আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় অটোমেশন চান ব্যবসায়ীরা। তাতে কর প্রদান প্রক্রিয়া সহজ হবে। বাড়বে রাজস্ব আহরনের পরিমাণ।
বুধবার (২২ মার্চ) বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘প্রাক-বাজেট আলোচনা ২০২৩-২৪ : বেসরকারি খাতের প্রত্যাশা’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়িদের সঙ্গে একমত পোষন করেছেন সভার প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। তিনি বলেন, রাজস্ব ব্যবস্থায় অটোমেশনের দাবির পক্ষে আমি একমত তবে সবাইকে কর দিতে হবে।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি ব্যারিস্টার মো. সামীর সাত্তারের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম এবং এফবিসিআই’র সাবেক সভাপতি ও সংসদ সদস্য মো. শফিউল ইসলাম (মহিউদ্দিন)।
এছাড়া সম্মানিত অতিথি ছিলেন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন, সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ। অনুষ্ঠানে আয়কর ও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), আর্থিক খাত, শিল্প ও বাণিজ্য এবং অবকাঠামো খাত এই চারটি বিষয়ে আলোচনা করা হয়।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে সালমান এফ রহমান বলেন, আমাদের অর্থনীতি ভালোই চলছিল। এর মধ্যে প্রথমে আসলো কোভিড-১৯। আমরা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে কোভিড ভালোভাবেই মোকাবিলা করতে পেরেছি। এরপরই শুরু হলো ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। এর কিছু প্রভাব আমাদের মধ্যে পড়েছে। প্রথমতো যেটি হলো ফেডারেল রিজার্ভ ইন্টারেস্ট রেট বাড়ালো। তাতে সারা বিশ্বে ডলার শক্তিশালী হতে শুরু করলো। ডলার শক্তিশালী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের টাকার মান কমতে শুরু হলো। বড় ধরনের প্রভাব পড়লো আমদানির ওপর। তাতে রিজার্ভে চাপ পড়ল। এরপরেই বিশ্ববাজারে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি আমাদের অর্থনীতে আরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
তিনি বলেন, উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার আমদানি কার্যক্রমে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করে রিজার্ভেও উপর চাপ কমানো হয়েছে। একই সঙ্গে আমাদের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন এক ইঞ্চি মাটিও যেন পতিত না থাকে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর কৃষি জমির ব্যবহার বাড়লো। তাতে এবার আমাদের সরিষার বাম্পার ফলন হয়েছে। তাতে এডিবল অয়েলের ৫০ শতাংশ যোগান দেবে আমাদের দেশের সরিষা।
তিনি বলেন, আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা এবং আইএমএফ ঋণ দেওয়ার পর রিজার্ভ স্বাভাবিক হতে শুরু করল। আশা করছি আগামী জুনে এলসি ও ডলার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। তাতে রিজার্ভ আরও বাড়বে।
উপদেষ্টা বলেন, দেশের রাজস্ব ব্যবস্থায় অটোমেশনের আওতায় নিয়ে আসার বিষয়ে আমি একমত। তাতের কর প্রদান প্রক্রিয়া সহজ হবে। একই সঙ্গে করের আওতা বাড়ানোর বিকল্প নেই, ব্যবসায়ীদের কর প্রদানের মানসিকতা বাড়ানোর আহ্বান জানান তিনি।
সালমান এফ রহমান বলেন, তৈরি পোষাক খাতের ন্যায় কৃষি, চামড়া, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং সহ অন্যান্য সম্ভাবনাময় খাত সমূহে যথাযথ আর্থিক ও নীতি সহায়তা প্রদান করা প্রয়োজন। এছাড়াও তিনি বিদেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি স্থানীয় বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তাব করেন।
শেয়ারবাজার সম্পর্কে সালমান এফ রহমান বলেন, আমাদের ক্যাপিটাল মার্কেটের স্ট্রাকচারাল ডিফেক্ট রয়ে গেছে। আমরা অনেকেই অনেক কথা বলি, কিন্তু এসব সমাধানে যেসব কাজ করা দরকার আমরা তা করছি না।
তিনি বলেন, আমি অ্যানালাইসিস করে দেখেছি আমাদের মার্কেটে দৈনিক লেনদেনের ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ হচ্ছে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের। আর ৫ থেকে ১০ শতাংশ হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী। আইসিবি টোটালি ইনঅ্যাকটিভ, এছাড়া সিটি ব্যাংক ও অন্যান্য বিনিয়োগকারী ব্যাংক রয়েছে তারা দৈনিক লেনদেনের ৫ শতাংশ অংশগ্রহণ করছে। মূল সমস্যাটা এই জায়গাতেই। অথচ অন্যান্য দেশের ফ্রন্টিয়ার মার্কেটে দৈনিক লেনদেনে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ থাকে ৯০ শতাংশ আর ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী থাকে ১০ শতাংশ।
স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি ব্যারিস্টার মো. সামীর সাত্তার বলেন, লিস্টেড এবং নন-লিস্টেড কোম্পানির মধ্যে কর হারের ব্যবধান কমানোর পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে ব্যবসাকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে নন-লিস্টেড কোম্পানির কর্পোরেট করের হার আরও ২.৫ শতাংশ কমাতে হবে। এছাড়াও কর প্রদান প্রক্রিয়া সহজ করতে, কর ও মূসক সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় সংষ্কারসহ ব্যবসাবান্ধব অটোমেটেড কর ব্যবস্থাপনা প্রবর্তনের প্রস্তাব করেন তিনি।
খেলাপী ঋণ হ্রাসের লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদী রোডম্যাপ প্রণয়নের পাশাপাশি এডিআরের প্রয়োগ, অর্থঋণ ও ব্যাংকিং কোম্পানি আইনের সংস্কার, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বাড়াতে সরকারি খাতে ব্যয় হ্রাস এবং মূল্যস্ফীতির সাথে সঙ্গতি রেখে আমানতের সুদহার ও ঋণের সুদের হার নির্ধারণের প্রস্তাব করেন ডিসিসিআই সভাপতি।
বিশেষ অতিথি পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী সালমান এফ রহমান বলেন, আগামী বাজাটে মূল্যস্ফীতি সহনীয় মাত্রায় রাখা, প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি, বিনিয়োগ উৎসাহিতকরণ এবং সরকারের ঋণ গ্রহণের প্রবনতা হ্রাস প্রভৃতি বিষয়সমূহের উপর অধিক গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, বৈশ্বিক ও স্থানীয় পরিস্থিতি বিবেচনায় আমাদের উচ্চাভীলাষী বাজেট প্রণয়নের সুযোগ নেই, তবে জনগণের খাদ্য নিোপত্তা নিশ্চিত করতে বিষয়টিকে সরকার প্রাধান্য দিচ্ছে।
সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, বাজেট প্রণয়নে বৈশ্বিক পরিস্থিতি, এলডিসি উত্তোরণ, স্থানীয় অবকাঠামোর উন্নয়ন, রপ্তানি বহুমুখীকরণ প্রভৃতি বিষয়গুলোকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা প্রয়োজন। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আমাদের বেসরকারি খাতের সক্ষমতা প্রতিনিয়ত হ্রাস পাচ্ছে এবং বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে কারণ উদ্যোক্তারা সক্ষমতা হারালে সার্বিক অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশে ব্যবসা সহায়ক পরিবেশ উন্নয়নে তিনি লাল ফিতার দৌরাত্য কমানোর উপর জোরারোপ করেন। পাশাপাশি ব্যাকওয়ার্ড লিংকে শিল্পের উন্নয়নে সহায়ক নীতিমালা প্রণয়নের প্রস্তাব করেন তিনি।
এফবিসিসিআই’র সাবেক এ কে আজাদ বলেন, সম্প্রতি সময়ে গ্যাস, বিদ্যুৎ সহ অন্যান্য জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি আমাদের বেসরকারি খাতকে বেশ প্রতিযোগিতার মুখোমুখি করেছে। এমতাবস্থায় আন্তর্জাতিক বাজার জ্বালানির মূল্য হ্রাস পেলে স্থানীয়ভাবে তা সমন্বয় করা প্রয়োজন। সেই সাথে ব্যাংকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পের উন্নয়ন এবং ম্যান-মেইড ফাইবার-এর ব্যবহার বাড়ানোরও প্রস্তাব করেন তিনি।