নিজ নিজ এলাকার নাগরিকদের মশার কামড়, ডেঙ্গু বা চিকনগুনিয়া থেকে রক্ষা করা সিটি করপোরেশনের অন্যতম প্রধান কাজ। বিভিন্ন চেষ্টা করেও এ কাজটিতে এখনও সফল হতে পারেনি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। তাই, মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য সিটি করপোরেশন খুঁজছে কার্যকর পদ্ধতি। তারই অংশ হিসেবে নিজেদের কার্যক্রমের পাশাপাশি জনসচেতনতাকে গুরুত্ব দিতে পাঠ্যপুস্তকে মশা নিয়ে অধ্যায় চায় সিটি করপোরেশন। এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ে চিঠিও দিয়েছে ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ। চিঠিতে স্কুলের শিক্ষার্থীদের মশা বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য পাঠ্যপুস্তকে কার্টুন এবং গল্প আকারে একটি অধ্যায় রাখার দাবি জানিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম।
ডিএনসিসি সূত্রে জানা যায়, মেয়রের নির্দেশে গত ২১ মার্চ এই বিষয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়। সেই চিঠিতে পাঠ্যপুস্তকে মশা নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতামূলক অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সম্মতি দেয় এবং সুপারিশ করে সেই চিঠি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। ডিএনসিসির এই প্রস্তাব অনুমোদন করবে কি না বা করলে কী কী বিষয় থাকবে তা পর্যালোচনার জন্য শিগগির সভা আহ্বান করা হবে বলে জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র।
এই বিষয়ে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা বলেন, মশা নিধন আমাদের অন্যতম প্রধান কাজ। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টাও করে যাচ্ছি। যতই চেষ্টা করি না কেন, ডিএনসিসির একার পক্ষে এটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এর জন্য সব নাগরিককে সচেতন হতে হবে। তাই মানুষকে আরও বেশি সচেতন করার উদ্দেশে পাঠ্যপুস্তকে মশা নিয়ে একটি অধ্যায় যুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বর্ষা মৌসুম শুরু হতে না হতেই ঢাকায় বেড়েছে এডিস মশার উপদ্রব। এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। ২০ মে আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৫০। এমন পরিস্থিতিতে অনেকটা নড়েচড়ে হয়ে বসেছে ডিএনসিসি। তারা জানিয়েছে, এডিস ও কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে বছরব্যাপী পরিকল্পনা নিয়েছে ডিএনসিসি। জনসচেতনতাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে পাঠ্যপুস্তকে এডিস ও কিউলেক্স মশা নিয়ে অধ্যায় যুক্ত করার জন্য ডিএনসিসির পক্ষ থেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রস্তাব বিষয়ে মন্ত্রণালয় ইতিবাচক মতামত দিয়ে তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠিয়েছে বলেও জানান সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
পাঠ্যপুস্তকে মশা বিষয়ক একটি অধ্যায় সংযোজনে ডিএনসিসির এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, পাঠ্যপুস্তকে প্রতি শ্রেণিতে একটি করে মশাবিষয়ক অধ্যায় থাকা জরুরি। এটা সত্যি যে, যত কার্যক্রমই গ্রহণ করা হোক, জনসচেতনতা ছাড়া মশা নিয়ন্ত্রণে সফলতা আসা কঠিন। তাই, স্কুল পর্যায়ে প্রত্যেক শ্রেণিতে সে মশা, ডেঙ্গুজ্বর, চিকুনগুনিয়া, কালাজ্বরসহ অন্য ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে আলাদা অধ্যায় থাকলে ছোটবেলা থেকেই শিশুরা মশা বিষয়ে সচেতন হবে।
এই কীটতত্ত্ববিদ বলেন, আমরা অনেকদিন ধরে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং সিটি করপোরেশনের মশা সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রোগ্রামে পাঠ্যপুস্তকে মশা নিয়ে আলাদা অধ্যায় যুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছিলাম। আধুনিক বিশ্বের অনেক দেশেই পাঠ্যবইতে এই বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। অবশেষে ডিএনসিসি বিষয়টি আমলে নিয়ে উদ্যোগ নিয়েছে। আশা করি, পাঠ্যপুস্তকে মশার ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে একটি অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
প্রসঙ্গত, এ বছরের জানুয়ারিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আয়োজনে ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের কমার্শিয়াল ল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের (সিএলডিপি) আমন্ত্রণ ও অর্থায়নে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের একটি প্রতিনিধিদল ফ্লোরিডা সফর করে। তারা সেখানে মশা নিধন কার্যক্রম নিয়ে কয়েকটি কর্মশালায় অংশ নেন। সরেজমিনে মশা নিধন কার্যক্রম দেখেন। দলের নেতৃত্ব দেন মেয়র আতিকুল ইসলাম। সেখান থেকে ফিরে মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, মশা নিধনে ডিএনসিসি এতদিন ভুল পদ্ধতি ব্যবহার করেছে। তাই দ্রুত সময়ের মধ্যে মশার প্রজাতি চিহ্নিত করতে একটি ল্যাব স্থাপন করবেন। দেশে ফিরে এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএনসিসি মেয়র পাঠ্যপুস্তকে মশা নিয়ে অধ্যায় যোগ করার দাবি জানান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মশা নিধনে সারা বছরই রুটিন অনুযায়ী কাজ করে ডিএনসিসি। তবে কিউলেক্স মশার চেয়ে এডিস মশা অনেক বেশি ভোগাচ্ছে ডিএনসিসিকে। প্রতিনিয়তই এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন কর্মসূচি চালাচ্ছেন তারা। গত বছর বর্ষা মৌসুমে এডিস মশার উপদ্রব বাড়লে, ডিএনসিসি এলাকায় চিরুনি অভিযান চালায় ডিএনসিসি। সেই অভিযানে ডিএনসিসি ৫৪টি ওয়ার্ডে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে। ছাদ বাগান পরিদর্শনে ড্রোন ব্যবহার করে প্রায় ২৮ হাজার বাড়ির ছাদ পরীক্ষা করে ডিএনসিসি। দুই হাজার ২০০ বাড়িতে ছাদ বাগান চিহ্নিত করে। যার ভেতর ২০০ বাড়িতে মশার প্রজনন ক্ষেত্র থাকার মতো পানির উপস্থিতি শনাক্ত করে তা ধ্বংস করা হয়।
ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগে. জেনারেল জোবায়দুর রহমান বলেন, এডিস মশা সাধারণত বাসাবাড়ি, ছাদ বা আঙিনার পরিত্যক্ত পানির পাত্রে জন্মায়। যার জন্য এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতার বিকল্প নেই। শিক্ষার্থীরা ক্লাসের বইতে যদি মশার ক্ষতিকর দিক এবং তা নিয়ন্ত্রণের উপায় সম্পর্কে জানতে পারে, তাহলে তারা বাড়িতে বাবা-মা-আত্মীয়দের সঙ্গে সেটা শেয়ার করবে। আর এভাবেই বাসা-বাড়ির জমানো পানিতে জন্মানো এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে সংবাদ সম্মেলনে ডিএনসিসি মেয়র বলেন, এডিস মশা নিধনে সর্বস্তরের মানুষের সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। তাই পাঠ্যপুস্তকে মশা নিয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে একটি অধ্যায় যোগ করার জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অনুরোধ জানিয়েছি। শিক্ষার্থীরা বইয়ের এই অধ্যায়ের মাধ্যমে যদি মশার ক্ষতিকর দিকগুলো জানতে পারে, তাহলে তাদের বাড়ির ছাদ, আঙিনা পরিষ্কারে গুরুত্ব দেবে। এতে বাড়িতে এডিস মশা জন্মাতে পারবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামি শহর সফরের অভিজ্ঞতা জানিয়ে মেয়র বলেন, সেখানকার ছাত্রদের জন্য ‘মসকিউটোস বাইটস আর ব্যাড’ এই শিরোনামে একটি পাঠ্যবই রয়েছে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বইটি পড়ানো হয়। শিক্ষার্থীরা কার্টুন আকারে রং করে বইয়ের বিষয়বস্তু অধ্যয়ন ও অনুশীলন করে। আমাদের স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্যও পাঠ্যপুস্তক ও কার্টুন আকারে এ বিষয়ে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলেই শিশু বয়স থেকে মশা বিষয়ে সবার মধ্যে সচেতনতা বেড়ে উঠবে। মানুষের সচেতনতার উপরই আমরা বেশি গুরুত্ব দিতে চাই।
এখনও বৃষ্টি তেমনভাবে শুরু হয়নি। তারপরও প্রতিদিন নগরীতে এডিস মশার কামড়ে, ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। বর্তমান বছরের শুরু থেকে ২০ তারিখ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক হাজার ৪১৪ জন। গতকাল ২০ মে ভর্তি হয়েছেন ৫২ জন। এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হন ৮৭২ জন ও ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ছিলেন ৫৪২ জন। ১ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১২ জন মারা গেছেন বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম।
প্রসঙ্গত, ২০২২ সালে স্বাধীনতার পর রেকর্ড সংখ্যক মানুষ ডেঙ্গুতে মারা গেছেন, ২৮১ জন। সারা বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৬২ হাজার ৩৮২ জন। এছাড়াও ২০২১ সালে সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন এবং মারা যান ১০৫ জন। তবে ২০২০ সালে করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গুর সংক্রমণ তেমন একটা দেখা যায়নি।