‘পথে পথে চলতে চলতে হঠাৎ একদিন থেমে যাব, মেঘলা রাতে লুকিয়ে থেকে রুপোর আলোয় জোছনা পাব।’- শ্রীকান্তের গাওয়া গানের মতোই চলতে চলতে শেষ হয়েছে তাদের শিক্ষাজীবন।
জীবনের মূল্যবান একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি শেষে পরিবার, সমাজ, দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা বারংবার ভাবাচ্ছে তাদের। জীবনের রঙিন আকাশে ভর করেছে এক ফালি কালো মেঘ। সেই মেঘ কাটিয়ে জোছনার সন্ধান পেতে ছাড়তে হবে তাদের একান্ত প্রিয় স্থান। তাইতো প্রিয় আবাসস্থলের শেষ দিনের স্মৃতি হৃদয়ের ফ্রেমে স্মরণীয় করে রাখতে আনন্দে উচ্ছ্বাসে আয়োজন করা হয় সমন্বিত হল সমাপনীর। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭টি হলের আবাসিক-অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিদায় জানানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৬-১৭ সেশেনের দুই হাজারের অধিক শিক্ষার্থী এতে অংশগ্রহণ করে।
কুয়াশা ভরা শীতের শুভ্র সকালে আকাশে রক্তিম সূর্য উঁকি দিয়েছে। আস্তে আস্তে সে আলোয় আলোকিত চারপাশ। সকাল ১০টা থেকেই বিভিন্ন হলের ব্যানারে শোভাযাত্রা নিয়ে সাউন্ড বক্স বাজিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ কামাল স্টেডিয়ামে আসতে থাকে বিদায়ী শিক্ষার্থীরা। একেক হলের শিক্ষার্থীদের পরনে আলাদা আলাদা রঙ-বেরঙের জামা, হাতে বাঁশি। মেয়েরা এসেছে লাল, গোলাপী শাড়ি পরে। পুরো স্টেডিয়াম জুড়ে যেন বইছে উৎসবের হাওয়া।
গানের তালে চলতে থাকে কালার ফেস্ট পর্ব। এরপর শুরু হয় রং মাখামাখি। হাতের আলতো ছোঁয়ায় লাল, হলুদ, সবুজ, নীলসহ নানা রঙের আবিরের রঙে রাঙিয়ে দেয় একে অপরকে। সঙ্গে হৈ-হুল্লোড় আর বক্সে ডিজে গানের সঙ্গে নাচানাচি। তাদের পরনে থাকা টি-শার্টে একে অপরে মনের অগোছালো কথাগুলো রঙিন কালি দিয়ে লিখতে থাকে। টি-শার্টে অব্যক্ত অনুভূতি আর ভালোবাসা মাখা উক্তিতে ভরে ওঠে। যেন সেগুলো এই ভালোবাসা বন্ধনের প্রতীক।
এরপর বেলা ১১টায় ভিসি অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার বেলুন ফেস্টুন উড়িয়ে অনুষ্ঠানের শুভ উদ্বোধন করেন। এ সময় তিনি বলেন, এই আয়োজনকে আমি সমাপনী বলবো না, এটা সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। তোমরা পড়াশোনা শেষ করেছো এখন একটি বৃহত্তর অঙ্গণে প্রবেশ করবে। তোমরা প্রাক্তনী হয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কাজ করবে। তোমাদের প্রতি দ্বৈত দায়িত্ব রয়েছে। একটি হলো সমাজ ও পরিবারের প্রতি অন্যটি হলো তোমাদের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বভোধ ও একে অপরেরে প্রতি যে বোঝাপড়া সেটা আরো বৃদ্ধি পাবে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে ১৭টি হলের অংশগ্রহণে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করা হয়। শোভাযাত্রাটি ক্যাম্পাসের প্রধান সড়কগুলো প্রদক্ষিণ করে সাবাশ বাংলাদেশ চত্বরে এসে শেষ হয়। শোভাযাত্রায় গানের তালে নেচে গেয়ে নিজেদের সুপ্ত প্রতিভার জানান দেয় শিক্ষার্থীরা। ফটোসেশন আর স্মৃতির অ্যালবামে নিজেদের ফ্রেমবন্দি করে।
উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে এগ্রোনমি অ্যান্ড এগ্রিকালচার এক্সটেনশন বিভাগের শিক্ষার্থী চৈতি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এটাই আমাদের শেষ প্রাপ্তি। পাঁচ বছর শিক্ষাজীবন শেষে এ স্বীকৃতি আমাদের কাছে খুবই আনন্দের। হল আমাদের দ্বিতীয় বাসা। এ বাসা ছেড়ে চলে যাওয়া আসলেই অনেক কষ্টের। তবুও চলে যেতে হবে। আবারও ফিরে আসবো আমাদের ভালোবাসার এ মতিহারে।
সংস্কৃত বিভাগের শিক্ষার্থী তাসনিম বলেন, আজকের দিনটার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমাদের ১৭ হলের বন্ধুবান্ধব মিলে একত্রিত হতে পেরে খুবই ভালো লেগেছে। বিদায় তো নিতেই হবে আজ আমরা নিচ্ছি কাল আমাদের জুনিয়ররা নিবে। কারণ অন্যকে জায়গা করে দিয়ে বিদায় নেওয়াই মানবধর্ম। তবে সবসময় স্মৃতির পাতায় থাকবে মতিহারের সবুজ চত্বর।
এত উচ্ছ্বাসের মধ্যেও কারো কারো মনে বাজছে বিষাদের সুর। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আবু হুরাইরা বলেন, বন্ধুদের সঙ্গে কতশত আড্ডা, স্মৃতি জমে আছে ক্যাম্পাসে। সবকিছু ত্যাগ করে সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে হবে। হল সমাপনী আমাদের কাছে কষ্টের দিন হলেও আমরা আনন্দ করছি। বন্ধুদের ছেড়ে চলে যাওয়া আসলেই কষ্টের। কিন্তু নতুনদের সুযোগ দিয়ে আমাদের যেতেই হবে।
এরপর বিকাল ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবাশ বাংলাদেশ মাঠে আলোচনা সভা, বিদায়ী শিক্ষার্থীদের ক্রেস্ট বিতরণ, মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও নৈশভোজের আয়োজন করা হয়। নাচ গানের আড়ালে বিদায়ী শিক্ষার্থীদের মনে ভাসে রবি ঠাকুরের কবিতা- ‘রাত্রি যবে হবে অন্ধকার, বাতায়নে বসিয়ো তোমার। সব ছেড়ে যাব প্রিয়ে, সমুখের পথ দিয়ে ফিরে দেখা হবে না তো আর।’
লেখক: শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়