প্রবাস

অ্যালাব্যামায় হেমন্তের শেষ দিন

ছোটবেলায় শীতকালটা একটা আবেগ হিসেবে কাজ করতো। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়ে বেশ লম্বা একটা সময় বই-খাতা থেকে দূরে থাকা, বর্ষার প্যাঁচপ্যাঁচে কাঁদা শুকিয়ে জেগে ওঠা খেলার মাঠ, আর শীতের শিশির জড়ানো মিষ্টি রোদ।

হুম, আমার আবেগ তো কাজ করতোই। তবে আমার আবেগটা আরেকটু ভিন্ন ছিল বোধহয়। সবার সাথে না গেলে তো ভিন্নই হয়, তাই না?

আমার ছোটকালটা এমন একটা সময় ছিল, যখন ইদের ছুটিগুলো আসত শীতের শেষে, মাঝামাঝি, নয়তো শুরুতে। আমার ছোটবেলার শীতকালগুলোর একটা বড় সময় কেটেছে ভোর বেলার দাদা বাড়ির উঠোনে-দাদির কাঠের চুলোর ধোঁয়ায়, সকাল বেলা বাড়ির পেছনে ভুঁইতে-শিশির দিয়ে পা ভেজাতে ভেজাতে, মধ্যবেলা পুকুরে-গা হিম করা পানিতে ইঞ্চি ইঞ্চি করে নামতে নামতে, দুপুর বেলা বাড়ির সামনে বাঁশের মাচার ওপর-পা দোলাতে দোলাতে ধান, চাল আর কাঠ চেরাই করতে আসা মানুষ জনকে দেখতে দেখতে, বিকেল বেলা বাড়ি থেকে দূরে কোন মরে যাওয়া সরিষা খেতে-আকাশে উড়তে থাকা ঘুড়িগুলো গুনতে গুনতে, সন্ধ্যা বেলা নদীর পাড় দিয়ে-হালকা একটা ধোঁয়ার আস্তরণ এসে ঢেকে দিয়ে যাওয়া নদীটা দেখতে দেখতে, আর রাতের বেলা বাড়ির দাওয়ায় হাত পা ছড়িয়ে-হারিকেনে পোড়া কেরসিনের গন্ধের সাথে দাদার আতরের সুঘ্রাণ নিতে নিতে।

এই স্মৃতিগুলো ছিল আমার সুখের স্মৃতি, শান্তির স্মৃতি, পরম আবেগে বুকের এক কোনায় লুকিয়ে রাখা এক টুকরো হাসিমুখ।

বর্ষাকাল ছাড়া আর কোনো কাল, ঋতু, সময় আমার কাছে তেমন একটা অর্থ বহন করে না। কিন্তু প্রত্যেকবার এই শীতের শুরুটাই কেন যেন আমাকে নিয়ে খেলে, আমাকে ধাঁধায় ফেলে দেয়। গাঢ় নীল আকাশ, বাতাসে দূর থেকে ভেসে আসা কাঠ পোড়া গন্ধ, আর যখন তখন গায়ে মিষ্টি একটা রোদের ছোঁয়া মনের ভিতর কোন একটা জায়গায় সব যুক্তি তর্ক এলোমেলো করে দিয়ে যেন বলে যায়, এই খোকা, দাদা বাড়ি যাবি না?

কলেজ ভার্সিটি পার করে যতদিন দেশে ছিলাম, শীতকাল এসে চলে যেত। আলমারির কোনায় শীতের ভারি কাপড়গুলো পরতে পারছিনা বলে দুঃখ হওয়া ছাড়া আর কিছুই মনে আসত না। হয়ত ভুলেই গেছিলাম দিনগুলোর কথা।

কিন্তু গল্পের কি শেষ বলে কোন কিছু আছে, গল্পের বইয়ের আছে কারণ বইয়ের পাতা তো গুঁটিকতক, গল্প শেষ না করলে কি বই বিক্রি হবে? জীবনের কিন্তু পাতার শেষ নেই, পৃষ্ঠাও অগুনতি। জীবনের গল্প হয়ত শেষ হয় না।

কয়েকদিন আগে সাইটের কাজে অ্যালাব্যামার এক কোনায় যেতে হয় আমার। বড় রাস্তা (ইন্টারস্টেট) ধরে যেতে যেতে তেমন কিছুই চোখে পড়ে না।  উপরন্তু রাস্তার অন্যান্য ড্রাইভারগুলো কতখানি বুদ্ধিবিহীন তা নিয়ে তাদের গাল মন্দ করতে করতেই চলে যায়। সেদিন কি মনে করে বড় রাস্তা (ইন্টারস্টেট) বাদ দিয়ে গলি গুপচি (কাউন্টি রোড) পথ ধরলাম ফেরত আসার জন্য। ভুলটা সেখানেই হয়ে গেল। রাস্তা দিয়ে ঢুকেই মন হলো অন্য এক দুনিয়ায় চলে এসেছি। আঁকা বাকা দুই লেনের রাস্তাগুলো যেন এঁকেবেকে সাপের মতো বিশাল এক ক্ষেতের দিয়ে চলে গেছে। একপাশে মরে যাওয়া ভুট্টাগাছগুলো বেয়ে বেয়ে কি যেন একটা লতানো লাল ফুল গাছ ছেয়ে ফেলেছে। 

অন্যপাশে বাদাম আর তুলার হলুদ হয়ে যাওয়া গাছের পাতা।  বিকালের হেলে পরা সূর্য ঝলসে দিতে চাচ্ছে চোখ, তবুও কেন যেন মিষ্টি লাগছে তাপটা। তীব্র সূর্যের আলোয় সামনের পিচঢালা রাস্তায় ছোট ছোট পাথর কণাগুলো ঝিকমিক করে উঠছে, মনে হচ্ছে হাজার হাজার মুক্ত মানিকের উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে নিচ্ছি।

দূরে মাঠের কোনায় কিছু সারি বাধা বাড়ি, মনে হলো বাড়ির চালগুলো টিনের। সামনে মাঝামাঝি গড়নের একটা পুকুর। পুকুরের নিস্তরঙ্গ জলে গাঢ় নীল রঙের আকাশটা পূর্ণ প্রতিফলন হচ্ছে। মনে হল কেউ একজন এক টুকরো আকাশ কাঁচি দিয়ে কেটে মাঠের ভিতর বসিয়ে দিয়েছে। এতক্ষণে খেয়াল হলো আকাশটা নীল, ভয়াবহ নীল, কোথাও কোনো মেঘ নেই। মনে পরল, এইখানে ফল শুরু হয়ে গেছে, রুরাল অ্যালাব্যামার ফল!

গাড়ির ভেতরের বাতাসটা কেন যেন অনেক হালকা কিন্তু খুব চেনা একটা গন্ধে ছেয়ে গেল, কাঠ আর শুকনো পাতা পোড়া গন্ধে। মনের গহীন কোণ থেকে অনেক পুরনো কিছু সুখ মাখা স্মৃতি উঁকিঝুঁকি মারা শুরু করল। বাড়িগুলোকে কেন যেন দাদা বাড়ির সেই ঘরগুলোর মতো মনে হতে লাগল। পুকুরটাকে মনে হতে লাগল দাদার সেই পুকুরটার মতো।  কেমন যেন একটা আচ্ছন্নের মধ্যে চলে গেলাম। গাড়ি চালাতে চালাতেই রাস্তার অন্য পাশে দেখতে পেলাম একটা ঘর, পাশে কিছু চেরাই করা কাঠ, ঠিক দাদা বাড়ির সামনে থাকা স-মিলটার মতো। শীতের এই গ্রাম্য অ্যালাব্যামাকে অনেক আপন মনে হতে লাগল, যেন কত দিনের কত যুগের চেনা জানা। ঠিক দাদা বাড়ির গ্রামের মতন।

হুট করেই সব লজিক আর যুক্তি এলোমেলো করে দিয়ে মাথার ভেতর কেউ একজন বলে উঠল-‘এই খোকা, দাদা বাড়ি যাবি না’।

লেখক: আমেরিকা প্রবাসী