রাইজিংবিডি স্পেশাল

পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি দ্বিগুণ, চিনির দামও বেড়েছে

গত এপ্রিল মাসের শুরুতে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৩৫-৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মাত্র দেড় মাসের ব্যবধানে এখন তা প্রায় দ্বিগুণ দামে ৬৫-৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পেঁয়াজের এ মূল্যবৃদ্ধি বিষয়ে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী, ক্রেতা এবং মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য ভিন্ন রকমের। ১০ দিনের ব্যবধানে চিনির দামও বেড়েছে ১৫ টাকা।

খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, বেশি দামে পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে বলে বেশি দামে বিক্রি করছেন তারা। অপরদিকে, ক্রেতারা বলছেন, সরকারের তথ্য অনুযায়ী, দেশে পেঁয়াজের পর্যাপ্ত মজুত আছে। এছাড়া, বর্তমানে পেঁয়াজের ভরা মওসুম। তাই, এ মুহূর্তে পেঁয়াজের দাম এত বেশি হওয়ার কোনো কারণ নেই। অথচ, বাস্তব অবস্থা বলছে ভিন্ন কথা।

রাজধানীর কারওয়ান বাজার, নিউ মার্কেট ও হাতিরপুল বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ঈদুল আজহার সময় দাম আরও বাড়বে বলে জানালেন এসব মার্কেটের খুচরা ব্যবসায়ীরা।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, দেড় মাস আগে যে পেঁয়াজের কেজি ছিল ৩৫-৪০ টাকা, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকায়। দেড় মাসের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। গত বছরের একই সময়ে বাজারে পেঁয়াজের দাম ছিল ৪০ থেকে ৪৫ টাকার মধ্যে। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে তা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৫৯ শতাংশ।

বাজারে পেঁয়াজের দাম অল্পদিনের ব্যবধানে অনেক বেড়েছে। এ ব্যাপারে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, দাম যদি এভাবে বাড়তে থাকে, তাহলে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হবে। দেশীয় পেঁয়াজ উৎপাদন পর্যাপ্ত হওয়ায় আমদানি কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বাজার পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। যদি এভাবে পেঁয়াজের দাম বাড়তে থাকে তাহলে আমদানি করা হবে।

পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী ফরিদ উদ্দিন বলেন, পেঁয়াজের আমদানি বন্ধ হওয়ার কারণে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে বলে শুনেছি। এরকম হঠাৎ করে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে ক্রেতাদের পাশাপাশি ব্যবসায়ীরাও ঝামেলার মধ্যে পড়েছেন।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, চলতি বছরে পেঁয়াজ চাষে খরচ বেড়েছে। যেখানে গত বছর প্রতি কেজি পেঁয়াজের উৎপাদন খরচ ছিল ২২ টাকা, এবার তা বেড়ে হয়েছে ২৮ টাকা। রোজার সময়ও পেঁয়াজের দাম ঠিক ছিল, কেজি প্রতি ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। সাধারণত নতুন পেঁয়াজ ওঠে মার্চ-এপ্রিল মাসে। তার এক মাসের মধ্যে বাজারে এমন দাম বৃদ্ধি অস্বাভাবিক।

তিনি বলেন, পাবনা-ফরিদপুর অঞ্চলে হাজার হাজার কৃষক পেঁয়াজ বিক্রির সঙ্গে জড়িত। যখনই খবর পাচ্ছে ভারতে বৃষ্টি হয়েছে, তেমনি দাম বেড়ে যাচ্ছে। আবার যখন ভারত আমদানি বন্ধ করছে, তখন দাম বেড়ে যাচ্ছে।

এদিকে, বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে পেঁয়াজ আমদানি মার্চ মাস থেকে বন্ধ আছে। বেশ কিছুদিন নিয়ন্ত্রণের পর হু হু করে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম। পাশাপাশি করপোরেট লোকজন সিন্ডিকেট করে মূল্যবৃদ্ধি করছে।

নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ী আরিফুর রহমান বলেন, বাজারে কোনো কারণ ছাড়া হঠাৎ যেকোনো পণ্যের দাম বেড়ে যায়। ফলে, আমরা খুচরা ব্যবসায়ীরা মহাবিপদে আছি। কারণ, ব্যবসায় পুঁজি খাটানো লাগছে অতিরিক্ত, অথচ সেই তুলনায় লাভ হচ্ছে আগের মতই।

এই ব্যবসায়ী বলেন, কোরবানির ঈদের আগেই পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেছে। ঈদ যত ঘনিয়ে আসবে তত বাজার পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে।

হাতিরপুলে বাজার করতে আসা ব্যাংক কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম বলেন, বাজারে এলে জিনিসপত্রের দাম দেখে হতাশ হই। বাজারের এই অস্থিরতা কি কখনও কাটবে না? ৩৫ টাকার পেঁয়াজ ৭০ টাকা, ৭০ টাকার চিনি ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এরকম চলতে থাকলে আমরা বাঁচব কেমন করে!

আরেক ক্রেতা সিজার আহমেদ বলেন, পেঁয়াজের ভরা মৌসুম চলছে। সরকারের তথ্য অনুযায়ী, মজুতও আছে পর্যাপ্ত। এই মুহূর্তে পেঁয়াজের এত দাম থাকার কোনো কারণ নেই। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করছে আর মানুষের ভোগান্তি বাড়াচ্ছে।

অপরদিকে, ঢাকার বিভিন্ন বাজারে ১০ দিনের ব্যবধানে খোলা চিনির দাম কেজিতে ১৫ টাকা বেড়ে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকায়। এখন বাজারে খোলা চিনি কিছুটা পাওয়া গেলেও প্যাকেটজাত চিনি একেবারেই মিলছে না।

এ ব্যাপারে খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, সরবরাহ–সংকটে বাজারে চিনির দামে অস্থিরতা চলছে। মিল মালিকরা বলছেন, দেশে চিনির কোনো সংকট না থাকলেও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে। এ অবস্থায় সম্প্রতি চিনিকলের মালিকরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠির মাধ্যমে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন চিঠিতে বলেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ায় চিনি আমদানি নিয়ে তারা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর হাতিরপুল বাজার ও নি উমার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি খোলা চিনি ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এই দুই বাজারের ৮-১০টি মুদি দোকানে চিনির দামের ব্যাপারে জানতে চাইলে তারা বলেন, সরবরাহ না থাকায় তারা চিনি বিক্রি করছেন না। যেসব দোকানে চিনি বিক্রি হচ্ছে, সেসব দোকানি ঈদের আগে এসব চিনি কিনেছিলেন। বর্তমানে দু-একজন বিক্রেতা চিনি পেলেও অধিকাংশ বিক্রেতা তাদের চাহিদা অনুযায়ী চিনি পাচ্ছেন না।

টিসিবি‘র হিসাবে বাজারে প্রতি কেজি চিনির দাম ১২৫ থেকে ১৩৫ টাকা। অথচ বাস্তব চিত্র ভিন্ন। বাজারে দেখা গেছে, প্রতি কেজি চিনি ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যদিও গত মাসে সরকার প্রতি কেজি খোলা চিনির দাম ১০৪ টাকা বেঁধে দিয়েছিল।

চিনির পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, মিল ফটকে দিনের পর দিন ট্রাক বসিয়ে রেখেও চাহিদা অনুযায়ী চিনি পাচ্ছেন না তারা। এর ফলে বাজারে চিনির ঘাটতি তৈরি হচ্ছে, দামও বাড়ছে।

আবার মিল থেকে চিনির সরবরাহ স্বাভাবিক আছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ও দেশবন্ধু গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম রহমান। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দামে অস্থিরতা বিরাজ করছে। তার প্রভাব দেশের চিনির বাজারেও পড়েছে। আমরা বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে জানিয়েছি।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে প্রতি টন অপরিশোধিত চিনির দাম ৬৭৫ মার্কিন ডলার। অথচ এক মাস আগেও তা ছিল ৫২০ ডলার। এই বাস্তবতায় চিনি আমদানির ঋণপত্র খুলতে ভয় পাচ্ছেন অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা। কারণ, বর্তমান দামে চিনি আমদানি করলে তাতে প্রতি কেজিতে সব মিলিয়ে খরচ পড়বে ১৩১ টাকা।

এদিকে, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের বাজারে নতুন করে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, খোলা চিনি প্রতি কেজি ১২০ টাকা ও প্যাকেটজাত চিনি প্রতি কেজি ১২৫ টাকায় ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করার জন্য বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনসহ ব্যবসায়ীদের জানানো হয়েছে। তারা এ মূল্যে বাজারে বিক্রি করছে কি না, তা দেখার জন্য জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হবে।