খেলাধুলা

অদম্য মিরাজের অতুলনীয় ব্যাটিংয়ে অবিশ্বাস্য জয়

অবিস্মরণীয়, অবিশ্বাস্য, অতুলনীয়। শব্দ ভাণ্ডারে কোনো শব্দ দিয়ে এই জয় ব্যাখ্যা করা যাবে না। মেহেদি হাসান মিরাজ-মোস্তাফিজুর রহমানের অবিশ্বাস্য বিজয় গাঁথা যেন অকল্পনীয়।

স্কোর টাই। মিরাজ সিঙ্গেল নেননি। কাভারে ফিল্ডারদের মাথার উপর দিয়ে উড়িয়ে বাউন্ডারি হাঁকিয়ে ১ উইকেটে জয় নিশ্চিত করেন মিরাজ। দেড় যুগ ধরে বাংলাদেশের খেলা কাভার করা এক সাংবাদিক বলছিলেন, ‘এটা বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় জয়, এমন আমি কখনো দেখনি।’

তাইতো ছিল। ১৩৬ রানে ৯ উইকেট পড়ার পর শুরু মিরাজের কাব্যগাঁথা। শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে মোস্তাফিজুর রহমান যখন উইকেটে আসছিলেন মিরাজ দৌড়ে গিয়ে তাকে কি যেন বোঝাচ্ছিলেন। তখন কেউ কি বুঝেছিলেন এই আলাপেই হয়তো হচ্ছিল শ্বাসরুদ্ধকর জয়ের চিত্রনাট্য। মোস্তাফিজকে সঙ্গে নিয়ে ৪১ বলে ৫১ রানের জুটি গড়ে বাংলাদেশকে অবিশ্বাস্য এক জয় এনে দেন ২৪ বল হাতে রেখে। দশম উইকেটে বাংলাদেশের সেরা জুটি এটি। আর ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে দশম উইকেটে চতুর্থ সফল রান তাড়া করে পাওয়া জয়।

শেষ দিকে উইকেটের মিছিল দেখে গ্যালারি থেকে কিছু দর্শক বেরিয়ে যান। নিশ্চয় তারা আফসোসের অনলে পুড়ছেন এখন। যারা ছিলেন তারা গর্জনে-তর্জনে তাঁতিয়ে দিয়েছিলেন মিরাজদের। তাইতো তারা হয়ে যান বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যান। নিখুঁত ব্যাটসম্যান। মিরাজ ৩৯ বলে ৩৮ রানে ও মোস্তাফিজ ১১ বলে ১০ রানে অপরাজিত ছিলেন।

চতুর্দিকে ফুটবল নিয়ে উন্মাদনা। দ্য গ্রেটেস্ট শো আন আর্থ বলে কথা। বিশ্বকাপ জ্বরে যখন আক্রান্ত গোটা বিশ্ব, গোটা দেশ, যখন অন্যের জয়-পরাজয় নিয়ে চলছে গর্জন-তর্জন; ঠিক তখনই নিজেদের খেলা ক্রিকেট নিয়ে বাংলাদেশ-বাংলাদেশ গর্জনের সুযোগ পেয়েছিল লাল সবুজের সমর্থকেরা। প্রতিপক্ষ যখন প্রতিদ্বন্দ্বী, প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারত, তখন উন্মাদনার পারদ উপরের দিকেই থাকাটাই স্বাভাবিক।

সবকিছুই ছিল। টিকিট নিয়ে হাহাকার, শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম হাউজফুল, ফুটবলারদের নিয়ে উল্লাসের এই সময়ে ‘সাকিব-সাকিব কিংবা মিরাজ-মিরাজ’ করে গগণবিদারি গর্জন-সব কিছুই ছিল বিদ্যামান। কিন্তু আক্ষেপের সুর, হতাশার কথা সেই এক জায়গাতেই আটকে আছে। ব্যাটিং ব্যর্থতা। বিব্রতকর কর ব্যাটিং। যার জন্য অল্পতে বেঁচে গেছে বাংলাদেশ।

নাহয় এভাবে কি এই ম্যাচ জিততে হয়? রোববার শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ভারতের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডেতে শেষের ঘণ্টাখানেক বাদে পুরোটা সময় বাংলাদেশই শাসন করছিল। দলীয় ৯৫ রানে বিরাট কোহলির অসাধারণ ক্যাচে সাকিব আল হাসান ফেরার পর সবকিছুই পাল্টে যায়। অভিজ্ঞ মুশফিকুর রহিম- মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের ব্যাটে ছিল অনভিজ্ঞতার ছাপ। যেন তারা হারের জন্যই খেলছিলেন। তাদের অনুসরণ করেছেন আফিফ হোসেনরা।

লক্ষ্য ছিল মাত্র ১৮৭। শুরুটা হয়েছিল নাজমুল হোসেন শান্তর গোল্ডেন ডাকে। এনামুল হক বিজয় জীবন পেয়েও জীবন বিলিয়ে দেন মাত্র ১৩ রানে। সাকিব-লিটন জুটি দিয়েছে ঘুরে দাঁড়ানোর আভাস। ৬১ বলে ৪৮ রান আসে জুটি থেকে। ওয়াশিংটন সুন্দরের স্লোয়ারে পরাস্ত হওয়ার আগে লিটন করেন ৪১ রান। ছন্দপতন ঘটে শূন্যে ভেসে কোহলির অসাধারণ ক্যাচে সাকিব আউট হওয়ার পর।

৩৮ বলে ২৯ রানে এক্সট্রা কাভারে আউট হন সাকিব। অথচ এর আগের ওভারেই সাকিব টানা দুই চারে দিয়েছিলেন খোলস ছেড়ে বের হওয়ার আভাস। বল হাতে প্রতিপক্ষকে চূর্ণ করলেও ব্যাট হাতে দিনটি নিজের করে নিতে পারেননি। সাকিব আউট হলেও ভরসা ছিল মুশফিক-রিয়াদের মতো ব্যাটসম্যান থাকায়। কিন্তু তারা দিয়েছেন চরম ব্যর্থতার পরিচয়।

ধীরগতিতে খেলে ক্রিজে থিতু হয়েছেন। ৬৯ বলে ৩৩ রানের জুটি গড়েছেন। যখন একটু রয়েসয়ে খেলে ম্যাচ বের করে আনার কথা ঠিক তখনি দুজন পরপর দুই বলে আউট হয়ে বাংলাদেশকে বিপর্যয়ে ঠেলে দেন। শার্দুল ঠাকুরের ৩৫তম ওভারের শেষ বলে এলবিডব্লিউ হন ৩৫ বলে ১৪ করা মাহমুদউল্লাহ। রিভিউ নিলেও কাজে আসেনি।

সিরাজের করা পরের ওভারের প্রথম বলেই পয়েন্টে খেলতে চেয়েছিলেন মুশফিক, কিন্তু বল ব্যাটে লেগে ভেঙ্গে দেয় মুশফিক। ৪৫ বলে ১৮ রান করেন তিনি। তাকে ফিরিয়ে যেন প্রাণ সঞ্চার হয় ভারতীয় শিবিরে। আফিফ এসেও সুবিধা করতে পারেননি। অভিষিক্ত কূলদীপের বলে দারুণ ক্যাচে ১২ বলে ৬ করে ফেরেন সাজঘরে। ওই ওভারেই হিট আউট হন ইবাদত। হাসান মাহমুদ এসেও ২ বলের বেশি খেলতে পারেননি। অভিজ্ঞদের ব্যাটিং ব্যর্থতা বাঁচিয়ে দেন মিরাজ। অনবদ্য, অতুলনীয় ইনিংস খেলে ফাইফার পাওয়া সাকিবকে পেছনে ফেলে ম্যাচসেরাও হন তিনি।

ভারতের হয়ে সর্বোচ্চ ৩ উইকেট নেন মোহাম্মদ সিরাজ। ২ উইকেট করে নেন কূলদীপ-ওয়াশিংটন সুন্দর। অথচ কর্তৃত্ব দেখিয়ে জিততে পারতো বাংলাদেশ। টস জিতে ফিল্ডিংয়ে নেমে ভারতকে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন রানে অলআউট করে বাংলাদেশ। এমন দিন কয়দিনই বা আসে?

চতুর্থবারের মতো সাকিব নেন ফাইফার। ৩৬ রানে ৫ উইকেট নিয়ে ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে ক্রিকেটে একমাত্র বাঁহাতি স্পিনার হিসেবে রেকর্ড গড়েন। অভিষেকে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২ উইকেট নেওয়া ইবাদত ভারতের বিপক্ষে সুযোগ পেয়েই নিজেকে চেনালেন নতুন করে। ৪৭ রানে ক্যারিয়ার সেরা ৪ উইকেট নিয়ে ভারতকে দ্রুত অলআউটে ইবাদতেরও অবদান কম নয়।

ভারতের হয়ে সর্বোচ্চ ৭৩ রান করেন লোকেশ রাহুল। রোহিত শর্মা ২৭ ও শ্রেয়স আইয়ার করেন ২৪ রান। এ ছাড়া আর কেউ ২০ রানের ঘর পার হতে পারেননি।