রাইজিংবিডি স্পেশাল

অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে তামাকপণ্য

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় অসংক্রামক রোগে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর মোট মৃত্যুর ৬৭ শতাংশ হয় অসংক্রামক রোগের কারণে। এসব রোগে আক্রান্ত হওয়ার মূল কারণগুলোর মধ্যে আছে তামাক ও তামাকজাত দ্রব্যের যথেচ্ছ ব্যবহার। বাংলাদেশে বছরে অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ৫ লাখ ৭২ হাজার; যার মধ্যে ১ লাখ ৬১ হাজার মৃত্যু হয় সরাসরি তামাকজনিত রোগের কারণে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, পৃথিবীতে প্রতি ২ সেকেন্ডে একজন করে অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হয়। হৃদরোগ, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ, শ্বাসরোগের মতো এসব অসংক্রামক রোগে প্রতিবছর দেড় কোটি মানুষ মারা যান, যাদের বয়স ৩০ থেকে ৬৯ বছরের মধ্যে। এই অকালমৃত্যুর ৮৫ শতাংশই নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে ঘটে। বাংলাদেশ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অসংক্রামক রোগ কেবল শারীরিক দিক থেকেই নয়, পুরো একটি পরিবারের অর্থনৈতিক ভিতকে নাড়িয়ে দিতে যথেষ্ট। এখনও দেশের আপামর মানুষের আর্থিক সঙ্গতি অসংক্রামক রোগের চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত নয়। তাই, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় এসব রোগব্যাধি প্রতিরোধ করতে তামাক নিয়ন্ত্রণ জরুরি। 

বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারের চিত্র: গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে বাংলাদেশ ২০১৭, গ্লোবাল ইয়ুথ টোব্যাকো সার্ভে বাংলাদেশ ২০১৩, টোব্যাকো অ্যাটলাস ২০২০ এবং বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি ও আমেরিকান ক্যান্সারে সোসাইটি রিসার্চের প্রতিবেদনগুলোতে দেশে তামাক ব্যবহারে ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনগুলোর তথ্য বলছে, দেশে ১৫ বছর ও তার চেয়ে বেশি বয়সী ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ তামাক ব্যবহার করেন। এই বয়সী পুরুষদের মধ্যে তামাক সেবনের হার ৪৬ শতাংশ, নারীদের মধ্যে ২৫ দশমিক ২ শতাংশ। অন্যদিকে, ১৮ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ধূমপান করেন এবং ২০ দশমিক ৬ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ধোঁয়াবিহিন তামাক (জর্দা, গুল, সাদাপাতা ইত্যাদি) ব্যবহার করেন।

১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সী অপ্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ কোনো না কোনো ধরনের তামাক ব্যবহার করেন। এই বয়সী ছেলেদের মধ্যে তামাক সেবনের হার ৯ দশমিক ২ শতাংশ, মেয়েদের মধ্যে ২ দশমিক ৮ শতাংশ। অন্যদিকে, এই বয়সী ৪ শতাংশ ছেলে ও ১ দশমিক ১ শতাংশ মেয়ে ধূমপান করে। আর ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারী এই বয়সীদের সংখ্যা ছেলেদের মধ্যে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ ও মেয়েদের মধ্যে ২ শতাংশ।

প্রতিবেদনগুলোতে আরও বলা হয়, প্রায় ৩ কোটি ৮৪ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। প্রাপ্তবয়স্কদের ৪২ দশমিক ৭ শতাংশ আচ্ছাদিত কর্মক্ষেত্রে, ৪৯ দশমিক ৭ শতাংশ রেস্তোরাঁয় এবং ৪৪ শতাংশ গণপরিবহনে এমন পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। অপ্রাপ্তবয়স্কদের (১৩-১৫ বছর) মধ্যে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার ৫৯ শতাংশ।

তামাকের স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়, তামাকের কারণে ২০২০ সালে বাংলাদেশে প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ মারা গেছেন। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত এবং ৬১ হাজারেরও বেশি শিশু (১৫ বছরের নিচে) পরোক্ষ ধূমপানের কারণে সৃষ্ট রোগে ভুগছে।

তামাকের অর্থনৈতিক ক্ষতিও তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনগুলোতে। বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে তামাকজনিত মৃত্যু ও অসুস্থতার কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা, যা ওই বছরের জিডিপির ১ দশমিক ৪ শতাংশ। তামাকজনিত রোগের চিকিৎসা বাবদ প্রত্যক্ষ ব্যয় ৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকা এবং তামাক ব্যবহারের ফলে অকালমৃত্যু ও পঙ্গুত্বের কারণে উৎপাদনশীলতা হারানোর ক্ষতি ২২ হাজার ১৭০ কোটি টাকা।

তামাকপণ্য অসংক্রামক রোগের অন্যতম বড় কারণ: বিশ্বব্যাপী মোট মৃত্যুর প্রায় ৭১ শতাংশ ঘটে বিভিন্ন অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে। বাংলাদেশে এর অনুপাত ৬৭ শতাংশ। এসব রোগের তালিকায় বিশেষত রয়েছে হৃদরোগ, স্ট্রোক, কিডনি রোগ, শ্বাসরোগ, ফুসফুসের ক্যান্সার ইত্যাদির মতো অসংক্রামক রোগ; যার সবগুলোই ঘটে তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে। ক্যান্সারেরও অন্যতম কারণ তামাক। এর কারণে ঝুঁকি বাড়ে ১০৯ শতাংশ পর্যন্ত। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, পরোক্ষ ধূমপানের কারণে পৃথিবীতে বছরে ১২ লাখ মানুষ অকালে মারা যান। তামাকের ধোঁয়ায় আছে সাত হাজার রাসায়নিক পদার্থ, যার মধ্যে ৭০টি ক্যান্সার সৃষ্টিকারী। ফুসফুস ক্যান্সার, স্ট্রোক ও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ পরোক্ষ ধূমপান।   

অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা অনেক ব্যয়সাপেক্ষ এবং দীর্ঘমেয়াদি বলে এটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য বড় হুমকি এবং জাতীয় অর্থনীতি অগ্রসরের পথেও বড় বাধা। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপসহ অন্যান্য অসংক্রামক রোগের অন্যতম বড় কারণ। 

আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি এবং বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণ মানুষের তুলনায় তামাক ব্যবহারকারীদের বিভিন্ন অসংক্রামক রোগ, যেমন: হৃদরোগ, স্ট্রোক, সিওপিডি ও ফুসফুসের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি ৫৭ শতাংশ বেশি এবং তামাকজনিত ক্যান্সারের ঝুঁকি ১০৯ শতাংশ বেশি থাকে। 

বাংলাদশে তামাকের স্বাস্থ্যগত প্রভাব: ‘নন-কমিউনিকেবল ডিজিজেস রিস্ক ফ্যাক্টর সার্ভে: বাংলাদেশ ২০১০’ এর তথ্য অনুযায়ী, প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ৯৮.৭ শতাংশ মানুষ অন্তত একটি অসংক্রামক রোগের ঝুঁকিতে আছেন। এছাড়া, অন্তত দুটি অসংক্রামক রোগের ঝুঁকিতে রয়েছেন ৭৭.৪ শতাংশ মানুষ। এসব রোগের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করে তামাক ও তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার।  একটি গবেষণায় দেখানো হয়েছে, গর্ভবতী নারী ও শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে নিকোটিনের ব্যবহার নানা রকম শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। 

বিশ্বব্যাপী অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত মোট মৃত্যুর ১৪ শতাংশ তামাক ব্যবহারের কারণে হয়ে থাকে। কখনই তামাক ব্যবহার করেননি, এমন ব্যক্তিদের তুলনায় তামাক ব্যবহারকারীদের তামাকজনিত রোগ, যেমন: হৃদরোগ, স্ট্রোক, সিওপিডি, ফুসফুসের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেশি (৫৭ শতাংশ) এবং অন্যান্য ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি আরও বেশি (১০৯ শতাংশ)।

এর বাইরে আছে ভৌগোলিক ও সামাজিক বিষয়গুলোও। তামাক ব্যবহারের ব্যাপকতার দিক থেকে প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশ আছে বেশ ওপরের দিকে। আবার নারী-পুরুষের বিবেচনায় তামাকে আসক্তদের মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি। গ্লোবাল টোব্যাকো এটলাস, ২০১৭ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ২৫.২ শতাংশ নারী কোন না কোন তামাকপণ্য ব্যবহার করেন; যেখানে ভারতে তা ১৪.২ শতাংশ, থাইল্যান্ডে ৭.৬ শতাংশ, পাকিস্তানে ৫.৪ শতাংশ এবং চীনে ২.১ শতাংশ।  

এর সঙ্গে আছে পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাব। ভৌগোলিকভাবেই এ দেশের নারীদের শতকরা ৫০ শতাংশের ওপরে রক্তস্বল্পতায় ভোগেন। তার ওপর তামাকজাত দ্রব্যের প্রতি আসক্ততা জরায়ু ক্যান্সার, গর্ভধারণ ক্ষমতা কমে যাওয়ার মতো নতুন নতুন সমস্যা বাড়িয়ে দিচ্ছে। পাশাপাশি, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কম ওজন, মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী বা খর্ব শিশু জন্ম হওয়ার যে ঘটনাগুলো ঘটছে, সেগুলোতেও প্রভাব রয়েছে তামাকের।

যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত নিকোটিন অ্যান্ড টোব্যাকো রিসার্চ সাময়িকীতে ‘বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরা পরোক্ষ ধূমপানের শিকার’ শীর্ষক এক জরিপে উঠে এসেছে, ঢাকার ৯৫ শতাংশ শিশু কোনো না কোনোভাবে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে। বছরে ৬১ হাজারেরও বেশি শিশু (১৫ বছরের নিচে) পরোক্ষ ধূমপানের কারণে সৃষ্ট রোগে ভুগছে। অপর একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশে প্রতি বছর ধূমপানে জড়িয়ে পড়ছে ১৩-১৫ বছরের ৭ শতাংশ কিশোর। 

তামাক প্রভাব ফেলে জীবনযাত্রাতেও: তামাক ব্যবহারের কারণে মানুষের আয়ের একটি বড় অংশ চলে যায় তামাক কোম্পানিগুলোর পকেটে। খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০১৬ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর দেশের সবচেয়ে দরিদ্র ২০ শতাংশ তামাক-ব্যবহারকারী পরিবারগুলো তাদের বার্ষিক আয়ের এক-পঞ্চমাংশের বেশি (২০.৭ শতাংশ) তামাকপণ্যের পেছনে ব্যয় করে থাকে। তাছাড়া, তামাক ব্যবহারকারী সব শ্রেণির পরিবার মিলে বছরে তামাকপণ্যের পেছনে ৯ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা ব্যয় করে থাকে। এই অর্থ তামাকপণ্যের পেছনে ব্যয় না করলে তা জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারত।

কৌশলে চলছে তামাক কোম্পানির বিজ্ঞাপন: আইনে আছে, তামাকের ব্যবহার প্রবর্ধনের উদ্দেশ্যে যেকোনো ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না। কিন্তু, কোম্পানিগুলো কৌশলে এখনো তাদের বিজ্ঞাপন প্রচার করছে। সম্প্রতি রংপুরের বুড়িরহাটে আবুল খায়ের টোব্যাকো’র তেমনি একটি আইন লঙ্ঘনের চিত্র পাওয়া গেছে। 

ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড ও হ্যান্ড মাইক ব্যবহার করে ম্যারিজ ব্লাক ডায়মন্ড সিগারেটের প্রচার এবং প্যাকেট কিনলে বাইসাইকেল, ঘড়ি, টেবিল ফ্যানসহ বিভিন্ন পুরস্কার জেতার আশ্বাস দিচ্ছে আবুল খায়ের টোব্যাকো কোম্পানি। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য (ব্যবহার) (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ এর ধারা ৫ অনুযায়ী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো তামাকজাত দ্রব্য বা তামাকের ব্যবহার প্রবর্ধনের উদ্দেশ্যে যেকোনো ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করা নিষিদ্ধ এবং দণ্ডণীয় অপরাধ। তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘এটা এক ধরনের বিজ্ঞাপন, যা আইনের লঙ্ঘন। অনতিবিলম্বে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে তামাক কোম্পানির সকল প্রচার কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে’। 

এছাড়া, বিড়ি কোম্পানিগুলো সম্প্রতি কর কমানোর ক্যাম্পেইন পরিচালনা করেছে। বাজেটকে সামনে রেখে প্রতিবছরের মতো এবারও বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিড়ির কর কমানোসহ নানা দাবিতে মানববন্ধন এবং সমাবেশ করতে দেখা যাচ্ছে বিড়ি শ্রমিকদের। একই দাবিতে তামাক চাষি, ব্যবসায়ী ও বিড়ি শ্রমিকরা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে। প্রজ্ঞা বলছে, ‘নীতি-প্রণেতাদের এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ, তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনে বর্ধিত করারোপের মাধ্যমে তামাকপণ্যের দাম বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই’। 

তামাক আইন সংশোধনের গুরুত্ব: তামাক নিয়ন্ত্রণে বর্তমান সরকারের নানা ধরনের পদক্ষেপের কারণে বর্তমানে বাংলাদেশে তামাকের ব্যবহার আগের তুলনায় কিছুটা হলেও কমেছে। ২০০৯ সালের গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ছিল ৪৩ দশমিক ৩ শতাংশ, যা ২০১৭ সালে পরিচালিত জরিপে ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনকে আরও শক্তিশালী ও যুগোপযোগী করতে পারলে তামাকের ব্যবহার আরও অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগের এসব ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে রোগগুলো প্রতিরোধের দিকে তেমন একটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। আমাদের দেশে স্বাস্থ্য খাতের পেছনে যে বরাদ্দ থাকে, তার বেশিরভাগই চিকিৎসাসেবার পেছনে খরচ করা হয়। কিন্তু, স্বাস্থ্যকর জীবনাচরণের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধিসহ যথাযথ আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন এবং প্রয়োগের পেছনে নজর কম দেওয়া হয়।

তামাকের করাল গ্রাস থেকে দেশকে মুক্ত করতে তাই বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি আরও শক্তিশালী করার জোর দাবি উঠছে। বিদ্যমান আইনটি সংশোধিত হলেও সময়ের সাথে সাথে আইনে একাধিক অসঙ্গতি দেখা দিয়েছে, যে কারণে নতুন করে সংশোধন জরুরি।

বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস বুধবার: আগামী বুধবার (৩১ মে) বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। বিকল্প খাদ্য ফসল উৎপাদন ও বিপণনের সুযোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং টেকসই ও পুষ্টিকর ফসল চাষে তামাক চাষিদের উৎসাহিত করতে এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘গ্রো ফুড, নট টোব্যাকো’। তামাক উৎপাদনে কোম্পানির কূটকৌশল উন্মোচনও এবারের বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। বাংলাদেশে দিবসটি উদযাপিত হতে যাচ্ছে ‘তামাক নয়, খাদ্য ফলান’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে।

বিশেষজ্ঞ মতামত: স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ডা. নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে প্রয়োজন যথাযথ নীতিমালার। নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে দেশের বর্তমান অবস্থায় যেসব রোগ বেশি অকালমৃত্যু ও বৈকল্য ঘটায়, সেগুলো ঠিকমতো নির্ণয়, প্রতিরোধ নির্ধারণ করে প্রতিরোধ এবং আধুনিক চিকিৎসার পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ রাখতে হবে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টিকে কেন্দ্র করে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করে বাস্তবায়ন করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, আইন সংশোধনের প্রসঙ্গটি বিভিন্ন কারণে আসছে। তামাকদ্রব্য বিক্রির স্থানে পণ্য প্রদর্শন করা যাবে না। কিন্তু, এখনও হাসপাতালের আঙিনা কিংবা বিদ্যালয়ের আশপাশেসহ প্রায় সকল স্থানে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নান্দনিকভাবে তামাকপণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণের অন্যতম অন্তরায় খুচরা সিগারেটসহ সকল তামাকপণ্যের খুচরা বিক্রি। সিগারেট সহজলভ্য হওয়ায় যেমন নতুন ধূমপায়ীর সংখ্যা বাড়ছে, তেমনই দরিদ্র জনগোষ্ঠীদের তামাকপণ্যের পেছনে ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্ততপক্ষে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, খুচরা তামাকপণ্য বন্ধ করা খুব জরুরি। ইতোমধ্যে বিশ্বের ১১৮টি দেশ এই কাজটি করে দেখিয়েছে এবং সুফল পাচ্ছে।

হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, তামাক হলো প্রাণঘাতী পণ্য। তামাক ব্যবহারকারীর প্রায় অর্ধেক মারা যান তামাকের কারণে। কখনই তামাক ব্যবহার করেননি, এমন লোকদের তুলনায় তামাক ব্যবহারকারীদের হৃদরোগ, স্ট্রোক, সিওপিডি বা ফুসফুসের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি ৫৭ শতাংশ বেশি। এছাড়াও তামাকজনিত অন্যান্য ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি ১০৯ শতাংশের বেশি। দেশে পরোক্ষ ধূমপানের হারও অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। দেশে ১৫ বছরের নিচে ৬১ হাজারেরও বেশি শিশু পরোক্ষ ধূমপানের কারণে সৃষ্ট রোগে ভুগছে।

তিনি আরও বলেন, তামাক শুধু প্রাণহানিই ঘটনায় না, বড় অঙ্কের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণও অনেক বেশি। একটি তথ্যে দেখা গেছে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে তামাকজনিত মৃত্যু এবং অসুস্থতার কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা, যা ওই বছর জিডিপির ১ দশমিক ৪ শতাংশ।