মতামত

কৃষকের কোমরে দড়ি: অল্প ঋণে বড় কলঙ্ক

সবিনয়ে জানতে চাই- দেশে ঋণ খেলাপির প্রকৃত সংখ্যা কত? প্রতি বছর কত টাকা বিদেশে পাচার হয়? আলোচিত বেগমপাড়ায় যারা বাড়ি নির্মাণ করেছেন তাদের সবার অর্থের উৎস কী বৈধ বা যারা নামে বেনামে ঋণ নিয়ে ব্যাংকগুলোকে দেউলিয়া হওয়ার পথে ঠেলে দিয়েছেন তাদের কজনের বিচার হয়েছে? সুইচ ব্যংকে যারা টাকার পাহাড় জমিয়েছেন এর উৎস কোথায়? 

এসব প্রশ্নের সঠিক জবাব পাওয়া যাবে না। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণ খেলাপিদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৬০ হাজার ৫২৮ জনে। ২০২০ সালের একই সময়ে ছিল ৩ লাখ ৩৪ হাজার ৯৮২ জন। ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। চলতি বছরের জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। ব্যাংক খাতে এত পরিমাণ খেলাপি ঋণ এবারই প্রথম। খেলাপি ঋণ-সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়।

প্রশ্ন হলো কতোজন ঋণ খেলাপির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে? অর্থ আদায়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে? তেমনি প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় আর্থিক খাতের ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি আর কেলেঙ্কারির খবর প্রকাশ হচ্ছে। তাদের কতজন আইনের আওতায় আসছে বা অর্থ পাচারকারী, বেগমপাড়ায় বিণিয়োগকারী, রাষ্ট্রের অর্থ নিয়ে পালিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কয়টি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে? 

অথচ মাত্র ৩০ হাজার টাকা ঋণের জন্য ১২ জন কৃষককে গ্রেফতার করা হয়েছে! আইন তো সবার জন্য সমান। যদি ৩০ হাজার টাকার জন্য একজন কৃষককে গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করতে হয়, তাহলে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটকারীরা কেন গ্রেফতার হবে না। তাদের বিরুদ্ধে কেন মামলা করা হবে না। তারা কি আইনের ঊর্ধে? না কি কৃষক মানেই সাধারণ খেটে খাওয়া মাঠের মানুষ। তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, টেলিফোনের কোনো শক্তি নেই। এক কথায় যদি বলি অসহায়। তাই বলে রাতের অন্ধকারে মামলা ঠুকে দেয়া হলো। আদালত পরোয়ানা জারি করল। তৎপর হয়ে গেল পুলিশ। কর্ম দেখাতে তাদের দ্রুত গ্রেফতার করা হলো। শেষ পর্যন্ত একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ঋণের অর্থ পরিশোধের আশ্বাসে ৩৭ জন কৃষক জামিনে মুক্তি পান। 

পাবনায় এত বড় একটি ঘটনা ঘটল অথচ কারো নজরে আসেনি। এটা হতে পারে না। জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, জেলা বা উপজেলা পরিষদ, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, শিল্প মালিক, বণিক সমিতি থেকে শুরু করে কেউ ঘটনাটি জানবে না এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। জানলেও হয়ত বিষয়টিকে তারা আমলে নেননি। কৃষক বলে কথা! 

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট যদি চিন্তা করি তাহলে ভাবা যায় সামান্য কটা টাকার জন্য এতজন কৃষককে গ্রেফতার করে জেলে দেয়া হতে পারে। এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই এখনও দেশের মূল অর্থনীতির চালিকাশক্তি কৃষি ও কৃষক। ২০২৩ সালে খাদ্য সংকট মোকাবেলা করতে হলে মূল অবদান এই কৃষকদেরই দিতে হবে। তাদের উপরই ভরসা রাখতে হবে। অর্থাৎ সামনের দিনগুলোতেও দেশের খাদ্য চাহিদা মেটাতে কৃষি বিপ্লবের মূল হাতিয়ার কিন্তু কৃষকরাই। অথচ গ্রামের এই সহজ সরল মানুষগুলোকে সামান্য কটা টাকার জন্য জেলে পর্যন্ত যেতে হয়েছে। তাই সময় বলছে, অভাবি কৃষকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির বলয় বৃদ্ধির বিকল্প নেই।  কারো মধ্যে প্রশ্ন উঠতে পারে কৃষক কী তাহলে আইনের ঊর্ধ্বে? না। মোটেও তা নয়। নিত্যপণ্যের দাম কয়েক বছরে হু হু করে বেড়েছে। কৃষি উপকরণও হাতের নাগালের বাইরে। করোনার ধাক্কায় অনেকে কাজ হারিয়েছেন। হয়ত মহা অভাব মোকাবেলা করতে গিয়ে কৃষকদের ঋণ নেয়া ছাড়া উপায় ছিল না। ঋণ নেয়ার পর জীবন ও সংসারের চাকা সচল রাখতে গিয়ে কিস্তি মেটানো সম্ভব হয়নি। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এতে সুদ জমে জমে টাকা বেড়েছে। 

এই সমস্যাটি সমাধানের অনেক উপায় ছিল। মামলা দিয়ে, তাদের জেলে নিয়ে অর্থ আদায় করার মতো ঘটনা নিশ্চই এটি নয়। বিকল্প সমাধানের পথে ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান যায়নি বা চিন্তা করেনি। জেলা বা উপজেলা প্রশাসন এমনকি উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উদ্যোগ নিলেও সমস্যাটি সমাধান সম্ভব ছিল। এতে কোমল হাতে সোনার ধান ফলানো কৃষকদের হাতকড়া পরা অবস্থায় হয়ত দেখতে হতো না। এটি দেশের কৃষকদের ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে। তেমনি লজ্জারও বটে। বিএনপির শাসনামলে সারের দাবিতে আন্দোলন করা কৃষকদের উপর গুলি চালানো ও হত্যার ঘটনা কিন্তু মানুষ আজো ভুলে যায়নি।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ঋণ পরিশোধ না করায় ৩৭ জন কৃষকের কাছে সুদাসলে প্রায় ১৩ লাখ টাকা পাওনা ছিল। ঋণ আদায়ে প্রতিষ্ঠানটি ২০২১ সালে ৩৭ জন কৃষকের নামে মামলা করে। পাবনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ১৫ নভেম্বর কৃষকের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করলে পুলিশ ১২ জনকে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠায়। বাকি ২৫ জন সহ সবাই আদালতে হাজির হয়ে গত রোববার জামিন আবেদন করলে আদালত তা মঞ্জুর করেন। 

গ্রেফতারকৃতরা সবাই ঈশ্বরদী উপজেলার ছলিমপুর ইউনিয়নের ভারইমারি গ্রামের বাসিন্দা। তারা বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক নামের একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ২০১৬ সালে ৩০-৪০ হাজার টাকা করে ঋণ নিয়েছিলেন। প্রত্যেকে ভারইমারি উত্তরপাড়া সবজি চাষি সমবায় সমিতির সদস্য।  পাবনার জেলা প্রশাসক বিশ্বাস রাসেল হোসেনের উদ্ধৃতি দিয়ে খবরে বলা হয়েছে, ‘বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসায় এরই মধ্যে বিভিন্ন নির্দেশনা তিনি পেয়েছেন। কৃষকদের বিরুদ্ধে কেন মামলা হয়েছে খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তদন্তের কাজ শুরুর কথা জানান তিনি। বলেন, কোনো কৃষক যাতে হয়রানির শিকার না হন, সেই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।’

আশার কথা যে ঘটনাটি প্রধানমন্ত্রীর নজরে এসেছে। বিশ্বাস আছে কৃষকরা ন্যায় বিচার পাবেন। তাদের সকল সমস্যার সমাধান হবে। তেমনি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের যেসব ব্যক্তির নির্দেশে কৃষকদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তারাও রেহাই পাবেন না। তবে কি জেলা প্রশাসক দায় এড়োতে পারেন?  তিনিও চাইলে বিষয়টি সমাধানে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারতেন। তিনি বিষয়টি অবহেলা করেছেন তাও স্পষ্ট। 

গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে বছরে গড়ে পাচার হচ্ছে ৬৪ হাজার কোটি টাকা। প্রতি বছর দেশের এসব টাকা পাচার হয়ে চলে যাচ্ছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, থাইল্যান্ডসহ ১০টি দেশে। আমদানি-রফতানিসহ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কারসাজি আর হুন্ডির আড়ালে অর্থপাচার করছে পাচারকারী সিন্ডিকেট। বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ পাচার মনিটরিং সংস্থা- বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বিআইএফইউর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের এসব তথ্য উঠে আসে।

আর দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবছর বাংলাদেশে থেকে ১০০০ থেকে ১৫০০ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়। অন্যদিকে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের নাগরিকদের জমা করা টাকার পরিমাণ এক বছরের ব্যবধানে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

সেই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২১ সালে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় আট হাজার দু'শ ৭৫ কোটি টাকা। এর আগের বছর, অর্থাৎ ২০২০ সালে, এই অর্থের পরিমাণ ছিল পাঁচ হাজার তিনশ ৪৭ কোটি টাকা। সুইস ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনে কয়েক বছরের যে পরিসংখ্যান দেয়া হয়েছে তাতে এই বৃদ্ধি এক বছরের ব্যবধানে সর্বোচ্চ। এই অঙ্কগুলো বিবেচনা করলে কৃষকদের ঋণের পরিমাণ অতি নগন্য। এখানে পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই- এ প্রসঙ্গে এক শুনানিতে আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বলেছেন, ‘দুই দিন আগে পত্রিকায় দেখলাম, ২৫ হাজার টাকার জন্য সাধারণ কৃষকের কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অথচ যারা বড় বড় ঋণখেলাপি, যাদের কাছে লক্ষ-কোটি টাকা পাওনা, তাদের ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায় না।’  

করোনা এবং ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক আর্থিক নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। পাচার রোধ, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা, ঋণ খেলাপিদের থেকে অর্থ আদায়, সুইচ ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা ফেরত আনলেই তো বাংলাদেশ ঘুড়ে দাঁড়াতে পারে। তেমনি রাঘব বোয়ালদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হলে ৩০ হাজার টাকার ঋণ খেলাপিরা এমনিতেই ভালো হয়ে যাবে। তারাও দ্রুত ঋণ পরিশোধ করবে। বা সব ঠিকঠাক থাকলে কৃষকদের আর অভাবের মুখে ঋণ নিয়ে খেলাপির অভিযোগে জেলে যেতে হবে না। কারো করুণার পাত্র হয়ে তাদের বেঁচে থাকতেও হবে না। যারা দিতে জানে তারা প্রতিদানের আশা করে না। 

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক