দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম প্রবেশ দ্বার হিসেবে পরিচিত দৌলতদিয়া ফেরিঘাট অযন্ত্র-অবহেলায় জরাজীন্ন অবস্থায় রয়েছে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই নৌরুটের সাতটি ঘাটের মধ্যে চারটি ঘাটই দীর্ঘদিন ধরে অকেজো অবস্থায় পরে আছে। এছাড়াও বন্ধ রয়েছে বিআইডব্লিউটিসি নিয়ন্ত্রাণাধীন ওয়েট স্কেল মেশিন। অনুমানের উপর নির্ভর করে দেওয়া হচ্ছে ওজনের টোকেন। এতে নানাভাবে অসাধু সুবিধা নিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
গতকাল বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার (২৩ ডিসেম্বর) দৌলতদিয়া ফেরি ঘাট ও গোয়ালন্দ উপজেলায় অবস্থিত ওয়েট স্কেল এলাকা ঘুরে এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এতথ্য জানা গেছে।
দৌলতদিয়া পাড়ে রয়েছে বিআইডব্লিউটিসির সাতটি ফেরি ঘাট। এর মধ্যে ১ ও ২ নম্বর ঘাট শুরু হওয়ার পর থেকে অকেজো হয়ে পরে আছে। নদী ভাঙনের কবলে পরে ৫ নম্বর ঘাটটিও অর্ধেক অংশ নদী গর্ভে চলে যায়। সেই থেকে বন্ধ রয়েছে এই ঘাটটিও। যা আজও পর্যন্ত মেরামত করা হয়নি। শুকনো মৌসুম শুরু হওয়ার কারণে ৬ নম্বর ফেরি ঘাট অকেজো হয়ে পরে আছে। ৩ ও ৪ নম্বর ফেরি ঘাট জরাজীন্ন অবস্থায় কোনো মতে সচল রয়েছে। শুধুমাত্র ৭ নম্বর ফেরি ঘাট দিয়ে যানবাহন স্বাভাবিকভাবে নদী পারাপার করছে।
এদিকে দৌলতদিয়া ফেরি ঘাটের জিরো পয়েন্ট থেকে ৭কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বিআইডব্লিউটিসি’র ওয়েট স্কেল মেশিন বন্ধ রয়েছে গত তিনদিন ধরে। অনুমানের উপর নির্ভর করে মালবাহী ট্রাকের সিরিয়াল কোটেন দেওয়া হয় এখান থেকে।
বিআইডব্লিউটিসি নিয়ম অনুসারে অতিরিক্ত মালবাহী প্রতিটি ট্রাক থেকে টন প্রতি ১২০ টাকা নেওয়া হয় টিকিটের মূল্যের সঙ্গে। কিন্তু ওয়েট স্কেল মেশিন বিকল থাকার কারণে অনুমানের উপর সিরিয়াল টোকেন দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে দেখা যাচ্ছে ট্রাক চালকরা কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে সুবিধা নিচ্ছেন। এখানে কর্মকর্তারা ৩০ টনের মালবাহী ট্রাক করে দিচ্ছেন ২২টন। আবার ১৮/২০ টনের মালবাহী ট্রাক হয়ে যাচ্ছে ২৫ টনের বেশি বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ট্রাক শ্রমিক সংগঠনের নেতা মো. আতিয়ার রহমান বলেন, ‘পদ্মা সেতু শুরু হওয়ার পর থেকে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে রয়েছে অবহেলায়। দৌলতদিয়া পারের ৭টি ঘাটের মধ্যে ৪টি ঘাট দীর্ঘদিন ধরে অচল অবস্থায় রয়েছে। ওয়েট স্কেল থাকে মাসের বেশির ভাগ সময় বিকল। কর্মকর্তারা টাকার বিনিময়ে ট্রাকের ওজন হেরফের করেন। দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে সেবার মান উন্নয়ন হলে অবশ্যই যানবাহন বৃদ্ধি পাবে। কারণ পদ্মা সেতু শুরু হওয়ার পর থেকে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ঘাটে চিরচেনা যানজট ও দুর্ভোগ নেই। সুতরাং সুবিধা পেলে যানবাহনের চালক ও যাত্রীরা এই নৌরুট ব্যবহার করে নদী পারাপার করবেন।’
একাধিক ট্রাক চালক বলেন, দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ঘাটে যানজটের দুর্ভোগ কমলেও সেবার মান বাড়েনি। বরং ফেরির টিকিট কাটার সময় অতিরিক্ত টাকা দেওয়া লাগে। বিভিন্ন অজুহাতে এই টাকা আদায় করা হয়। এই নৌরুটের হারানো জৌলস ফিরিয়ে আনতে হলে অবশ্যই সেবার মান উন্নয়ন করতে হবে। একই সঙ্গে কারণে-অকারণে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া বন্ধ করতে হবে।
ফরিদপুর থেকে মানিকগঞ্জগামী রাজ্জাক নামের এক যাত্রী বলেন, ‘দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটের উভয় ঘাটে অকারণে সময় নষ্ট হয়। ঘাট সংকটে ফেরিগুলো সময় মত ঘাটে আসতে পারে না।’
তিনি বলেন, ‘অবহেলার কারণে শুধু দৌলতদিয়ায় চারটি ফেরি ঘাট কোনো কাজে আসছে না দীর্ঘদিন ধরে।’
ঘাটের বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত মো. জিয়া বলেন, ‘দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ফেরি ঘাটে যানবাহন কমে গেছে ৬০/৭০ শতাংশ। আগের মতো গাড়ি আসে না। ঘাটের উভয় পাশে অবস্থিত শতশত দোকান বন্ধ হয়ে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঘাটের জৌলস ফিরে পেতে হলে ঘাট সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভূমিকা রাখতে হবে। সেবার মান বৃদ্ধি করতে হবে। লোকাল যাত্রীদের দুর্ভোগ বন্ধ করতে হবে।’
বাংলাদেশ অভ্যান্তরীন নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সহকারী প্রকৌশলী শাহ আলম বলেন, ‘শুকনো মৌসুমের কারণে দৌলতদিয়া পারে ১,২ ও ৬ নম্বর ফেরি ঘাট বন্ধ রয়েছে। ৫ নম্বর ফেরি ঘাটের অর্ধেক অংশ নদী গর্ভে চলে গেছে। ঘাটটি এখন মেরামত করতে গেলে সড়কের কিছু অংশ কাঁটতে হবে। যে কারণে মেরামত করা সম্ভব হচ্ছে না। বর্ষা মৌসুমে প্রতিটি ঘাট সচল রাখা সম্ভব হবে।’
বিআইডব্লিউটিসি দৌলতদিয়া ঘাট শাখার ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন বলেন, ‘দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে এখন কোন সমস্যা নেই। যানবাহনগুলো এসেই সহজে ফেরি পারাপার হতে পারে। তবে মাঝে মধ্যে ঘন কুয়াশার কারণে এই নৌরুটে ফেরি চলাচল সাময়িক ভাবে বন্ধ রাখা হয়। তাছাড়া কোন সমস্যা নেই।’
অকেজো ঘাট গুলোর কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দৌলতদিয়া পারে প্রয়োজনীয় ঘাট ও ফেরি রয়েছে। যে কারণে যাত্রী ও চালকদের সেবা দিতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না।’
মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন ওয়েট স্কেল মেশিন সম্পর্কে বলেন, ‘ইন্টারনেট না থাকলে ও হঠাৎ করে মেশিন বিকল হলে অনুমানের ওপর আমাদের কাজ করতে হয়। প্রত্যেক ট্রাকের সঙ্গে চালান থাকে সেটি দেখেও ট্রাকের ওজন নির্ধারন করা হয়। এরপরও যদি কোনো অভিযোগ পাওয়া যায় তাহলে বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বিআইডব্লিউটিসি উপ-মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) শাহ মো. খালেদ নেওয়াজ বলেন, ‘পদ্মা সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল শুরু করার পর থেকে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে ৬০/৬৫ শতাংশ যানবাহন কমে গেছে। যে কারণে দৌলতদিয়া পাটুরিয়া নৌরুটের গুরুত্ব অনেকটা কমে গেছে। এই নৌরুটে রয়েছে অসংখ্য ফেরি। বর্তমানে যানবাহন সহজে এই নৌরুট পার হয়ে গৌন্তব্যস্থানে যেতে পারছে।’