রাইজিংবিডি স্পেশাল

নেতাকর্মী‌দের ‘গুম-হত্যায়’ জ‌ড়িতদের তালিকা করছে বিএনপি

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দা‌বি‌তে দীর্ঘ‌দিন ধ‌রে রাজপ‌থে আন্দোলন কর‌ছে বিএন‌পি। বিএনপি নেতারা মনে করছেন, সাম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি; সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তাদের আন্দোলনে সুফল ব‌য়ে আন‌বে। সেজন্য নির্বাচনকালীন সম‌য়ের সরকার গঠনের দাবি‌তে তা‌দের আন্দোলনে নতুন কৌশলের দি‌কে নজর দিয়েছে তারা।

নতুন মা‌র্কিন ভিসানী‌তি বিষ‌য়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ব‌লেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের এই বিধিনিষেধ দেশের জন্য কোনোভা‌বেই মর্যাদাকর নয়। এই ভিসানী‌তি আসায় বিএনপি যে ইস্যু‌তে আন্দোলন কর‌ছে, তার যৌক্তিকতা প্রমাণিত হয়েছে।’

বিএন‌পির নীতিনির্ধারকদের একা‌ধিক নেতার সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের অভিন্ন রূপরেখার জন্য ৩১ দফার একটি ‘যৌথ ঘোষণাপত্রের’ খসড়া ইতোম‌ধ্যে তৈরি করা হয়েছে। জুনের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে এ ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হবে। এরপরই নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবেন তারা। বিএন‌পি তার সমমনা‌ দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে নতুন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ক্রমান্ন‌য়ে ‘এক দফা’ আন্দোলনের দিকে যাবে। 

গুম-নিপীড়নে যুক্ত কর্মকর্তাদের তালিকা হচ্ছে 

আন্দোলনের পাশাপাশি বিএনপি গুম-নিপীড়নের সঙ্গে যুক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা ও সদস্যদের তালিকা তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ লক্ষ্যে দলটি সারা দেশের নেতাকর্মীদের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছে। এরই মধ্যে দলের কেন্দ্রীয় দপ্তর জেলা ও মহানগর কমিটিকে এ-সংক্রান্ত দুটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। একটি চিঠিতে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও আরেকটিতে মামলা-সংক্রান্ত তথ্যসেলের কন্টাক্ট পারসন সালাহ উদ্দিন খান স্বাক্ষর করেছেন। বিএনপির কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে পাঠানো এ দুটি চিঠি পাওয়ার কথা জেলার নেতারা স্বীকার করেছেন। 

বিএনপির মামলা-সংক্রান্ত তথ্যসেলের কন্টাক্ট পারসন সালাহ উদ্দিন খান স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে- গুম হওয়া নেতাকর্মীদের নাম ও ঠিকানা, গুমের সঙ্গে জড়িত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাম ও টেলিফোন নম্বর (যদি থাকে), মামলা হলে রুজুকারী কর্মকর্তার নাম, পরিচয় ও টেলিফোন নম্বর (যদি থাকে), মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তার নাম, পরিচয় ও টেলিফোন নম্বর (যদি থাকে) এবং ওই সময়কার সংশ্লিষ্ট সার্কেল এএসপি/এডিসি/এসি জোন এবং এসপি/ডিসি জোনের নাম, পরিচয় এবং টেলিফোন নম্বরসংবলিত চিঠি কেন্দ্রে পাঠাতে। চিঠিটি গত ২৩ মে ইস্যু করা হয়েছে। 

রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত চিঠিতে তথ্যসেল থেকে চাওয়া তথ্যাদি দ্রুত পাঠাতে বলা হয়েছে। এ চিঠিও ১৮ মে ইস্যু করা হয়েছে। চিঠি পাওয়ার পর ১৫ দিনের মধ্যে তথ্য পাঠাতে বলা হয়েছে। 

কেন্দ্রের নির্দেশে রংপুরে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ‘মিথ্যা ও গায়েবি’ মামলার বাদী, তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের তালিকা করা শুরু হয়েছে। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সামসুজ্জামান সামু। তিনি বলেন, তাদের তৈরি করা খসড়া তালিকায় ২৫০ জন পুলিশ, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা, মামলার বাদীসহ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতাও রয়েছেন। তারা দ্রুতই এ তালিকা প্রস্তুত করে কেন্দ্রে পাঠাবেন। 

জেলা যুবদলের সভাপতি নাজমুল আলম নাজু বলেন, নামের তালিকা হচ্ছে কি না জানা নেই। তবে নেতাকর্মীদের নামে যেসব মিথ্যা ও গায়েবি মামলা হয়েছে, সেসব মামলার নথি সংগঠনের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। নথিতে মামলাকারী, তদন্তকারী কিংবা কারা মামলা পরিচালনা করছেন, তাদের নামও রয়েছে।

রাজশাহী মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট এরশাদ আলী ঈশা বলেছেন, চলতি মাসে তাদের কাছে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা হচ্ছে। চিঠিতে সেইসব মামলার বাদী, তদন্ত কর্মকর্তা ও সাক্ষীদের নাম-ঠিকানাসহ ওই জোনের এসি বা ডিসির তালিকা তৈরি করতে বলা হয়েছে। এর আগে নির্যাতিত ও শহীদ নেতাকর্মীদের ডকুমেন্টারি করতে বলা হয়েছিল। তবে তখন রাজশাহী মহানগর ইউনিটে এমন কাউকে পাওয়া যায়নি।

বগুড়া জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী আজগর হেনা জানিয়েছেন, কেন্দ্রের নির্দেশনা অনুযায়ী তথ্যগুলো সংগ্রহের জন্য প্রতিটি থানা কমিটির কাছে চিঠির কপি পাঠানো হয়েছে। জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শহীদুন্নবী সালাম জানান, তারা দুটি চিঠি পেয়েছেন এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিয়েছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে এ পর্যন্ত সংঘটিত ঘটনাগুলোর তথ্য তারা ঢাকায় পাঠাবেন।

সহিংস নয়, আন্দোলন হবে শান্তিপূর্ণ

যৌথ ঘোষণাপ‌ত্রে বিএনপির পক্ষ থে‌কে চারটি পয়েন্ট এক করে ‘এক দফা’ তৈরি করছে। এ ব্যাপারে ‌বিএন‌পির স‌ঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে শরিক জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের প্রধান ও এনপিপি চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, বর্তমান সংসদ ভেঙে দেওয়া, সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা এবং নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি রোধের দাবির সমন্বয়ে এক দফা তৈরি করা হয়েছে। সে হিসেবে নতুন যে কর্মসূচি আসছে, সেটিকে এক দফার আন্দোলনই বলা যা‌বে। 

সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ ১০ দফা দাবিতে বিএনপি গত ডিসেম্বর থেকে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে। এপ্রিলের শেষে আন্দোলনের সেই ধারা থেকে খানিকটা সরে এসে দলীয় কর্মসূচি পালন করে চলেছে বিএনপি ও তার মিত্র দলগুলো। এরই অংশ হিসেবে গত ১৩ মে থেকে বিএনপি ১০ দফা দাবিতে ঢাকা মহানগরসহ সারা দেশে ৮২টি সাংগঠনিক জেলায় ধারাবাহিক ‘পদযাত্রা’ ও ‘জনসমাবেশ’ করে আসছে। 

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি ঘোষণার পর আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি খানিকটা পাল্টেছে বলে মনে করছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, গ্রামদেশে অতি বাড়াবাড়ি, অসামাজিকতাসহ নানা কারণে কোনও পরিবারকে সামাজিকভাবে একঘরে করে ফেলা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি দিয়েও সরকারকে তেমন একঘরে করে ফেলা হয়েছে।

তাই, বিএনপির নীতিনির্ধারকরা ভাবছেন, এই নতুন পরিস্থিতি ও চাপ কাজে লাগিয়ে দাবি আদায় করার এটাই মোক্ষম সময়। এর আগে ২০১৪ সালে আন্দোলনের একপর্যায়ে বিএনপি দশম সংসদ নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়। সে আন্দোলন একপর্যায়ে সহিংস হয়ে ওঠে। তবে ২০১৮ সালে নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলনে থাকলেও বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেয়।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন‌কে উদ্দেশ্য ক‌রে বিএনপি এবার শুরু থেকেই শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনের কর্মসূচি পালনের চেষ্টা করছে। বিএন‌পি নেতারা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপের পর আন্দোলনের কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ রাখার বিষয়ে তারা আরও বেশি সতর্ক হ‌য়েছেন। তবে নির্বাচন যত এগি‌য়ে আস‌বে এবং আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে পরিস্থিতি কতটা শান্ত থাকবে বা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে- বিএনপির নেতারাও এ বিষ‌য়ে সংশ‌য়ে আছেন। এজন্য বিএনপির পক্ষ থে‌কে যাতে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে বাধা সৃষ্টির অভিযোগ না আসে, আন্দোলনের কর্মসূচি ও কৌশল প্রণয়নে সে বিষয়ের ওপর বি‌শেষ গুরুত্ব এবং সেটা ক্লোজ‌লি ম‌নিটর কর‌ছেন নীতিনির্ধারকরা।

এ প্রসঙ্গে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, বিএনপি এখনও কোনও সহিংস কর্মসূচি দেয়নি। মিছিল-মিটিং করা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। এমনকি হরতাল করাও আমা‌দের অধিকার। আমাদের তো সতর্ক হওয়ার কথা নয়। ভিসানীতি ইমপোজ করা হচ্ছে কার ওপর? যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আছে, যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করছে, তাদের সতর্ক করতে এই ইমপোজ। কিন্তু বিএন‌পি ক্ষমতায় নেই। তবে বিএনপি কী করে, কর‌বে, জনগণ সেদিকে তাকিয়ে আছে। 

বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, আন্দোলনের কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ রেখে জমায়েত আরও বাড়ানো গেলে সরকারের ওপরও চাপ বাড়বে। তাদের ধারণা, যুক্তরাষ্ট্রের বিধিনিষেধের কারণে সরকার আগের মতো বাড়াবাড়ি করতে চাইবে না। এ ছাড়া ভিসানীতিতে ব্যক্তির পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের ওপর বিধিনিষেধ আরোপের বিষয়টি যুক্ত থাকায় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপরও সরকারের নিয়ন্ত্রণ কমে যেতে পারে। তাই আসন্ন কর্মসূচিগুলোকে গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের বিভাগীয় সমাবেশগুলোর গণ-অংশগ্রহণমূলক করার চিন্তা করছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। 

এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ে আমাদের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। বিএনপি এতদিন যেভাবে কর্মসূচি পালন করে আসছে, এখনও সেভাবেই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলন চা‌লি‌য়ে নি‌য়ে যা‌বে।

বিএন‌পি নীতিনির্ধারকরা বলছেন, সাম‌নের দি‌নে আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি এমনভাবে প্রণয়ন করা হবে, যাতে তরুণরা আরও বেশি সম্পৃক্ত হয়। এ লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকাসহ কয়েকটি বিভাগীয় শহরে ‘তরুণ সমাবেশ’ করারও পরিকল্পনা করছে দলটি। বিএনপির ছাত্রসংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল এবং দুই অঙ্গসংগঠন যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল তারুণ্যের এ সমাবেশ আয়োজন করবে। ইতোমধ্যে তিনটি সংগঠনের শীর্ষনেতারা এই বিষ‌য়ে যৌথ সভাও করেছেন। তবে এ সমাবেশ কবে, কোথায় এবং কখন করা হবে, তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীর কর্মসূচি আগামী ৮ জুন শেষ হ‌বে। এরপর আগামী ১০ জুন চট্টগ্রামে তরুণ সমাবেশের মধ্য দিয়ে এ বিভাগীয় কর্মসূচি শুরু হতে পারে ব‌লে জানা গে‌ছে।