রাইজিংবিডি স্পেশাল

মোখা’র চোখ রাঙানি, উপকূলে আতঙ্ক

বাংলাদেশের উপকূলে বয়ে যাওয়া সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় আম্ফানইয়াস-এর ক্ষত উস্কে দিয়ে উপকূলের পথে এগোচ্ছে ঘূর্ণিঝড় মোখা। যদিও নিম্নচাপটি এখনো ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়নি। তবুও ভয় বাড়ছে উপকূলে। এখনও উপকূলের আকাশ পরিষ্কার দেখালেও নিম্নচাপের প্রভাবে ক্রমেই ফুঁসছে সমুদ্র। মাছধরার নৌকাগুলো সতর্ক, অনেকে তীরে ফিরছে। ঝড়ের গতিপথ এবং ভয়াবহতার খবর মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। তবে এখনও অনেকের কাছেই পরিষ্কার নয় ঘূর্ণিঝড়ের বার্তা। মোখা’র গতি কতটা শক্তিশালী হবে; তা এখনও পর্যন্ত বোঝা না গেলেও চোখ রাঙিয়ে ঘূর্ণিঝড়টি এগিয়ে আসছে উপকূলের দিকে। বাংলাদেশ অথবা মায়ানমার, আঘাত যেখানেই লাগুক না কেন, এবারও উপকূলে লাগতে পারে বড় ঝাপটা।

আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, দক্ষিণপূর্ব বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন দক্ষিণ আন্দামান সাগর এলাকায় অবস্থানরত সুস্পষ্ট লঘুচাপটি ঘণীভূত হয়ে দক্ষিণপূর্ব বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। নিম্নচাপটি আরও ঘণীভূত হয়ে প্রথমে বৃহস্পতিবার (১১ মে) পর্যন্ত উত্তর-উত্তরপশ্চিম দিকে এবং পরে দিক পরিবর্তন করে উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হতে পারে। দেশের চার সমুদ্র বন্দরে ইতোমধ্যে দেখানো হয়েছে ১ নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সংকেত।

কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়ক পিএইচডি গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ তাঁর ফেসবুকে জানান, ঘূর্ণিঝড় মোখা ঘণ্টায় প্রায় ২০০ কিলোমিটার বেগে স্থল ভাগে আঘাত করার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ঘূর্ণিঝড় মোখা’র স্থল ভাগে আঘাতের স্থানটি নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। ঘূর্ণিঝড়টি মায়ানমারের দিকে কিংবা বরিশাল বিভাগের দিকে সামান্য পরিমাণ ঝুঁকে পড়তে পারে। অর্থাৎ ঘূর্ণিঝড়টি চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলা অতিক্রম করার কিছু আশঙ্কা রয়েছে। একইভাবে ঘূর্ণিঝড়টি কিছুটা ডান দিকে সরে গিয়ে কক্সবাজার ও মায়ানমারে রাখাইন রাজ্যের মংডু জেলার ওপর দিয়ে স্থল ভাগে আঘাত করারও কিছুটা আশঙ্কা রয়েছে। 

প্রাকৃতিক বিপদগুলো উপকূলের দ্বীপের মানুষের জন্য নিয়ে আসে অনিশ্চয়তা 

ঘূর্ণিঝড় মোখা চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার উপকূলের ওপর দিয়ে অতিক্রম করলে ১৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বরিশাল বিভাগের উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ৭ থেকে ১০ ফুট ও খুলনা বিভাগের উপকূলীয় জেলাগুলো ৫ থেকে ৮ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। গোটা উপকূলেই জলোচ্ছ্বাসের ভয় আছে এবং তাতে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন উপকূলের বিভিন্ন এলাকার মানুষ। আতঙ্ক রয়েছে সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার মানুষের মনে। তারা বারবার ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে বিপন্ন। মাত্র দশ দিন পরে ২০ মে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের তিন বছর পূর্ন হতে যাচ্ছে। মাত্র দুই সপ্তাহ পরে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস-এর দুই বছর পূর্ন হবে। ঘূর্ণিঝড় আম্ফান এবং ইয়াস দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের ব্যাপক ক্ষতি করেছিল। ওই অঞ্চলের নাজুক বেড়িবাঁধ তাদের সেই ভয় আরও বাড়িয়ে তুলেছে। ঘূর্ণিঝড় নিয়ে ভয় আছে উপকূলের অন্যান্য এলাকার মানুষের মধ্যেও।   

ঘূর্ণিঝড় মোখা কোথায়, কতটা শক্তি নিয়ে আঘাত করবে, এখনও তা বলার সময় আসেনি। তবে এখন পর্যন্ত গতি প্রকৃতি দেখে মনে হচ্ছে ঘূর্ণিঝড়টি অনেক শক্তিশালী হতে পারে। গতি ১৮০-২০০ কিলোমিটারে পৌঁছাতে পারে। তবে মোখা’র ল্যান্ডফলে এখনো অনেক সময় বাকি। এই সময়ে গতি কতটা শক্তিশালী থাকবে, তা এখনো বলা যাচ্ছে না। ঘূর্ণিঝড়ের সঠিক বার্তা পাওয়া, বিপন্ন এলাকার মানুষদের ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান, বিপন্ন এলাকার মানুষের মধ্যে পরিবার ও কমিউনিটি পর্যায়ে প্রস্তুতির ক্ষেত্রে অনেক ঘাটতি আছে। এই ঘাটতিগুলো পূরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া দরকার বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।      

২০২০ সালে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান আঘাত করেছিল বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে। পরের বছর ২০২১ সালে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসও এসেছিল একই পথে। তবে আম্ফানের চেয়ে ইয়াস-এর ক্ষতি ছিল কিছুটা কম। এর আগে ২০১৯ সালে একই বছর ঘূর্ণিঝড় ফণী আর বুলবুল আঘাত করেছিল দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে। চব্বিশ বছর আগে ২০০৯ সালে আইলাও আঘাত করেছিল সুন্দরবন এলাকায়। যদিও এবারে মোখা’র গতি এখন অবধি চট্টগ্রাম কক্সবাজারের দিকে। কিন্তু বাঁক নিয়ে গতি উত্তর-পশ্চিমে অগ্রসর হলেএবারও দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ভয় আছে। নাজুক বেড়িবাঁধের কারণে ওই অঞ্চলে ভয় বেশি।  

ঘূর্ণিঝড় মোখা’র সতর্কতায় উপকূলজুড়ে প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি প্রস্তুতিমূলক বৈঠক করেছে। কিন্তু মাঠের অবস্থা কী? জানতে চেয়েছিলাম উপকূলের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের কাছে। তারা বলেন, ঘূর্ণিঝড় আসার খবরেই আমরা নড়েচড়ে বসি। আসার আগে তড়িঘড়ি করে সব কাজ করার চেষ্টা করি। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় চলে গেলে আর কিছু মনে থাকে না। উপর মহল আমাদের কাছে জরুরি আদেশ পাঠিয়েই খালাস। বাজেট বরাদ্দ আসবে কি না খবর থাকে না। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির পরে অনেক কাজ হয়, অনেক আশ্বাসও দেওয়া হয়, অনেক পরিকল্পনা নেওয়া হয়। কিন্তু টেকসই উদ্যোগ নেওয়া হয় খুব কম। 

ঘূর্ণিঝড় আসার খবর এলেই নজর পড়ে উপকূলের প্রস্তুতির দিকে। পূর্ব থেকে পশ্চিম উপকূলের অনেক স্থানেই প্রস্তুতির ক্ষেত্রে নড়বড়ে অবস্থা রয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে। পশ্চিম উপকূলের সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর, আশাশুনি, দেবহাটার অনেক স্থান নাজুক অবস্থা রয়েছে। শ্যামনগর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধে সংস্কারের কাজ চললেও বেশ কিছু স্থান এখনো মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। অনেক স্থানে দায়সারাভাবে বেড়িবাঁধ সংস্কার করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ড দাবি করেছে, নাজুক বেড়িবাঁধগুলো সংস্কার করা হয়েছে। শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের বেশ কিছু স্থানের বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। গাবুরা ইউনিয়নের হরিশখালী, পারশেমারী, গাবুরা, চকবারা, লেবুবুনিয়া গ্রামগুলো এখনো ঝুঁকির মুখে আছে। 

সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার খোলপেটুয়া নদীর জোয়ারের চাপে বছরে বেশ কয়েকবার ভেঙে যায় বাঁধ। ভাসে গ্রামের পর গ্রাম। অনেক মানুষ এলাকা থেকে অন্যত্র চলে গেছে। বাঁধ সংস্কার কিংবা নতুন বাঁধ নির্মাণে উদ্যোগ নেই। ২০০৯ সালের আইলা সে এলাকার বাঁধও নড়বড়ে করে দিয়েছিল। ফণির পরে আশ্বাস পাওয়া গিয়েছিল বাঁধ হবে। কিন্তু হয়নি। আম্ফানের পরে বহু মানুষ প্রায় দশ মাস জোয়ারের পানির সাথে বসবাস করেছে। আম্ফানের পরে আশাশুনির বিভিন্ন এলাকায় কিছু সংস্কারের কাজ হয়েছে। কিন্তু বড় জলোচ্ছ্বাসের ধাক্কা সামলানোর মতো অবস্থা এখনো তৈরি হয়নি। ফলে এই এলাকার মানুষের কাছে ঘূর্ণিঝড়ের বার্তা মানে আতঙ্ক।     

উপকূলের বহু মানুষ বেড়িবাঁধের ধারে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করে

কপোতাক্ষ নদীর পাড়ে খুলনার কয়রা উপজেলার বেশ কয়েকটি স্থান ঝুঁকিতে রয়েছে। ঘড়িলাল গ্রামের বাসিন্দা কামরুল ইসলাম জানান, উপজেলার চরামুখা, ঘড়িলাল, মাটিয়াভাঙ্গা, আংটিহারা এলাকার বেড়িবাঁধের অবস্থা খুবই নাজুক। বর্ষাকাল এলে পূর্ণিমার জোয়ারে বিভিন্ন এলাকায় বেড়িবাঁধ ধ্বসে লোকালয় ডুবে যায়। অনেক সময় স্থানীয় বাসিন্দারা স্বেচ্ছাশ্রমে বেড়িবাঁধ মেরামত করে। বর্ষাকালে এই এলাকার মানুষ চরম ঝুঁকিতে থাকে। বাঁধ মেরামতের বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের আশ্বাস পাওয়া গেলেও কাজ হয়নি। বছরের পর বছর ওই এলাকার মানুষ ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করে। ঘূর্ণিঝড়ের বার্তা পেলে সেখানকার মানুষদের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ে। 

ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের দুর্যোগ প্রস্তুতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত উপকূলের বিভিন্ন এলাকার বেড়িবাঁধ নাজুক করে দিচ্ছে। ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ঘূর্ণিঝড়ের পরে বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়া হলেও নাজুক অবস্থা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আঘাত করেছিল বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে। কক্সবাজার চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা ওই ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছিল। প্রাণ হারিয়েছিল এক লাখ ৩৮ হাজার মানুষ। ঘূর্ণিঝড়ের দীর্ঘ সময়েও ওই এলাকার অনেক স্থানে নাজুক অবস্থা। কিছু কিছু এলাকার বেড়িবাঁধ স্বাভাবিক জোয়ারের চাপও সইতে পারে না। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের কথা মনে এলে চোখে ভাসে চট্টগ্রামের বাঁশখালী, কক্সবাজারের চকরিয়া, কুতুবদিয়া, মহেশখালী প্রভৃতি এলাকার ছবি। ওই এলাকার নাজুক বেড়িবাঁধগুলোর বড় কোনো ঘূর্ণিঝড়ের চাপ সামলানো সম্ভব নয়। ১৯৯১ সালের পরে আরো অনেকগুলো ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের উপর দিয়ে। ২০১৬ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু, ২০১৭ সালের ঘূর্ণিঝড় মোরা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অঞ্চলে আঘাত করেছিল। 

ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুরের বিভিন্ন এলাকায় নাজুক বেড়িবাঁধ রয়েছে। বহু চেষ্টার পরেও অনেক স্থানের নদীর ভাঙন ঠেকানো যাচ্ছে না। লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের নদীর ভাঙ্গনের কথা অনেকেরই জানা। গত কয়েক বছর ধরে ক্রমাগত মেঘনা নদীর ভাঙনে হারিয়ে গেছে ওই উপজেলার বহু জনপদ। নিঃস্ব হয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। কিন্তু নদীর ভাঙন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নাই। ভাঙ্গনপ্রবণ এই এলাকাগুলো মোখা’র প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসে আরো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়বে। মধ্য-উপকূলের পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুরে অনেক স্থানে বেড়িবাঁধ সংস্কারবিহিন অবস্থায় পড়ে আছে। এইসব এলাকায় ঘূর্ণিঝড় বার্তা আতঙ্ক নিয়ে আসে। যদিও ঘূর্ণিঝড়ের মৌসুম এলেই বিষয়টি সকলের নজরে আসে; কিন্তু অন্য সময় উপকূলের সুরক্ষার কথা ভুলে যায়।