রাইজিংবিডি স্পেশাল

জাতীয় নির্বাচন: কী ভাবছে বিএনপি ও শরীক দল

জাতীয় সংসদ নির্বাচন এ বছরের শেষে। সেই নির্বাচন যাতে হয়-নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে, সেই দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছে বিএনপি। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাদের অধীনেই পরবর্তী নির্বাচন করার ব্যাপারে বার বার ঘোষণা দিচ্ছে। বক্তব্য-পাল্টা বক্তব্যে বেশ কিছুদিন ধরে রাজনীতির মাঠ গরম। নির্বাচন যত কাছে আসছে, তত রাজনৈতিক পরিস্থিতি হয়ে উঠছে উত্তপ্ত।

নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার ব্যাপারে বিএনপির নীতি-নির্ধারকেরা অটল। অন্যদিকে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের অনেকে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেতে আগ্রহী। তারা বলছেন, সরকারবিরোধী চলমান আন্দোলন সফল না হলে ক্ষমতাসীনরা দলে ভাঙন তৈরি করবে। সেক্ষেত্রে ভাঙন রোধে নির্বাচনে যেতে হতে পারে। আবার সরকারের নানামুখী চাপ ও প্রলোভনেও দলের অনেকে ভোটে অংশ নিতে পারেন।

বিএনপি নেতারা বলছেন, চেয়ারপারসনকে ছাড়া নির্বাচনে গিয়ে তারা তৃণমূলের নেতাকর্মীদের কাছে দালাল হিসেবে চিহ্নিত হতে চান না। সেক্ষেত্রে প্রথমে দরকার দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার পূর্ণ কারামুক্তি। এজন্য তারা ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিকদের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ করছেন।

বিএনপির কয়েকজন নেতা রাইজিংবিডিকে জানিয়েছেন, আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য সরকার বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে নানামুখী কৌশল ও ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেবে। যার আলামত হিসেবে অনেক নেতাকে বিভিন্ন মামলায় সাজা দেওয়ার জন্য তোড়জোড় করা হচ্ছে। এই বিষয়টিও তাদের ভাবনায় আছে বলে জানান বিএনপির এসব নেতারা। 

বিএনপির দলীয় সূত্র জানায়, আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে কি নেবে না, এটি খুব সরল সমীকরণ নয়। অনেক ভাবনা-চিন্তা করেই তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

উল্লেখ্য, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৭টি মামলার মধ্যে দুটিতে তার ১৭ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাগারে যান তিনি। করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত করে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ তাকে সাময়িক মুক্তি দেয়। তারপর থেকেই গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় রয়েছেন তিনি।

দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে তারেক রহমানও একাধিক মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মামলায় তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। এছাড়া জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং মুদ্রা পাচার মামলায় হয় ৭ বছরের কারাদণ্ড। 

আগামী সংসদ নির্বাচন যদি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে না হয়ে বর্তমান সরকারের অধীনেই হয়- সেক্ষেত্রে বিএনপি কী করবে-এই বিষয়ে রাইজিংবিডির সঙ্গে বিএনপি ও শরীক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা হয়। নির্বাচন প্রসঙ্গে জাতীয় স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘আমরা আমাদের অবস্থান জানিয়েছি। এ ব্যাপারে জনগণের কাছেও আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অনির্বাচিত বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে আমরা অংশগ্রহণ করব না। জনগণ এবং বিরোধী রাজনৈতিক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলগুলো আমাদের পক্ষে তাদের সমর্থন দিয়েছে। আমরা আশা করি সরকার জনগণের ন্যায্য দাবি মেনে নেবে এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পথ প্রশস্ত করবে।’

স্থায়ী কমিটির আরেক সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ ১০ দফা দাবিতে আমরা রাজপথে আন্দোলনে রয়েছি। এই সরকারকে বিদায় না করা পর্যন্ত আমরা কোনো নির্বাচনে যাব না। ২০১৮ সালের নির্বাচনে গিয়ে আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সরকারের পক্ষ থেকে যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিলো, সেসবের কোনোটাই রাখেনি তারা। তাছাড়া ওই নির্বাচনে জনগণও নিজেদের ভোট দিতে পারেননি। দিনের ভোট রাতে ডাকাতি করা হয়েছে। এরপর দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার কথা কীভাবে আসে?’

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘দলের সিদ্ধান্ত এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়া। সরকার এরই মধ্যে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠাচ্ছে। অনেক নেতার স্ত্রী-সন্তানের পাসপোর্টও জমা রাখছে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে সরকার ২০১৮ সালের মতো আবারও নির্বাচন করার একটা ভিন্ন প্রক্রিয়ায় এগোচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। তাই আমরা অ্যাবসুল্যুটলি এই সরকারের অধীনে নির্বাচন বয়কট করবো। এর কোনো বিকল্প নেই।’

বিএনপির সাংগঠনিক ও ভারপ্রাপ্ত দপ্তর সম্পাদক এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘সরকার গণদাবি উপেক্ষা করে পাতানো নির্বাচন করতে চাইলে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। এজন্য সরকারকেই দায়ী থাকতে হবে। আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু হবে না। সেই প্রহসনের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে না। জনগণকে সাথে নিয়ে সেই প্রহসন করতেও দেওয়া হবে না।’

বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দল গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকী বলেন, ‘বাংলাদেশের বিদ্যমান শাসন কাঠামো ও বাস্তবতায় বর্তমান সরকারের অধীনে তো নয়-ই, কোনো দলীয় সরকারের অধীনেই ন্যূনতম গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। কাজেই বাংলাদেশের জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে বিদ্যমান শাসনব্যবস্থার বদল ঘটাতে হবে। আর সেই লক্ষ্যে বর্তমান সরকারের পদত্যাগ এবং রাজনৈতিক ঐক্যমত্যের একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন এবং সংবিধান সংস্কার করে শাসন ব্যবস্থা বদল ঘটিয়ে ক্ষমতার ভারসাম্য জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করাই এই মুহূর্তে জনগণের স্বার্থ ও আকাঙ্ক্ষার প্রধান রাজনৈতিক লক্ষ্য।’

বিএনপির উদ্দেশে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক গণঅধিকার পরিষদের সদস্য সচিব নুরুল হক নুর বলেন, ‘আমাদের রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে এই সরকারের পতন ঘটাতে হবে। বিদেশিদের সিগন্যালের আশায় থাকা যাবে না। জনগণকে সাথে নিয়ে আমরা যদি আন্দোলনকে বেগবান করতে পারি, বিদেশি শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো আমাদের সমর্থন করবে। আর আন্দোলন বেগবান করতে না পারলে কোনো বিদেশিদের সিগন্যালে সরকার পরিবর্তন হবে না। তাই, এই সরকারের অধীনে আমরা নির্বাচনে অংশ নেবো না। ’