শিল্প ও সাহিত্য

নোবেলজয়ী আনি এরনোর উপন্যাস: ৮ম পর্ব

শিক্ষকই ভুল ছিলো, আমি তা বুঝতে পেরেছিলাম। যে বেমানান তাকে বাইরে থাকতে হয়। অন্যদিকে, যখন সে বললো, ‘আচ্ছা, তো, তোমার বাবা মা তোমাকে দরজার খটখট না করেই ঢুকতে দেয়।’ প্রত্যেকটা শব্দে জোড় দিচ্ছিলো, আমার মনে হতে লাগলো সে এমন লোকদের নিয়ে কথা বলছে যাদেরকে সে মোটেও চেনে না, যখন সে কথা বলছিলো, একটা অস্পষ্ট ছবি যেন আমার পেছনে কোনভাবে ভেসে বেড়াচ্ছিলো। আমার বাবা মার উচিত ছিলো সেই ছবির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেয়া, তারপর হয়তো জানতে পারতাম আমরা কে কোথায় দাঁড়িয়ে আছি। সমস্যাটা হলো তারা উনার কথার মতো মোটেও ছিলো না... মাস্টারনি নেহাত কী নিয়ে কথা বলছে তা জানতোই না। 

কেউ এসব নিয়ে কথা বলে না, অবমাননা, বিব্রত করা, নোংরা মন্তব্য ছুঁড়ে দেয়া বিশেষত ছোট্ট শিশুর উপর সেটা বেদনাকর। একজন ছাত্র... ওরা আমার উপর আমার বাবা মার উপর হেসে উঠতো। অবমাননাকর। এটা কেবল প্রথম শ্রেণীর শিক্ষিকা করতো না, হারামী মহিলাটা করতো, ওই যে লম্বা সাদা হাত যেটাকে দেখে মনে হতো যখন সে চক ধরে আছে না তখনও হাতে তার চক, সব সময় তার সোনার কলমটা নিয়ে খেলতো। আর অন্য মেয়েরা... ‘‘তোমার বাবা কী করে? দোকানদার, বেশ, তুমি নিশ্চয়ই অনেক মিষ্টি খেতে পাও?’’  উষ্ণ আর ভদ্র সূচনা, আমি অতোটা প্রত্যাশা করিনি, আমি খুশি আর গর্বিত। আর তারপরই আকস্মাৎ একগাদা শব্দ ছুঁড়ে মারে যা আমার কলিজায় ঘুরপাক খেতে থাকে, যা আমাকে শস্তা অনুভূতি দেয়। ‘আচ্ছা একটা কফি শপ? তুমি কি মদ পান করার সুযোগও পাও তাহলে? এহ, কি জঘন্য!’ আমারই দোষ, আমার চুপ থাকা উচিত ছিলো, আমি বুঝতে পারিনি। ‘রু ক্লোপার্টে? সেইটা কোথায়? গ্রামের দিকে? ও তাহলে এইটা স্রেফ একটা পিচ্চি দোকান?’ ক্লাসের ভেতরে, আমি মেয়েটার দিকে তাকাই যে আমাকে অপমান করছিলো, জেন হাসছিলো, তখন তার বিরাট দাঁত আর হোতকা জিহ্বা বেরিয়ে আসে। আমার করার কিছুই ছিলো না।

কথাগুলো বলে ফেলেছে সে। জেনের বাবা ছিলো শহরের মাঝখানের একজন চশমার দোকানদার, তার মা কাজ করতো না, ওদের একটা বড় কালো গাড়ি ছিলো। আমি পাত্তা দিতে চাই না, এটা তো আমার দোষ নয়। ও প্রথম সারিতে বসে, ও অভারঅল পড়ে না, আমি ওর জামার ফোলানো হাতা দুটো দেখতে পাই, যেন ওর বাহুর উপরে দুটো বড় ফুল। তার দুই বেনি একদম চকচকে নিতম্ব বরাবর ঝুলে আছে। সে ওর হাত ওঠায়, কথা বলে, শিক্ষকদের হাসায়। সে আমাকে কি বললো সেটা নিয়ে দ্বিতীয়বারও চিন্তা করে না। তার কাজকর্ম আলাদা, ‘মাদমোয়াজেল, আরেকদিন আমার বাবা...’ মাস্টারনিও তার কথা শুনতে আগ্রহী  হয়। পুরো ক্লাসই জানে জেনের বাবা-মায়ের গল্প। আমি কেবল খুব ভালো করে বুঝতে পারি, আমার বাবা মা আলাদ ধাঁচের, তাদের সম্পর্কে চুপ থাকাই ভালো। ‘বাজে রুচি’, মাস্টারনি বলতে থাকে, ‘কাল সন্ধ্যায়, বুড়ো লেদ্যা এতো মাতাল ছিলো যে পথের পাশেই পড়ে থাকে, সেখানেই বোতলটা জড়িয়ে ঘুমাতে থাকে’। মাস্টারনি একটা উত্তেজনা তৈরি করে, কিন্তু আমি আরও বেশি বলতে পারতাম, ‘আমার মা সব বমি পরিস্কার করেছে, সব কিছুর উপর থেকে।’ সে ইতস্ততভাবে বিষয় পাল্টে ফেলে, সে কখনোই আমার ব্যাপারে আগ্রহী নয়। বাজে রুচি। আমার জরায়ুতে একটা টিউব, কিছুই তেমন পাল্টায়নি। পুরনো লেস্যু জেগে ওঠে।

প্রাইভেট স্কুলের আত্মবিশ্বাসী মেয়েদের তুলনায় আমার নিজেকে জবরজং আর বেমানান মনে হয়, ওরা জানে ঠিক কী করতে হবে। আমি মায়ের বানানো মহামান্য ওলের জাম্পার যেটা এপ্রিলেও পরে থাকতে হয় সেটা খুলে ফেলি। আমি আশা করি আমি হয়তো আমার জবরজং আর স্থুলতায় ছায়া আনতে পারবো, কিন্তু আমি কখনোই জেনের মতো হতে পারবো না। তেমন হওয়ার জন্য যা দরকার তা আমার নেই। তার মধ্যে যে গরিমার আভা, কিছুটা তা অধরা, দোকান ভর্তি উজ্জ্বল চশমাগুলো, কচ্ছপের খোলের ফ্রেম, গোলাপি ফ্রেম সেই সব আমাদের নেই। একটা বসার ঘর, একটা কাজের লোক। কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি সেখানে একটা সংযোগ আছে। আমি ভাবতাম যে আত্মবিশ্বাস, যে তড়িত বাক চাতুর্য ওর ছিলো সেটা প্রাকৃতিক, তার সঙ্গে চশমার দোকানের কোন সম্পর্ক নেই। ঢোকার মুখেই বড় হলরুম ভর্তি গাছপালা। ওটা ছিলো সবচেয়ে খারাপ, আমি ভাবতাম ওটা চিরকালের জন্য সাজানো গোছানো থাকতো। ডেনিস লেস্যু বেচারা বিবর্ণ গুরুত্বহীন, লেস্যুর স্টোরের রাণী সে, কিন্তু এখানে কিচ্ছুই না। আমি বরং জেন বা অন্য যে কেউ হতে চাইতাম যারা আমাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্ল করে প্রমাণ করতো তারা কতো বড়। রোসেলিন, স্থানীয় বড় খামারের চাষীর মেয়ে, সে আমাকে ছুটির সময় ব্যাগভর্তি পেস্ট্রি বহন করতে দিতো অথচ আমাকে পড়ে থাকা একটা দানাও কখনো দেয়নি। সে ওগুলো একটার পর একটা খেয়ে যেতো, চিনির সিরা তার কোট বেয়ে পড়তো আর ক্রিমগুলো দুপাশ দিয়ে চুইয়ে পড়তো। আর শেষ কামড় পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করতাম আমাকে একটু দেবে কি না।

ঘণ্টা বেজে যেতো, সে নিজেকে ঝাঁকি দিতো আর মুখ মুছে ফেলতো! কি হারামী! জাহান্নামে যাক তোর কেক পেস্ট্রি! ওর ছিলো লম্বা সোনালী চুল আর কালো চকচকে জুতো। ওর বাবা ছিলো ওদের এলাকার মেয়র। আমি কেবল তার ব্যাগ বহন করার উপযুক্ত। যদি কেবল তা না হতাম তবে সেটাই ছিলো সময়, ডেনিস লেস্যু, সেটাই শুরু। বাকী সবাই বাঁচে তাদের নিজের জন্য, তারা শোনে, লেখে, চুপচাপ টয়লেটে যায় নিজের জন্য আর আমার সময় কাটে ওদের দেখে, শুনে, লিখে আর টয়লেটে গিয়ে। যখন আমি স্কুলে যাই, আমি ‘কেউ না’ হয়ে উঠি, যখন আমি চোখ বন্ধ করি চোখের সামনে সর্ষে ফুল দেখি। আমি আমার নিজের পৃথিবীকে ছেড়ে এসেছি স্কুলের গেটেই, আমি অন্য কারো সঙ্গে এখানে মানাতে পারি না, মানতে পারি না। যেদিকেই আমি তাকাই, আমি তিরস্কার বোধ করি, আমার চারপাশে সুখী মুখ, কিন্তু আমি আরো পদদলিত বোধ করি, আমি আমার চুলের বেনি কেটে ফেলেছি, নিজের ফুলতোলা অভারঅলে পরে ঘুরতে থাকি, আমি ছেলেদের চিমটি দেই, যেখানে দিলে বেশি ব্যথা লাগবে আর ক্রমেই আমার ভেতরে একটা কল্পনার জগত বাড়তে থাকে। আমি সেসব কল্পনার টুকরোকে টেনে আনি, জোড়া দেই আর তারপর বিশ্বাস করতে থাকি আমি এমন আমি তেমন... হ্যাঁ, অবশেষে, হয়তো বা আমি রোসেলিনের মতো হয়ে উঠতে পারি,  যে আমি জরাজীর্ণের মতো জবুথবু হয়ে ডেস্কে বসি থাকি। ডেনিস লেস্যু নামখানা ইতোমধ্যে শিক্ষক আর ছাত্রদের মধ্যেও মার্কামারা হয়ে গেছে। ডেনিস লেস্যু, ব্ল্যাকবোর্ডে যাও! ডেনিস লেস্যু, ডেনিস লেস্যু স্যুয়ার। 

ওটা ছিলো ব্যর্থ চিন্তা, আমি কোনভাবেই ওদের মতো নই। জেন ইতোমধ্যেই লে হার্ভের বড় হার্ডওয়ার দোকানের মালিকের সঙ্গে বিবাহিত। রোসেলিন, প্রত্যেক রবিবার ডান্সফ্লোরে ঘুরে বেড়াচ্ছে বয় ফ্রেন্ডের খোঁজে। তারা তো চিপাগলি থেকে গর্ভপাত করিয়ে ফেরেনি। কিন্তু তারপরও আমি ওদের দেখিয়েছি, আমি ওদের চেয়ে ভালো করেছি। ওরা স্কুল শেষ করতে পারেনি, মাঝপথেই অযোগ্যের মতো সরে গেছে। যদি ভাবি কীভাবে ওরা আমাকে নির্যাতন করেছে, কেমন করে উপহাস অবজজ্ঞা করেছে, আমাকে আমাদের দোকান আর সব জিনিসপত্র নিয়ে ক্ষেপিয়েছে যেগুলোর কোন মানেই নেই, ওদের কাছে ওদের নির্বুদ্ধি হাঁটাচলা, ওদের কথা আঁচ, ওরাই জানে না কী ভয়ঙ্কর। আর শিক্ষকগুলো, সবগুলো মাস্টার, আমি তাদের প্রত্যেককে ঘৃণা করি আর অপছন্দ করি। স্কুলের পুরোহিত তাকেও বাদ দিবো না, শেষ পর্যন্ত সে-ও আমার শৈশবের ভাগ্যকে টেনে হিচড়ে ছিঁড়েছে। ‘কনফেশন করো!’ শিক্ষক এক টুকরা কাগজ দিয়ে বললো। ‘তোমাকে এক ঘণ্টা সময় দেয়া হলো তোমার সব পাপ, অন্যায়ের কথা লেখার জন্য, তোমার কাগজের পেছন দিকে দেখো একটা প্রশ্নোত্তর পর্বও আছে।’

শীত কিংবা বসন্তের একটা দিন ছিলো সেটা। ফ্রাঁসোয় আমার পাশে বসা ছিলো, ঝাপসা, কঠিন সব প্রশ্ন। তুমি কি কখনো গ্লানি বা গৌরবে ভূগেছো? কতোবার? আমার মনের চোখে আমি স্কুলের আঙিনা দেখতে পাই, লেবুগাছটা, দানাদার মোটা লবণের তাজা গন্ধ পাই পাশের দোকান থেকে, মনেটের কালো বেনি। একটা উজ্জ্বল ফিতার মতো ‘গৌরব’ শব্দটা তার উপরে ভাসছে, সূর্যের আলোতে আলোকিত। কখনোই না। কিন্তু প্রথম বন্ধনীর ভেতরে কিছু কথা ছিলো (তুমি কি কখনো মনে করেছো যে তুমি অন্যদের চেয়ে উত্তমতর?)। আমি লম্বা হয়েছি, ওদের ছাড়িয়ে গেছি, ওদের সবাইকে হারিয়ে দিয়েছি... আমি সব কিছু করেছি। এটা দীর্ঘ তালিকা। আমি একটার পর আরেকটা ডেনিস লেস্যুর খোলস ছাড়াচ্ছি যেন, মৃত আর কবরে দেয়া একেকজন। আমি ব্যাকুল হয়ে লিখতে থাকি। চিনি চুরি করেছি, অলস ছিলাম, অবাধ্য ছিলাম, নিজের নোংরা জায়গায় স্পর্শ করেছি, সব পাপের কাজ, একটাও নিখাদ স্মৃতি নেই। তারপর, আর কিছু বাকী নেই। ‘আমি আট পেয়েছি’ ফ্রাঁসোয়া ফিসফিস করে বলে, আমি চিন্তাগ্রস্থ হই, ‘সতের!’ আট থেকে সতের... আমি নিরূপায়, আমি ঈশ্বরকে ভালোবাসি না, আমি আমার পিতা-মাতাকে সম্মান করি না, আমি এইসবই বলে দেবো। একমাত্র বের হওয়ার উপায় হলো একত্রে দুই হাত জোড় করা। এইখানে আমি প্রার্থনালয়ে আছি, আমাদের কাগজের টুকরা হাতে নিয়ে। অন্য মেয়েরা তাদের পাপের কাগজ বাতাসে দোলায়, হাসে, আগরবাতি আর চার্চের বেদীতে চলছে একটা যোগ বিয়ে আর ব্যাকরণেল খেলা। চারিদিকে ভিড়, একে অপরের স্কার্টের উপর গাদাগাদি করে বসে পড়েছে, সব মিলেঝিলে, অভেদ্য। একের পর এক তারা হারিয়ে যায় ছোট্ট কাঠের ঘরটিতে তার নিজস্ব প্রবেশদ্বার দিয়ে, উপস, একটা শাটার বন্ধ হয়ে যায়, তারপর আরেকটা। কোন পর্দা নেই, আমার মনে আছে কী বিশ্রি ছিলো সেই দিনটা। 

আমি কিচ্ছু দেখতে পাইনি কেবল এক জোড়া নীল চোখ আর সবুজ নকশা করা আনুষ্ঠানিক পোশাক রয়েছে গরাদের ওইপাশে। আমি সব কিছু জোড়ে জোড়ে পড়ি, সাবধানে, ধীরে, কাজগটা তারপর ভাঁজ করি আর উপরে তাকাই। একমাত্র একটা পাপই মনে হয় যাজক লোকটাকে আগ্রহী করে তুললো, কতোবার আমি এটা করেছি, এটা কি আমি একা করেছি? কোন ছেলে কি ছিলো সেখানে? আমি ধীরে উত্তর দিতে থাকি, কিন্তু আমি সেই লোকের চোখে দূষিত ঝিকিমিকি দেখতে পাই। অকস্মাৎ সে নোংরা, ছমছমে গলায় চেচিয়ে ওঠে। আমার দুই পায়ের মাঝখানে একটা দানব বেড়ে উঠছে, একটা চ্যাপ্টা, লাল তেলাপোকা, নোংরা। কখনোই আর এটার দিকে তাকিও না, কখনো আর এটাকে স্পর্শ করো না, কাউকে এটা দেখতে দিও না, নিচে ওইখানে শয়তান আছে, আমাকে অনুনয় করে সে বলে, নইলে ঈশ্বর, ভার্জিন মেরি আশীর্বাদ, সকল সন্তুরা আমাকে ত্যাগ করবে... ‘‘অনুশোচনার প্রার্থনা পাঠ করো।’’ আমি উঠি, ভীত আর যতোটা সম্ভব হাঁটু গেড়ে বসি। আমি নিশ্চিত ছিলাম তার ইস্পাত চোখ তখনও আমার দিকে তাকিয়ে আর সে সবাইকে আমার পাপের কথা বলে দিবে। আমি ভেবে ছিলাম আমি হয়তো এই পতন থেকে রক্ষা পেতে পারি, দেখেছিলাম যেন একটা মার্বেল মেঝের গর্ত দিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু পুরোহিত পিতা আমার নাক ঘষে দিলো, আমাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢেকে দিতে চাইলো।

আমি বেরিয়ে আসলাম কলুষিত আর একা হওয়ার অনুভূতি নিয়ে। একমাত্র একজন আমি। আমার পেছনে শুনতে পাচ্ছি বাকী ক্লাসের সবাই ফিসফিস করছি, মুক্ত, কোন মর্তের পাপ যেন নেই তাদের। বাকী সবাই যদিও এই একই পাপের কথা বলতো তিনি হয়তো এটা নিয়ে এতো হৈচৈ করতেন না। মুক্তির কোন পথ নাই, আমি ছিলাম প্রত্যাখাত, অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন ‘অপরিচ্ছন্ন কর্মের জন্য’। একটি চিৎকারে রহস্যময় ছবিগুলো বেরিয়ে এলো, তোমার ঊরুর মাঝখানে ফুলের মতো উন্মুক্ত স্থানে আজব অনুভূতি, হাত একত্রে, অনুসন্ধান করছে, ক্রেটের পেছনে মনেটের সঙ্গে তুলনামূলক মন্তব্য, প্যান্টি খুলে ফেলা, এইসব কিছু একটা বিশাল দানবীয় প্রহসনে পরিণত হয়েছিলো, পরিণত হয়েছিলো অশুচি চিন্তায় আর ‘শয়তানী’ কর্মে। সুখ বা আলোর একটা রশ্মির নেই। শয়তান ভেতরে এবং চারিদিকেই। হয়তো আমি যদি না সরতাম, যদি আমি সেখানে হাঁটু গেড়ে সাদা মূর্তির সামনে বসে থাকতাম, আমি পরিশুদ্ধ হতাম, যে সাদা নিঁখুত পোশাকের কথা তিনি বলেছেন তা পরিধান করলে বিশুদ্ধ হতাম। আমি নিজেকে একটা সুন্দর সাদা মূর্তিতে পরিণত হতাম। কিন্তু চলে যাওয়ার জন্য আমার চুলকানি শুরু হয়ে গিয়েছে, আমি টের পাচ্ছিলাম পাপগুলো কাঁটাময় ফুসকুড়ির মতো আমার গায়ের উপর হাঁটছে। আমি অন্তরে জানতাম, এটা হারানো নষ্ট কাজ, আমার পুরো জীবনটাই একটা বিরাট পাপ। কোন পরিত্রান সম্ভব নয়। জঘন্য, নারকীয়। কোথাও এর সঙ্গে আমাদের দোকানের সংযোগ আছে, এর সারি সারি কৌটায় ভরা ফল,  শনিবার বিকালের ক্রেতাদের মুখ থেকে বের হওয়া ধোঁয়া আর চিৎকার, আমার জগদ্দল, ঘামে জরজর মা, রান্না ঘরে রাত্রিরে তার বায়ু নিগর্মন আর বাজে ভাষা, এইসব কিছুর সঙ্গেই আমার পাপ জড়িত। বাড়িতে আমি স্বাধীন ছিলাম জ্যাম জেলির বোতলে আঙুল চুবাতাম, বুড়ো মাতালগুলোর সঙ্গে ইয়ার্কি মারতাম, মনে যা আসে তাই বলতাম, কামলাদের ভাষা, প্রতিবেশিদের গালিগালজ, সবই ছিলো। আমার অঙ্গভঙ্গি আর কাজকর্ম মানিয়ে যেতো তাদের গ্লাসের পানীয়ের ঝিকিমিকির সাথে, ডোমিনো খেলোয়ারদের হাসি তামাসার সাথে। আমি আমার জগতের সাথে নিঁখুত ঐকতানে ছিলাম। কিন্তু বাজে মন্তব্য, চাপা হাসি, না, আমার জগতের জিনিসগুলোর কোন মূল্য স্কুলে ছিলো না।

আমি দেরিতে আসতাম, প্রত্যাশা করতাম সেই সবের আর কথা বলতাম সেই সব জিনিসের যেগুলোর কথা বলাও গ্রহণযোগ্য ছিলো না।  সেই যাজক-পুরোহিতের কাছ থেকে ফেরার পর... ভার্জিন মেরি, সকল সন্ত-পুরোহিত, পবিত্র চার্চ আমার ভাবনাকে ধিক্কার দিয়েছে, আমার কামনা বাসনা তখনো অনিয়মতান্ত্রিক ভাবেই ঘুরপাক খায় বাঁর  আর রেড ওয়াইনের বোতলে। আমি আমার শয়তানি কার্যক্রমকে আমার পরিবেশ থেকে আলাদা করতে পারছিলাম না। চার্চ এই সব কিছুকে প্রত্যাখান করেছে, আমার মা একটা কালো ঘোটকীর মতো রাতের বেলা অতিমন্দ কাজের পর হাপাচ্ছে অবসাদে, আমার বাবা তার বাঁধানো দাতের পাটি খুলে রাখছে ডিনারের পর, আমি যা ভাবতাম তা তো আমার কাছে ছিলো নির্দোষ আনন্দ। ঈশ্বর জেনের প্রতি, রোসেলিনের প্রতি হাসি দিয়েছিলো, তারা যখন লোভি বা অলস হয়েছিলো সেটা ছিলো লঘু পাপ, একটা খেলা, তাদের শোবার ঘরে সাদা রং আর বসার ঘরে ফুলেল পর্দা, তারা এমনই বলেছিলো। আমার জীবনে সব সময় অশুদ্ধ আর অপরিচ্ছন্ন সব কিছু কারণ আমি অন্য রকম প্রতিবেশ থেকে এসেছি। আমি কেবল ক্ষমার জন্য যতো খুশি প্রার্থনা করতে পারি। আমাকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে।

আমার মনে হয়েছে ওই কনফেশনের সময় আমি যেন দেয়ালে ছুঁড়ে দেয়া একটা মার্বেল আমার সব প্রবৃত্তিকে যখন সহসা অসাড় করে দেয়া চোখ ছুঁড়ে ফেলেছে। অপমানিত, চরিত্রহীন এক মেয়ে... জন্ম থেকে খারাপ, আমি এটা বিশ্বাস করেছিলাম... আমার যে কোন খারাপ পরিণতিই হতে পারে। শুধু এই কারণে না যে আমি আমার বাবা মা আর তাদের জগতকে ঘৃণা করেছি। এটা আরো পুরনো, এর প্রমাণও আছে।

জেন বা রোসেলিন নয়, আমিই ছিলাম সেই অপ্রত্যাশিত সন্তান যাকে তার বাবা মা চায়নি। হয়তো এইটাই সবচেয়ে অনায়াস, পাপের ধারণাকে প্রলম্বিত করার, পাপেরও অনেক আগেই। আমি সবসময়ই ভাবতাম, আমি একমাত্র। অন্য শিশুরাও হয়তো আমার মতো ভাবতো, স্কুলের ভিড়ে হারিয়ে যেতো, নিজের জায়গার অভাব বোধ করতো, না এমন কখনো অবশ্য দেখিনি, কলেজেও দেখিনি। হয়তো অন্য কোথাও আরো কেউ একজন আছে যে তার দুমড়ে মুচড়ে ওঠা তলপেট চেপে ধরে আছে, আমার মতো, ঠিক এই সময়েই। এটা কল্পনা করাও কঠিন। তার ক্ষেত্রে এটা নিছক সাফল্য নয়, একটা হতভাগা ভুল, নিখাদ দুর্ভাগ্য। আমার ক্ষেত্রে এটা অপেক্ষা করেছে প্রথম শ্রেণী থেকেই, সেন্ট অগনেস  ও তার ভেঁড়া দেয়াল থেকে চোখ রেখেছে। আমি ভালো ছোট্ট মেয়েদের বৃত্তের মধ্যেই পড়ি না। খানকিগুলো, আমি যা কিছু করেছি ঠিক ওইগুলোর মতোই করেছি, আমি যে আলাদা খুব সেই বিষয়কে চাপা দিতেই এ সব করেছি... আমি ওদেরকে ওয়াইন বোতলের জৌলুসময় লেবেল, বেজ, প্লাস্টিকের জন্তু দিতাম গোপনে সরিয়ে নেয়া কফি বা চকলেটবারের সঙ্গে। তারা ছুটির সময় ভিড় করতো, আমি ওদের হাতে ওগুলো দিয়ে বলতাম, ‘এইটা তোমার জন্য, কারণ আমি তোমারে পছন্দ করি, কিন্তু এই যে তুমি, তুমি আমার বন্ধু নও!’ ওরা জিভ দেখাতো, ভেঙাতো আর আমি ধীরে চলে যেতাম, ওদেরকে করুণা করে খুশি হতাম। ঠিক আমার মায়ের মতো যে স্কুলের বেতনের সাথে শিক্ষককে পাঁচ ফ্রাঁ আলাদা দিতো ‘তার পছন্দের তালিকায় থাকতে!’ আমি ডেস্কে যেতাম আর চেচিয়ে বলতাম, ‘আমার মা বলছে আপনি বাকী টাকাটা রাখতে পারেন।’ নিউ ইয়ারের সময় আমি একটা পুরো চকলেটের বাক্স নিয়ে আসি আর মাস্টারনির নাকের তলায় ফেলে দেই। অন্যরা মেয়েরা তাকায়, হিংসায় সবুজ হয়। আর আমি সাজিয়ে গুছিয়ে বলি, আমি গল্প বানাতে জানি, আমি উত্তর দিতে শিখেছি, সাজানো গোছানো, বেশ গাঢ় করে বলি যাতে তারা এর সঙ্গে একাত্ম হতে পারে। দোকানটাকে তো আর বাদ দিতে পারি না, তবে বাড়িয়েই বলতে পারি। ‘আমার বাবা একটা ভালো দান মেরেছে, তোমার উচিত আমার খেলনাগুলো দেখা।’ সত্যিকারের মানুষের আকারের পুতুল তারা কথা বলে, হাঁটে, সিল্কের পোশাক পরে, টি-শেটখানি এতোই নমনীয় যে ওদেরকে আমার শোবার ঘরেই রাখি। আমার চাচা থাকে বর্দ্যুতে, মার্সেলাসে, ডাক্তার, ধনী কৃষক, আমার আত্মীয়, যখন আমি খুব ছোট ছিলাম আমি এল্পস পর্বতে গিয়েছি বেড়াতে, আইফেল টাওয়ার, মন্ট সেন্টা-মাইকেলে গিয়েছি... আমি বানাতে থাকি গল্প।

আমি নিজেকে শুধরাই গল্পের মধ্যে। ওরা গিলে খায় সব, আমি ওদেরকে সমুদ্রের পারে ছুটি কাটানোর গল্প খাওয়াই, চশমার ব্যবসায়ী, বইয়ের দোকান, খামারগুলো, বিভিন্ন শহরের নাম আর নদীর নাম আমি ভূগোল ক্লাস থেকেই শিখেছি, সেগুলোকে আমি বড়লোকি রঙ মাখিয়ে উপস্থাপন করি। আমি একটা আবিষ্কার করি, দারূণ, অপ্রত্যাশিত, এক বেমানান মাংস পি-, ডেনিস লেস্যু তার স্কুলের খেলা আবিষ্কারের ক্ষেত্রে খুব ভালো, পড়া, অঙ্ক, ইতিহাস, আমি অনায়াসে পাল তুলে দেই। দুই বছর ধরে আমি আমার ডেস্কে বসে কেবল আকৃতি দেখেছি নানা রকমের, শব্দগুলো আমাকে ডুবিয়েছে, অচেনা, অর্থহীন সব শব্দ। যখনই আমি ঘরে ফিরতাম, আমি আমার স্বাভাবিক কথা বলাকে উদ্ধার করতাম। আমি কথিত ভদ্র, মার্জিত কণ্ঠকে স্কুলে ফেলে আসতাম। আমি আমার স্কুলের থলেকে মাটিতে ফেলে দিতাম। বসন্তের দিনগুলো, আমি সোজা মনেটের বাড়িতে যেতাম ওকে আমার সঙ্গে নিয়ে আসতে। রাত নামার আগ পর্যন্ত আমরা ময়লা কাপড় পরতাম যা ধোঁয়ার জন্য রাখা থাকতো, আমরা খাঁচার মধ্যে মুরগিগুলোকে জ্বালাতাম। আর শীতকালে, ক্যাফের গোল একটা টেবিলে বসে আমরা ডোমিনো দিয়ে বাড়ি বানাতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা, ম্যাগাজিনের ছবিগুলোকে কেটে কেটে গল্প বানাতাম, ক্যালেন্ডারের উপর সব রঙ ছড়িয়ে দিতাম, দম বন্ধ করা হাসি হাসতাম, আমরা পুরুষদের আঁকতাম সাঁতারের পোশাকে বড় পুরুষাঙ্গ সহ। আমরা কোলের মধ্যে পর্যাপ্ত মিষ্টি রাখতাম আর সব সময় ওগুলোকে চাটতাম, চুষতাম, গল্প বলার সময়, খেলার সময়। ক্রেতাদের কাছ থেকে যে উৎসাহ পেতাম সেটা বলার দরকার নেই, শনিবারে তরকারির ঝোলের ঘ্রাণ কিংবা তার্পিন তেলের ঘ্রাণ পেতাম, মা খন চেয়ারে স্তুপ করা কাপড়গুলোর ক্যাফের পেছন দিকে উঠিয়ে নিতো। আমি কোনদিন স্কুল থেকে আসার পর আমার স্কুল ব্যাগ বাড়িতে খুলিনি। আমি কোনদিনই প্রাচীন ফরাসীদের কিংবা তাদের রাজ্য বিভাগকে পাত্তা দেয়নি। আমার পিতামাতাও ওগুলোতে পাত্তা দেয়নি, অন্তত প্রথম দিকে, পরের কথা, যখন আমি ভালো নম্বর পেতে শুরু করলাম তারা আমাকে তাড়া করতো...

দশে সাত! ফ্রাঁসোয়া খুশিতে চিৎকার দিয়ে উঠতো। জেনি ‘তিন’ পেয়ে ঘ্যাণঘ্যান করতো, তার নাক ডেস্কে নত হয়ে থাকতো। আমি ওর দিকে আনন্দে তাকাতাম, আমার বিশ্বাস হতো না এ জন্য সে কাঁদছে! এমনকি তাকে তো এ জন্য কেউ ইচ্ছামতো পেটুনিও দেয়নি আর সে একেবারে ম্লান ও বিবর্ণ হয়ে উঠছে একটা কাগজের মণ্ডে বানানো পুতুলের মতো। ‘আমার বাবা মা আমার উপর ব্যাপক চেঁচামেচি করবে!’ আমি সব সময় দশে দশ পাওয়া নিয়ে গর্ব করতে শুরু করেছি ইতোমধ্যেই। সুযোগ পেয়ে আমি জেনির দিকে জিভ ভেঙচাই। অন্যেরা আমার প্রতি ভালো হতে শুরু করে, তারা আমাদের ছোট্ট রাস্তার পেছনের ক্যাফে নিয়ে বাজে কথা বলা বন্ধ করে, সেই সময়টায় আমি বাড়িতে বাড়িতে কাজ শুরু করেছি, যাতে করে আমি আরো এগুতে পারি। বিস্কুটের টিনকে ডেস্ক বানিয়ে সিঁড়ির উপরে কিংবা কিংবা মাঠের পতাকার নিচে বসে  পা ছড়িয়ে বসে আছি, পাথরগুলো আমার পায়ে আটকে যাচ্ছে,... ‘নিনিস! তোমার ঊরু লাল হয়ে যাচ্ছে!’ আমি  পড়ার মাঝখানেই প্রতিশোধ নেই। ‘আমি তোমার আব্বাকে বিচার দিবো!’’ ‘ঠিক আছে, পিচ্চি শয়তান, বলিস!’ আগ্নেয়গিরি আর নয়ের নামতা আমার চোখের সামনে সূর্যের আলোতে নাচতে থাকে... নির্বোধ, জড়বুদ্ধির, আমাদের ফ্রাঁসোয়া, আমার বাবা তাই বলতো ওকে। বোকার মতো প্রদর্শন প্রবণতা, তার দুইটা পালকের মালা নিয়ে, সে ঠোঁট ফোলাতো বিরক্তিকে, আর আমার হৃদয়ে চলতো চিন্তার ঝড়। আমি ওকে দেখাবো! আমার মনে হতো, আগামীকাল, আগামীকালই আমি দাঁড়িয়ে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেবো।

তখন আমি প্রথমবারের মতো ভালো করতে চাইতাম, অন্যদের চেয়ে ভালো হতে চাইতাম, মানুষকে দেখাতে চাইতাম, কথিত দূর্বল আর নষ্ট মেয়েটি... আমি ঠিকঠিক প্রতিশোধ নিয়েছিলাম, ব্যাকরণ ক্লাসে, অভিধান আর শব্দ পরীক্ষায়, অদ্ভুত সব বাক্য ধরে তুমি কিছুই পাও না কিন্তু খাঁজকাটা একটা দেয়াল ধরে মরুভূমিতে হাঁটছো যেন। অঙ্কের হিসেবে প্রতিদিন দশটা করে বানান মুখস্থ করতাম, লা ফনটাইনের অবোধ্য কাহিনী আঁকা হতো আমাদের চকলেটের প্যাকেটে, সব কিছু আমি পড়তাম, বারবার, কাজ করতাম, উত্তর সাজাত। কেউ যদি কোন প্রশ্নের উত্তর না-জানতো মাস্টারনি তখন তার ভ্রু আমার দিকে প্রদর্শন করে বলতো ‘ডেনিস লেস্যু’, আর আমি তাকে উত্তর দিয়ে দিতাম, যেন অন্য মেয়েদের গালে চড় মারতাম। এইটা বরং আরো ভালো যে এটা দেখা যাচ্ছে না এবং কেউ ফেরতও দিতে পারছে না। (চলবে)

নোবেলজয়ী আনি এরনোর উপন্যাস: ৭ম পর্ব