রাইজিংবিডি স্পেশাল

ডেঙ্গু ঠেকাতে দরকার জনস‌চেতনতা 

বর্ষা মৌসুম শুরু হতে না হতেই সারা দেশে আবারও চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু। ২০২২ সালে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিয়েছেন ৬২ হাজার ৩৮২ ডেঙ্গু রোগী। ওই বছর ডেঙ্গুতে মারা গেছেন দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ২৮১ জন। তাই, এ বছরে বর্ষা মৌসুমের শুরুতে ডেঙ্গু নিয়ে ব্যাপকভাবে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী সোমবার (২৯ মে) জা‌নি‌য়ে‌ছেন, গতকাল পর্যন্ত যত মানুষ ডেঙ্গু‌তে আক্রান্ত হ‌য়ে‌ছেন (১ হাজার ৭০৪ জন),  তা গত বছ‌রের তুলনায় প্রায় ৫ গুণ বে‌শি।

‌বিগত বছরগু‌লো‌তে দেখা গে‌ছে, ডেঙ্গু পরীক্ষার ফি নিয়ে একধরনের হরিলুট অবস্থার সৃষ্টি করে বিভিন্ন বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান। তাদেরকে একটা নিয়মের মধ্যে আনতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গতকাল (২৮ মে) ডেঙ্গু পরীক্ষার ফি নির্ধারণ করেছে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু পরীক্ষার ফি ১০০ টাকা এবং বেসরকারি হাসপাতালে ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। কোনো হাসপাতাল নির্ধারিত ফি’র চেয়ে বেশি টাকা নিলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনই সারা বছরই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে। এসব কার্যক্রমের মধ্যে আছে নিয়মিত ফগার মেশিনের মাধ্যমে ওষুধ ছিটানো, জলাবদ্ধতা দূর করা, ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করা, ছাদবাগান বা বাড়ির আঙিনায় জমে থাকা পানিতে এডিস মশার বংশবিস্তার রোধ করার জন্য তদারকি প্রভৃতি।

যদিও এসব কার্যক্রমের বিষয়ে অপত্তি আছে অনেক নাগরিকের। তারা বলছেন, এসব কার্যক্রম নিয়মিত করা হয় না। যখন ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ে, তখনই করা হয়। সারা বছর এসব কার্যক্রম চালালে এবং তদারকি করলে এর সুফল পাওয়া যাবে বলেও মনে করেন নাগরিকরা।  

ঢাকা নবাবপুরের বাসিন্দা মির্জা খোকন বলেন, ৩-৪ দিন পর ফগার মেশিন দিয়ে ধোঁয়া মেরে যায়। এতে যথেষ্ট পরিমাণে ওষুধ থাকে কি না, সেটা নিয়েও সন্দেহ আছে। থাকলেও সেই ওষুধ ছিটানোর কারণে মশা তো মরেই না, উপরন্তু বাইরের মশারা ঘরে ঢুকে যায়। তাছাড়া, এই ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করে, কাশি হয়। ড্রেনের ময়লা-অবর্জনা ঠিকমতো পরিষ্কার করে না। আশপাশের ডাস্টবিন থেকে নিয়মিত ময়লা নিয়ে যায় না। 

বনানীর বাসিন্দা বাহার উদ্দিন বলেন, সিটি করপোরেশন কাজ করলেও তার সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। এডিস মশার বংশবিস্তার রোধে আরও বেশি কাজ করা উচিত তাদের। যারা ছাদবাগান করেন, তারাসহ অন্যদের অনেক বেশি দায়িত্ববান ও সচেতন হওয়া দরকার। যত্র-তত্র ময়লা ফেলা, বিভিন্ন পাত্রে পানি জমে থাকা—এসব বিষয়ে নাগরিকরা আরও বেশি সচেতন না হলে ওষুধ ছিটিয়ে বা অন্য উদ্যোগ নিয়ে সিটি করপোরেশন একা কিছুই করতে পারবে না। সামনে ডেঙ্গু সিজন আসছে, সবাইকে অনেক বেশি সচেতন হতে হবে।

রাজধানীর কোন কোন এলাকায় মানুষ বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়, এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য নেই। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেছেন, রাজধানীর বেশিরভাগ হাসপাতাল দক্ষিণ সিটিতে। ফলে, উত্তর সিটির বাসিন্দারা দক্ষিণের হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিলেও তার সঠিক হিসাব পাওয়া অনেক কঠিন। তবে, বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি। রোগীর বাসার ঠিকানা দিয়ে কে, কোন এলাকার বাসিন্দা, সেটা বের করতে পারবেন অচিরেই। সে হিসাবটা প্রতিদিন গণমাধ্যমে জানানো হবে। 

ডেঙ্গু প্রতিরোধে ডিএনসিসির সার্বিক কার্যক্রম বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেছেন, আমরা মশা নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে নিয়মিত কাজ করছি। জলাশয়ে ওষুধ ছিটিয়ে মশার বংশবিস্তার রোধে আমাদের একটা টিম কাজ করছে। ডেঙ্গুর অন্যতম বাহক এডিস মশার উৎপত্তিস্থল, বিভিন্ন পাত্রে থাকা জমানো পানি, নির্মাণাধীন ভবনে নিয়মিত তদারকি, ছাদবাগানে পানি যাতে জমে না থাকে—এসব বিষয়ে নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য মশককর্মীদের পাশাপাশি বাংলাদেশ স্কাউট ও বিএনসিসির সদস্যরাও মাঠে কাজ কর‌ছেন।

মেয়র বলেন, নাগরিকদের মশার কামড়, ডেঙ্গু বা চিকনগুনিয়া থেকে রক্ষা করা সিটি করপোরেশনের অন্যতম প্রধান কাজ। এতে সফল হওয়ার জন্য জনসচেতনতাকে গুরুত্ব দিতে গত ২১ মার্চ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চি‌ঠি পাঠানো হয়। পাঠ্যপুস্তকে মশা নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতামূলক অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয় সেই চি‌ঠি‌তে। এতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সম্মতি জানায় এবং সুপারিশ করে সেই চিঠি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। 

ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা বলেছেন, মশা নিধন আমাদের অন্যতম প্রধান কাজ। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টাও করে যাচ্ছি। শুধু সিটি কর‌পোরেশন নয়, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সবার সচেতনতা প্রয়োজন। জনগণ সচেতন না হলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। আমরা নিজেরাই এডিসের লার্ভার প্রজননক্ষেত্র তৈরি করি। বাড়িতে, ছাদবাগানে পানি জমিয়ে রেখে লার্ভা সৃষ্টি করছি। সিটি কর‌পোরেশনের কর্মীদের পক্ষে বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে এসব লার্ভা ধ্বংস করা সম্ভব হয় না। ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়রের প্রতিক্রিয়া জানা সম্ভব হয়নি। তবে, ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাসের বলেছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত কার্যক্রম চলছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সার্ভে (জানুয়ারি মাসের সার্ভে, যা জানানো হয় এপ্রিলে) থেকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে ১২ নম্বর ওয়ার্ডকে চিহ্নিত করে জানালে আমরা সেই ওয়ার্ডে ক্রাশ প্রোগ্রাম চালাই। কিন্তু, সেখানে কোথাও এডিস মশার সিঙ্গেল লার্ভাও পাওয়া যায়নি। বর্তমানে অধিদপ্তর থেকে ডেঙ্গু রোগীর যে তথ্য দেওয়া হচ্ছে, আমরা সেই ঠিকানায় খোঁজ নিয়ে তাদের আইডেন্টিফাই করে সেই বাড়ির আশপাশে মশার প্রজননস্থল ধ্বংসে কাজ করছি। 

তিনি আরও বলেন, গতকাল (২৮ মে) পর্যন্ত অধিদপ্তর থেকে দক্ষিণ সিটিতে বসবাসরত ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তিদের যে তালিকা দেওয়া হয়েছে, সেটার পরিমাণ হচ্ছে মোট আক্রান্তের ১৭.২১ শতাংশ। জুনের ১৫ তারিখ থেকে ডিএসসিসির ১০টি অঞ্চলে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে। এছাড়া, জুলাইয়ের ১৫ তারিখ থেকে ডিএসসিসি এলাকায় কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ করা হবে। তিন মাসব্যাপী এর কার্যক্রম চলবে। নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে নিয়মিত মনিটর করা হবে। ডিএসসিসি মেয়র নিজেও এই বিষয়ে প্রতিদিন সময় দেন।  

প্রসঙ্গত, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে নতুন করে ভর্তি হয়েছেন ৬৭ জন। এ নিয়ে বর্তমানে সারা দেশে সর্বমোট ২০৯ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। এর মধ্যে ঢাকার ৫৩টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন ১৭৯ জন। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ৩০ জন।

এ বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেলে ১ হাজার ৭৭১ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ১৭৭ জন ও ঢাকার বাইরে ৫৯৪ জন। অন্যদিকে, ১ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ১ হাজার ৫৪৯ জন। তাদের মধ্যে ঢাকায় ৯৮৭ জন ও ঢাকার বাইরে ৫৬২ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে কারও মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। তবে, ১ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ১৩ জন।

২০২১ সালে সারা দেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। তাদের মধ্যে ১০৫ জন মারা যান। ২০২০ সালে ডেঙ্গু তেমনভাবে প্রভাব ফেলতে পারেনি।