ছিল ব্রাজিল-ফ্রান্সের সেই বিখ্যাত ম্যাচ। পেনাল্টি নিয়ে তার অমোঘ ভবিষ্যদ্বাণী ছিল জিকোকে ঘিরে। ঝিঁ ঝিঁ ডাকা সেই খোলা উঠোনের রাতটির স্থান এই ঢাকা শহরেরই কোথাও। সময়টা ১৯৮৬। বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে আমার প্রথম স্মৃতি সেটিই। আর বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে আমার সর্বশেষ স্মৃতি, মস্কোর লুজনিকি স্টেডিয়ামের খোলা প্রেসবক্সে বক্সে ২০১৮ ফাইনালে ফ্রান্সের রাজত্বের চাক্ষুষ সাক্ষী হওয়া।

১৯৮৬ থেকে ২০১৮। সময়! জিপসি সময়ের হাত ধরে ৩২ বছর কেমন করেই না কেটে গেল!

এরপর আরও চার বছর পেরিয়েছে। ২০২২ বিশ্বকাপের রোমাঞ্চ একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীজুড়ে। ফুটবলের মাতাল করা সৌরভে, আকুল করা সৌন্দর্যে ডুবে থাকার প্রস্তুতি নিচ্ছেন সবাই। চার বছর পরপর আসে অলৌকিক-অপার্থিব এ সময়। সে সময়ের প্রতিটি ক্ষণ উপভোগের মন্ত্রে জপার প্রস্তুতি সবার। ফুটবলার। কোচ। কর্মকর্তা। আয়োজক। দর্শক। সমর্থক। সবার। 

বিশ্বকাপ ফুটবলে পৃথিবীর সব দেশ খেলে না। খেলছে মাত্র ৩২টি। এর মধ্যেও সবগুলো দেশের লক্ষ্য শিরোপা জয় নয়। সংখ্যাটা বাড়িয়ে বললেও ১২ হবে না। কিন্তু টুর্নামেন্টের আবহে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর প্রশ্ন থাকে সেটিই। বিশ্বকাপ জিতবে কোন দল? সোনালি ট্রফি জিতে কোন দেশ জমাবে রূপালি স্মৃতি?

এবারও কি প্রথাগত পরাশক্তিদের কেউ হাসবে শেষ হাসি? নাকি নতুনের জয়ধ্বনি উঠবে কাতারের মরুতে? ফ্রান্স বর্তমান চ্যাম্পিয়ন। চার বছর আগের কোচ দিদিয়ের দেশম আছেন এখনও। মূল দলটির কাঠামোও প্রায় অপরিবর্তিত। বরং রাশিয়ায় আলোর উল্কার ঝলকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে দেয়া কিলিয়ান এমবাপ্পে এখন আরও পরিণত। সেবারের অনুপস্থিত করিম বেনজেমা এবার ব্যালন ডি’অর নিয়ে উপস্থিত। আর ফ্রান্সের স্কোয়াডের গভীরতাও তো অন্য যে কোনো দলের চেয়ে বেশি। 

হ্যাঁ, দলে কিছু অন্তর্কোন্দলের ফিসফাস আছে। ফর্মও যুতসই নয়। সাম্প্রতিক আসরগুলোতে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের অভিশপ্ত বিদায়ে ইতিহাসও উঁকিঝুঁকি দেয়। তবু এই ফ্রান্সকে যদি শিরোপা রেসে না রাখেন, সেটা বোকামি।

আর্জেন্টিনার বেলায়ও একই উপসংহার। গত বছর কোপা আমেরিকার ফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে এবং আরও বেশি করে এ বছর ‘ফিনালিস্সিমো’তে ইতালির বিপক্ষে পারফরম্যান্স তাদের তুলে এনেছে ফেভারিটের কাতারে। সঙ্গে যোগ করুন, লিওনেল মেসির ‘ক্ষুধা’। সর্বকালের সেরা হওয়া থেকে সম্ভবত এই সাতটা ম্যাচের, এই একটা বিশ্বকাপের দূরত্ব তার। এবার কোচ যখন লিওনেল স্কালোনির মতো একজন, সতীর্থ সেনাদলে যখন মার্তিনেজ-রোমেরো-দি পলরা, তখন মেসির চিরআক্ষেপ ঘোঁচার প্রত্যাশায় বাড়াবাড়ি আছে কী?

ব্রাজিলের জন্য ২০ বছরের অপেক্ষাটা বাড়াবাড়িই। সেই ২০০২ সালে বিশ্বকাপ জিতেছিল; এরপর ব্যর্থতার বিষণ্ন মিছিল। সর্বশেষ দুই আসর শেষ হয়েছে নেইমারের কান্নায়। এবার কি ভিন্ন কিছু হবে? তিতের ব্রাজিল বাছাইপর্বে বরাবরের মতো দুর্দান্ত। ইউরোপিয়ান দলের মতো কাঠামোবদ্ধ। নেইমারের নেতৃত্বে প্রতিভারও ছড়াছড়ি। কিন্তু এ দলের মানসিক দৃঢ়তা কতোটা, প্রয়োজনের সময় পারফর্ম করার সামর্থ্য কেমন- সে প্রশ্ন উবে যায় না। ২০২৮ বিশ্বকাপের স্মৃতিতে; গত বছরের কোপার ফাইনাল মাথায় রেখে।

আর ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর পর্তুগাল? স্কোয়াডের গভীরতায় ফ্রান্সের সঙ্গে পাল্লা দেবার মতো সম্ভবত এই একটিই দেশ। কিন্তু বিশ্বকাপ যত এগিয়ে আসছে, তাদের সম্ভাবনার রঙও যেন ফিকে হচ্ছে ক্রমশ। প্রথমত, রোনালদোর ক্লাব ফর্মের কারণে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে যাচ্ছেতাই মৌসুম কাটছে। আর পর্তুগালের ফর্মও খুব ভালো না। কোচ ফের্নান্দো সান্তোস দলের সেরাটা বের করতে পারছেন না বলেই সাধারণে মত। মেসির মতো রোনালদোর ক্যারিয়ারেরও একমাত্র শূন্যতা এই বিশ্বকাপ। সেটিকে পূর্ণতার আলোয় ভরিয়ে দিতে পারবেন জাদুকরী ৭ ম্যাচে?

ট্রফি জয়ের হিসাবের বাইরে জার্মানিকে রাখবেন কীভাবে? বড় আসরের বড় দল তারা। এবারও যে মরণকামড় দেবে, তাতে সন্দেহ সামান্য। স্পেন? লুইস এনরিকের দলটি হয়তো অনভিজ্ঞ। তবে স্প্যানিশ ফুটবলের সোনালি দিনের সৌন্দর্য আছে তাদের খেলায়। আছে সে দিন ফেরানোর প্রতিজ্ঞাও। স্পেনের বিশ^কাপ জয় তো সেদিনের। ইংল্যান্ডের ‘সবেধন নীলমণি’ সেই কবেকার! ১৯৬৬ সালের। প্রতিবার বিশ^কাপ এলে বেশ একটা সাজ সাজ বর পড়ে যায় ইংলিশ ক্যাম্পে। যেন ট্রফি জয় সময়ের ব্যাপার। শেষে লবডঙ্কা। এবার কি ব্যতিক্রম কিছু হবে?

ফুটবল সৌন্দর্যের আরেক ফেরিওয়ালা দেশ নেদারল্যান্ডস। লুই ফন হালের কোচিংয়ে দারুণ খেলছে সাম্প্রতিক সময়ে। কিন্তু বিশ্বকাপ জয়ের, প্রথমবারের মতো ওই ট্রফি স্পর্শের সামর্থ্য কি রয়েছে ডাচদের? কিংবা বেলজিয়ামের সোনালি প্রজন্মের? অথবা ক্রোয়েশিয়ার ফুরিয়ে আসা সোনালি প্রজন্মের? নাকি সবাইকে চমকে দেবে ডেনমার্কের মতো কোনো দল? সেনেগালের মতো দেশ প্রথমবারের মতো আফ্রিকায় নিয়ে যাবে বিশ্বকাপ? অপেক্ষায় আছেন সবাই। আছেন প্রতীক্ষায়।

তিন যুগ আগে এক বালক যেমন ঘুমুতে গিয়েছিল, মাঝ রাতে ঘুম ভাঙার অপেক্ষাকে সঙ্গী করে। সে রাতে তার মনে ফুটবল ভালোবাসার বীজ বুনে দিয়েছিল এই বিশ্বকাপ। এর আগেও কত জনের! এর পরও কত জনের! এ বিশ্বকাপেও ব্যতিক্রম হবে না নিশ্চয়ই। ফুটবল ভালোবাসার অরণ্যটা আরও নিবিড় হবে নিঃসন্দেহে। তা বিশ্বকাপ যে দলই জিতুক না কেন!