রাইজিংবিডি স্পেশাল

ডেঙ্গুতে নভেম্বরে সর্বোচ্চ মৃত্যু

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছিল, অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমতে থাকবে। অথচ, বাস্তব চিত্র ভিন্ন। এ বছরের মধ্যে অক্টোবর মাসে ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। সারা দেশে কেবল অক্টোবরেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ১৯ হাজার ৯৪৫ জন। মারা গেছেন ৮৬ জন। এর আগে কখনো অক্টোবর মাসে কখনও এত বেশি রোগী পাওয়া যায়নি। ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যায় দ্বিতীয় অবস্থানে নভেম্বর মাস। এ মাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১৭ হাজার ৩৩৪ জন। কেবল নভেম্বর মাসেই ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ১২২ জন, যা এ বছরে সর্বোচ্চ। বছরের বাকি ১০ মাসে মারা গেছেন মোট ১৩২ জন।

এ বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫৭ হাজার ৩৫৮ জন ডেঙ্গু রোগী। এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩৮ হাজার ৩৫৫ জন। ঢাকার বাইরে সারা দেশে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১৯ হাজার ৩ জন। একই সময়ে সারা দেশে হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ফিরেছেন ৫৫ হাজার ৩০১ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ১২৬ জন। ফেব্রুয়ারিতে ২০, মার্চে ২০, এপ্রিলে ২৩, মে মাসে ১৬৩ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। এ বছর প্রথম ডেঙ্গুতে রোগী মৃত্যু জুন মাসের ২১ তারিখ। জুনে মারা যান ২ জন এবং আক্রান্ত হন ৭৩৭ জন। জুলাই থেকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। জুলাইতে আক্রান্ত হন ১ হাজার ৫৭১ জন এবং মারা যান ৯ জন। আগস্টে আক্রান্ত ৩ হাজার ৫২১ জন, মারা গেছেন ১১ জন। সেপ্টেম্বরে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যায় তিন গুণ। এ মাসে আক্রান্ত হন ৯ হাজার ৯১১ জন আর মারা যান ২৪ জন। অক্টোবরে মাসে আক্রান্ত হন ১৯ হাজার ৯৪৫ জন এবং মারা যান ৮৬ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২৫৪ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা আগের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। একই সময়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫৭ হাজার ৩৫৮ জন। যদিও দেশের বেশিরভাগ হাসাপাতালের তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পায় না। প্রতিবছর যেখানে নভেম্বর মাসে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা কমতে শুরু করে, সেখানে এ বছর নভেম্বরে ১২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ ১৭৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল ২০১৯ সালে।

এদিকে, এডিস নিয়ন্ত্রণে কীটনাশক প্রয়োগের পাশাপাশি নতুন উপায় খুঁজছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ওলবাকিয়া নামে ব্যাকটেরিয়া সংযোজিত পুরুষ মশা এনে এডিস মশার নিয়ন্ত্রণ করার চিন্তা করছেন তারা। অপরদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র বলছেন, মশা নিয়ন্ত্রণের কার্যকর উপায় নিয়ে গবেষণা দরকার। প্রয়োজনে তিনি গবেষকদের অর্থায়ন করতে রাজি আছেন।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জোবায়দুর রহমান জানিয়েছেন, এডিস মশার বিস্তার নিয়ন্ত্রণে ওলবাকিয়া সংযোজিত পুরুষ মশা পালন ও এ বিষয় নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্ট ও জিওলজিক্যাল সায়েন্স বিভাগের সঙ্গে দুই দফা বৈঠক করেছেন। তারাও আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তাদের টিম বাংলাদেশে আমাদের উত্তর সিটির একটা অংশে ওলবাকিয়া পদ্ধতির ওপরে একটা পাইলটিং করতে চাচ্ছে। আমরা রাজি হয়েছি।

এ পদ্ধতি সম্পর্কে জোবায়দুর রহমান বলেন, ‘এটা পুরুষ মশাকে জন্মদানে অক্ষম করার করার পদ্ধতি। ওলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া যখন প্রকৃতিতে ছাড়া হবে, তখন মূলত স্ত্রী এসিড মশার সঙ্গে মিলিত হবে, যারা ডেঙ্গু ছড়ায়। এ মিলনে ফলের স্ত্রী মশার আর বাচ্চা উৎপাদন হবে না। ফলে আস্তে আস্তে স্ত্রী মশাগুলো যখন মারা যাবে, তখন ডেঙ্গু একেবারে কমে যাবে।’

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমরা বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন দেখছি। কীটপতঙ্গের বা এডিস মশার বিবর্তনের পরিবর্তনও দেখা গেছে। আপনারা লক্ষ করছেন, এবার এডিস মশার প্রাদুর্ভাব অক্টোবর ছাড়িয়ে নভেম্বর পর্যন্ত চলছে। এতদিন এডিস মশার প্রাদুর্ভাব থাকার কথা ছিল না। এখন আমরা শুষ্ক মৌসুমে চলে এসেছি। তারপরও আমরা এডিস মশার বিস্তার লক্ষ করছি।’

তিনি বলেন, ‘এই বিষয়গুলো নিয়ে আরও বেশি গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। সেজন্য যদি কোনো বরাদ্দ প্রয়োজন হয়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন তা দিতেও প্রস্তুত আছে। কারণ, আমরা ঢাকাবাসীকে মশক নিয়ন্ত্রণের সুফল পৌঁছে দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ।’

দুই সিটি করপোরেশনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞানের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেছেন, ‘গবেষণা করা সিটি করপোরেশনের কাজ নয়। তাদের উচিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণায় সহযোগিতা করা, যেটা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হয়ে থাকে।’

নতুন প্রযুক্তির পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে স্বাগত জানিয়ে এই কীটতত্ত্ববিদ বলেন, ‘ওলবাকিয়া পদ্ধতি সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। তারপরও বাংলাদেশে যেকোনো একটি ছোট জায়গায় পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে। আর একটি বিষয় হচ্ছে—ওলবাকিয়া ইনফেক্টেট মশা বাংলাদেশে না এনে, দেশীয় গবেষকদের নিয়ে নিজস্ব ল্যাবে পরীক্ষা করে দেশীয় মশায় এ ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করিয়ে প্রকৃতিতে ছাড়া যেতে পারে।’