শিল্প ও সাহিত্য

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য : ছন্দে তার দ্রোহের শিখা

শোয়েব হোসেনসময়টাই ছিল তখন প্রতিবাদের। চারিদিকে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, শোষণ, বঞ্চনা আর নিপীড়ন। এমন একটা সময়ে জন্ম ও বেড়ে ওঠা কবি সুকান্তের।সুকান্ত ভট্টাচার্য জন্মলগ্ন থেকেই বেড়ে ওঠেন দ্রোহের আগুন নিয়ে। পৃথিবী তখন দুই ভাগে বিভক্ত- শোষক আর শোষিত। অনিবার্যভাবেই সুকান্ত শোষিতের দলে। কিশোর বয়সেই ‘ক্ষুধার’ মতো ভয়াবহ শব্দের সঙ্গে পরিচিত এই কবি ক্ষুধার্ত, নিষ্পেষিত মানুষের বন্ধু হয়ে ওঠেন। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কমিউনিস্ট আন্দোলন তখন তুঙ্গে।

এমন একটি সময়ে রবীন্দ্র-নজরুল বলয়ের ভেতরেই যখন বাংলা সাহিত্য আবর্তিত, সেই সময় অন্য এক দ্রোহের আগুন নিয়ে আবির্ভাব ঘটে কিশোর কবি সুকান্তের। স্কুলছাত্র অবস্থাতেই তিনি জড়িয়ে পড়েন কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে। মার্ক্সবাদী ধারার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কারণে মানুষের জন্য নিজেকে নিবেদনের প্রস্তুতি ছিল তার।

এই নিবেদন ছিল তার সবকিছুতে। কবিতা, শ্রম ও ঘামে। কবিতায়, কাব্যমগ্নতার মধ্যে থেকেও মানুষের ক্ষুধা আর জঠরযন্ত্রণাকে অনুভব করে তিনি নির্দ্বিধায় গদ্যের হাতুড়িকে আঁকড়ে ধরার প্রত্যয় ঘোষণা করতে পারেন মহাজীবন  কাব্যে : ‘হে মহাজীবন, আর এ কাব্য নয়/ এবার কঠিন, কঠোর গদ্যে আনো/ পদ-লালিত্য-ঝঙ্কার মুছে যাক/ গদ্যের কড়া হাতুড়িকে আজ হানো।/ প্রয়োজন নেই, কবিতার স্নিগ্ধতা-/ কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি/ ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী-গদ্যময় :/ পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’।বিশ্বময় ক্ষুধা-দারিদ্র্য, যুদ্ধ আর আর সংঘাতের জঞ্জাল সরিয়ে এই বিশ্বকে শিশুদের বাসযোগ্য করতে অনাগত শিশুর জন্য তার দৃঢ় অঙ্গীকার ফুটে ওঠে ‘ছাড়পত্র’ কবিতায়। জন্ম ও পরিবার১৯২৬ সালের ১৫ আগস্ট বাংলা সাহিত্যের ক্ষণজন্মা প্রতিভা সুকান্ত ভট্টাচার্য অবিভক্ত বাংলার পশ্চিমবঙ্গ কলকাতার ৪৩ মহিম হালদার স্ট্রিটে তার নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস ছিল ফরিদপুর জেলার (বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া থানার উনশিয়া গ্রামে)। পিতা নিবারণ ভট্টাচার্যের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী সুনীতি দেবীর দ্বিতীয় পুত্র তিনি। জেঠতুতো দিদি রাণীদি নাম রাখেন সুকান্ত, ‘রমলা’ খ্যাত সাহিত্যিক মনীন্দ্রলাল বসুর গল্প ‘সুকান্ত’র নামে।প্রতিভার বিকাশপ্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই কবি সুকান্তের লেখালেখির শুরু। স্থানীয় স্কুল কমলা প্রাথমিক বিদ্যামন্দিরে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় সহপাঠীদের নিয়ে সঞ্চয়  নামে একটি হাতে লেখা পত্রিকা বের করেন। ওই পত্রিকায় একটি হাসির গল্প লেখেন তিনি। ছোটবেলায় অভিনয়েও পারদর্শী ছিলেন সুকান্ত। স্কুলের নাটক ধ্রুব তে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। ১৯৪১ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মারা গেলে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে সুকান্ত রেডিওতে গল্পদাদুর আসর নামে এক অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করে সবার প্রশংসা লাভ করেন।কবিতার উপকরণবিশ্ব জুড়ে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজেছে। পুরো ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে একদিকে ছড়িয়ে পড়েছে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, আরেক দিকে তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ। কবি সুকান্ত এ সবকিছুকেই করে তোলেন তার কবিতার উপজীব্য।সাহিত্যকর্মকবি সুকান্ত কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা দৈনিক স্বাধীনতা র (১৯৪৫) ‘কিশোর সভা’ বিভাগ সম্পাদনা করতেন। মার্ক্সবাদী চেতনায় আস্থাশীল কবি হিসেবে সুকান্ত কবিতা লিখে বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র স্থান করে নেন। তার রচনাবলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো : ছাড়পত্র (১৯৪৭), পূর্বাভাস (১৯৫০), মিঠেকড়া (১৯৫১), অভিযান (১৯৫৩), ঘুম নেই (১৯৫৪), হরতাল (১৯৬২), গীতিগুচ্ছ (১৯৬৫) প্রভৃতি। পরবর্তীকালে উভয় বাংলা থেকে ‘সুকান্ত সমগ্র’ নামে তার রচনাবলি প্রকাশিত হয়। সুকান্ত ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পীসঙ্ঘের পক্ষে আকাল (১৯৪৪) নামে একটি কাব্যগ্রন্থ সম্পাদনা করেন।রাজনীতিতে প্রবেশসাম্যবাদে বিশ্বাসী কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ১৯৪২ সালে যোগ দেন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে। ১৯৪৪ সালে সুকান্ত ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৪৫-এর আগে তিনি বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। এরপর ১৯৪৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হন। সুকান্তের আনুষ্ঠানিক শিক্ষার অবসান হয় সেখানেই।মৃত্যুকিশোর বয়সেই অসংখ্য কবিতায় প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়ে দেওয়া এই কবির জন্ম থেকে মৃত্যুর ব্যবধান ছিল মাত্র ২১ বছরের। পার্টি ও সংগঠনের কাজে অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে দুরারোগ্য যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি ১৯৪৭ সালের ১৩ মে কলকাতায় যাদবপুর টিবি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। কবির জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছিল কলকাতার বেলেঘাটার ৩৪ হরমোহন ঘোষ লেনের বাড়িতে। সেই বাড়িটি এখনো অক্ষত আছে। পাশের বাড়িটিতে এখনো বসবাস করেন সুকান্ত ভট্টাচার্য়ের একমাত্র জীবিত ভাই বিভাস ভট্টাচার্য। পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাতুষ্পুত্র।তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া।

লেখক : রাইজিংবিডির জামালপুর প্রতিনিধি।রাইজিংবিডি/১৩ মে ২০১৪/রাশেদ শাওন/কমল কর্মকার