রাইজিংবিডি স্পেশাল

লোডশেডিংয়ের বিকল্প দেখছে না মন্ত্রণালয়

বাংলাদেশে চলমান গ্রীষ্ম মৌসুমে তীব্র দাবদাহের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে। তার ওপর রামপাল, আশুগঞ্জ ও রাউজানে ১ হাজার ৬১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। ফলে, লোডশেডিং বেড়েছে। জ্বালানি সঙ্কটের কারণে বন্ধ হচ্ছে পটুয়াখালীর ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন। তাই, এ মুহূর্তে লোডশেডিংয়ের বিকল্প দেখছে না বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। 

বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হতে আরও ২০ থেকে ২৫ দিন সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ খান বিপু। প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, দেশে বর্তমানে প্রায় ১ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হচ্ছে।

এর আগে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছিল, দেশে চলমান গ্রীষ্ম মৌসুমে তীব্র দাবদাহ এবং পবিত্র রমজান মাসের জন্য বিদ্যুতের চাহিদা অত্যধিক বেড়ে যাওয়া, রামপাল ৫০০ মেগাওয়াট থার্মাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, আশুগঞ্জ ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র ও চট্টগ্রাম (রাউজান) ২১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র ত্রুটির কারণে বন্ধ থাকা এবং হাটহাজারী ১৩২/৩৩ কেভি গ্রিড উপকেন্দ্রের পিটি বিস্ফোরণের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাওয়ায় লোডশেডিং হচ্ছে।

কর্তৃপক্ষ আশা করেছিল, শিগগির এ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসবে। কিন্তু, জ্বালানি সমস্যার কারণে সমাধান করা যায়নি। 

নির্বাচনী ইশতেহারের অংশ হিসেব বর্তমান সরকার শতভাগ বিদ্যুৎ নিশ্চিত করেছিল। কিন্তু, ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল, গ্যাসসহ বিদ্যুৎ তৈরির উপকরণের দাম বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে পরিবহন ব্যবস্থায় সমস্যা তৈরি হয়। দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়ে কয়লা। দেখা দেয় ডলার সঙ্কটও। 

এসবের প্রভাবে বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও বিদ্যুতের জন্য হাহাকার তৈরি হয়। সরকারের পক্ষ থেকে রুটিন করে লোডশেডিং হয়। কিন্তু বাকি সব ধাক্কা অনেকটা সামলে নেওয়া গেলেও কয়লার সঙ্কট সমাধান করা যায়নি। 

কয়লা সঙ্কটে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় (১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট) পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রে। দুই ইউনিটের কেন্দ্রটির এক ইউনিটের উৎপাদন গত ২৫ মে বন্ধ হয়। মজুদ কয়লা দিয়ে এতদিন চললেও দ্বিতীয় ইউনিট পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আগামী ৫ জুন। দেশের বড় এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ হলে ফের বাড়তে পারে লোডশেডিং।

কেন এই কয়লা সঙ্কট: সংশ্লিষ্টরা জানান, ডলার সঙ্কটের কারণে গত এপ্রিল পর্যন্ত পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত কয়লার বিল বকেয়া পড়েছে ৩৩৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। সময়মতো বকেয়া পরিশোধ করতে না পারায় সম্প্রতি চীনের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ কয়লা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সিএমসিকে কয়লা আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। 

পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি যৌথ উদ্যোগে নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি (বিসিপিসিএল), চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন (সিএমসি) এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কম্পানি লিমিটেড (এনডাব্লিউপিজিসিএল)।

পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিট চালু রাখতে দৈনিক ১১ হাজার থেকে ১২ হাজার মেট্রিক টন কয়লা প্রয়োজন। বিসিপিসিএল সূত্রে জানা গেছে, এই কয়লা বাকিতে কেনা হয়। ছয় মাস পর পর কয়লার দাম পরিশোধ করতে হয়। কেন্দ্রটিতে যে কয়লা প্রয়োজন হয়, তার জোগান দেয় চীনের সিএমসি। ইন্দোনেশিয়া থেকে মূলত কয়লা আসে। বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, কয়লার বাকি টাকা দীর্ঘদিন পরিশোধ করতে না পারায় চীনের মুদ্রা নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ফলে মে মাসে কয়লা আমদানির কোনো ঋণপত্র খুলতে পারেনি সিএমসি। এমন পরিস্থিতিতে বিদ্যুকেন্দ্রটিতে কয়লার সঙ্কট দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিপিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ এম খোরশেদুল আলম বলেছেন, ‘এপ্রিল মাস পর্যন্ত বকেয়া ছিল প্রায় ৩৩৫ মিলিয়ন ডলার। মে মাসে আমরা ৫৮ মিলিয় ডলার পরিশোধ করেছি। আরও ৪২ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। যারা আমাদের কয়লা সরবরাহ করে, তারা বলেছে এলসি খোলার জন্য। জুনের শুরুতে এলসি খোলা হলে কয়লা আসতে ২৫ দিন লেগে যাবে। সে হিসাবে জুন মাসে বিদ্যুকেন্দ্রটি চালু রাখা নিয়ে সংশয় আছে।’

২ হাজার মেগাওয়াটের ওপরে লোডশেডিংয়ের আশঙ্কা: বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) কর্মকর্তারা বলছেন, পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিট থেকে দিনে গড়ে প্রায় ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছিল। কয়লা সঙ্কটে একটি ইউনিট বন্ধ থাকায় আরেকটি ইউনিট থেকে এখন দিনে প্রায় ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। দ্বিতীয় ইউনিটের উৎপাদন বন্ধ হলে আগামী ৫ জুন থেকে আরও ৪০০ মেগাওয়াটের চাহিদা যোগ হয়ে ২ হাজার মেগাওয়াটের ওপরে লোডশেডিং হবে। 

আজ সাভারে এক অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও বলেছেন, কয়লা আমদানি করতে আরও অন্তত ২০-২৫ দিন সময় লাগবে।

জ্বালানি সঙ্কটের কারণে চলমান লোডশেডিং আরও কিছু দিন অব্যাহত থাকবে, জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, আমাদের এখানে এলসি খুলতে দেরি হয়েছে। পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়ও ছিল। এখান থেকে একটা বড় বিদ্যুৎ আমরা পাচ্ছি না সিস্টেমে। এ কারণে আমি মনে করি যে, কিছুটা জনদুর্ভোগ হচ্ছে। লোডশেডিং বেড়ে গেছে কয়েকটা বিদ্যুৎকেন্দ্র কাজ না করাতে। তেলের ব্যাপারে আমরা রীতিমতো হিমসিম খাচ্ছি। এখন বেশিরভাগ গ্যাস আমরা ইন্ডাস্ট্রিতে ডাইভার্ট করছি।

তিনি আরও বলেন, আবার আবহাওয়া অনেক গরম। ৩৮ ডিগ্রির ওপরে চলে গেছে। কোনো কোনো জায়গাতে ৪০-৪১ ডিগ্রি হয়ে গেছে। এই কারণে আমরা খুবই দুঃখিত এই বিষয়ে। আমাদের এই মুহূর্তে কিছুটা লোডশেডিং চলছে এবং এটা কিছুদিন যাবে। জাতীয় গ্রিডে প্রায় ১৭০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং চলছে।