সারা বাংলা

থামছে না লালমাইয়ে পাহাড় কাটা, প্রশাসন নীরব 

কুমিল্লার ঐতিহ্য বলতেই নাম চলে আসে লালমাই পাহাড়ের। কুমিল্লা সদর দক্ষিণ আশপাশের উপজেলা জুড়ে এই পাহাড়টির অবস্থান। কিন্তু বর্তমানে ছোট বড় ১০টি পাহাড় ঘিরে ৪০ পয়েন্টে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে মাটিদস্যু চক্র। কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না তাদের পাহাড় কাটা থেকে। এদের হাতে লালমাই পাহাড় এখন ক্ষতবিক্ষত। এছাড়া এ পাহাড়ে থাকা বেশকিছু প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন এখন ক্ষতির মুখে।

কিছু অসাধু স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নিজস্ব ফায়দা লুটতে পাহাড়ের মাটি কেটে বিক্রি করছেন বলে অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের। আবার অনেকেই ব্যক্তিগত রিসোর্ট তৈরি করছেন পাহাড়টিতে। এ নিয়ে স্থানীয় লোকজনের মধ্যে ক্ষোভ থাকলেও প্রভাবশালীদের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পারছেন না। 

জেলা প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এই পাহাড়ের দৈর্ঘ্য ৮ কিলোমিটার, অংশভেদে গড় প্রস্থ প্রায় ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার এবং সর্বোচ্চ উচ্চতা ৪৬ মিটার। পাহাড়কে দ্বিখণ্ডিত করে যাওয়া ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দক্ষিণাংশ লালমাই ও উত্তরাংশ ময়নামতি পাহাড় নামে পরিচিত। উঁচু-নিচু দুইটি পাহাড়ে জেলার আদর্শ সদর, সদর দক্ষিণ, লালমাই, বরুড়া ও বুড়িচং উপজেলার অংশবিশেষ রয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, অর্থমন্ত্রী লোটাস কামালের ভাতিজা পরিচয়দানকারী মোস্তফা উদ্দিন লিটনের নেতৃত্বে মূলত লালমাই পাহাড়ের মাটি কাটা শুরু হয়েছে। লিটনের জেলায় একাধিক ইটভাটা রয়েছে। মূলত সদর দক্ষিণ ও লালমাই উপজেলায় তার নাম ব্যবহার করে পাহাড় থেকে স্কেভেটর দিয়ে মাটি কেটে বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করা হচ্ছে। এছাড়াও এই পাহাড়ের মাটির একাংশ যায় লিটনের ইট ভাটায়। প্রকাশ্যে পাহাড় কেটে সাবাড় করে ফেললেও প্রশাসন এ ব্যাপারে নীরব ভূমিকা পালন করছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত মোস্তফা উদ্দিন লিটন বলেন, ‘আমি পাহাড় থেকে মাটি কাটি না, আমার নামে মিথ্যা কথা বলছেন যারা মাটি কাটেন তারা।’

লালমাই পাহাড়ের অনেক স্থানে মাটি কেটে করা হয়েছে সমতল। কোথাও কোথাও পাহাড়ের বুক চিরে সমতল করা জায়গায় স্থানীয়ভাবে সীমানা প্রাচীর তৈরি করা হচ্ছে। আবার পাহাড়ের মাটি কাটার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে অধ্যাধুনিক ভেকু মেশিন। যার মাধ্যমে দ্রুততার সঙ্গে পাহাড় থেকে মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে। বিগত সময়ে রেলপথ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থানীয় ক্যাম্পাস, চার লেনের মহাসড়কসহ অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সড়ক উন্নয়নের প্রয়োজনে ক্ষত বিক্ষত করা হয়েছে এই পাহাড়।

উত্তর লক্ষ্মীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে মাটি কাটার ফলে ওইসব এলাকা এখন সমতল ভূমিতে পরিণত হয়েছে। মাটিকাটা সিন্ডিকেট এখন চারপাশে টিনের বেড়া দিয়ে নতুন নতুন কৌশলে পাহাড় কাটছে। মাটি কাটার পুরাতন ও নতুন ক্ষতচিহ্ন ছড়িয়ে রয়েছে পাহাড়জুড়ে।

গত শনিবার দিনভর সরেজমিন ঘুরে যায়, লালমাই-ময়নামতি পাহাড়ের লীলামুড়া, বড় ধর্মপুর, চন্ডিপুর, রতনপুর, হরষপুর, রাজারখল, সালমানপুর, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকা, সানন্দা, জামমুড়া, রাঙ্গামুড়া, ষাইট কলোনী, খলা, ধনমুড়া বিশাল পাহাড়ের অংশ থেকে বছরের পর বছর ধরে মাটি কাটা হচ্ছে। 

লালমাই পাহাড়ের সদর দক্ষিণ উপজেলার বড় ধর্মপুর লেকল্যান্ডের এলাকার শতাধিক বাসিন্দা জানান, কয়েকদিন পর পর টিনের বেড়া দিয়ে দিনে-রাতে উঁচু একটি পাহাড় কাটা হচ্ছে। বিশেষ করে পাহাড়ি এলাকা উঁচু পাহাড়ের রাস্তার পাশের অংশ কৌশলে ঠিক রেখে পেছনের অংশের মাটি কেটে সমতল করা হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও পাহাড় কেটে গভীর পুকুর বানিয়ে অনেকেই করছেন মৎস্য চাষ। এছাড়াও প্রতিদিন পাহাড় কেটে তৈরি হচ্ছে বাসাবাড়ি, মোটেল, বিনোদন কেন্দ্রসহ নানা প্রতিষ্ঠান। অব্যাহতভাবে পাহাড় কাটায় প্রতিদিনই কমছে পাহাড়ের আকার। এতে নিশ্চিহ্ন হচ্ছে পাহাড়, ধ্বংস হচ্ছে পাহাড়ে থাকা মূল্যবান অনেক ফলজ, বনজ বৃক্ষ আর হারিয়ে যাচ্ছে পশু-পাখি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেকেই জানান, যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তখন সেই দলের লোকেরা পাহাড় কাটে। মাঝে মাঝে প্রশাসন থানা-পুলিশ নিয়ে লোক দেখানো অভিযান চালায়। তবে না জানা কারণে পাহাড় কাটায় নেতৃত্ব যারা দিচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি।

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পাহাড়-টিলার গুরুত্ব অতুলনীয়। ১৯৯৫ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী দেশে পাহাড় বা টিলা কাটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। পরে ২০১০ সালে আইনটি সংশোধনের মাধ্যমে আরও কঠোর করা হয়। দেখা যায়, এই আইন শুধু কেবল ফাইল-খাতায় সীমাবদ্ধ, নেই তার কোনো বাস্তব প্রতিফলন। মূলত প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে পাহাড় কাটা রোধ করা যাচ্ছে না বলেই মনে করেন স্থানীয়রা। 

কুমিল্লা পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মোসাব্বের হোসেন মুহাম্মাদ রাজীব বলেন, পাহাড় যারা কাটছেন তাদের নামের তালিকা তৈরি করেছি আমরা। স্থানীয় কয়েকজনের রাজনীতিবিদ নামও আছে তাতে। বিগত সময় পরিবেশ উপ-পরিচালকে লালমাই পাহাড় নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছিলো। তবু আমি আমার দায়িত্ব পালনে আপনাদের সহযোগিতা কামনা করছি।

কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মোহাম্মাদ শামীম আলম বলেন, প্রাকৃতিক সম্পদ পাহাড় রক্ষার জন্য প্রশাসনের পাশাপাশি সব মহলকেই সচেতন হতে হবে। পাহাড় কাটার তথ্য যখনই আসে তখনই আমরা আইনগত পদক্ষেপ নিচ্ছি। 

প্রশাসন নিরব কেনো এমন প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মাদ শামীম আলম বলেন, আমি এখন খোঁজখবর নিচ্ছি। প্রয়োজনে টিম পাঠাবো।