সারা বাংলা

পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় সুনামগঞ্জে 

ভারত সীমান্তে খাসিয়া ও জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত হাওরকন্যা হিসেবে পরিচিত জেলা সুনামগঞ্জ। জেলার ঠিক উত্তর দিকের খুব কাছে মেঘালয়ের অবস্থান। তাই স্থায়ীভাবে তৈরি মেঘ ও জলীয়বাষ্প সরাসরি পাহাড় অতিক্রম করতে পারে না। ফলে আকাশে মেঘমালা তৈরি হয়। এই মেঘে মেঘে ঘর্ষণের ফলে বজ্রপাতের সংখ্যা বেশি হয়ে থাকে এ পাহাড় পাদদেশে অবস্থিত সুনামগঞ্জে। 

জেলায় এত ঘন ঘন বজ্রপাত আর আশঙ্কাজনকহারে মৃত্যু বেড়ে যাওয়ায় মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে আতঙ্ক। বৃষ্টি বা মেঘলা পরিবেশ দেখলে কাজে কিংবা প্রয়োজনে বাসাবাড়ি থেকে বের হতে ভয় পান হাওরাঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষরা। তারা মনে করেন, মেঘলা আবহাওয়া বা বৃষ্টি মানেই যেন খোলা আকাশের নিচে থাকা লোকজনের ঠিক মাথার ওপরে আছে প্রাণঘাতী বজ্রপাত।

হাওর অধ্যুষিত সুনামগঞ্জ ধান উৎপাদনে উদ্বৃত্ত জেলা। নিজেদের চাহিদা পূরণ করে সারা দেশে সরবরাহ করা হয় হাওরে উৎপাদন হওয়া ধান। এছাড়াও এ জেলায় রয়েছে দেশের মৎস্য সম্পদেরও সবচেয়ে বড় আঁধার। মাছ ও ধান উৎপাদনে জেলে ও কৃষকরা ব্যস্ত থাকেন জেলার হাওরে। কিন্তু প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে হাওর এলাকায় ঝড়-বৃষ্টি সঙ্গে শুরু হয় বজ্রপাত। ফলে বজ্রপাতের আঘাতের প্রথম শিকার হন কৃষক, জেলে ও দিনমজুররা। আর দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে বজ্রপাতে মৃত্যুর মিছিল। যা প্রতি বছরে সংখ্যা বেড়ে চলছে। শুধু তাই নয়, একইসঙ্গে প্রাণ হারায় হাওরের গৃহপালিত পশুও। সেই সঙ্গে বহু মানুষ আহত হচ্ছে। 

গত ২০১৯ সাল থেকে ২০২২ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটে ২০২২ সালে। সুনামগঞ্জে ২০২২ সালে ১৯ জন, ২০২১ সালে ১১ জন ও ২০২০ সালে ১১ জনের প্রাণহানি ঘটে। এবং চলতি বছরে বজ্রপাতের মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২০ জনে। এরমধ্যে শুধু এপ্রিল মাসের এক দিনে ৬ জনসহ বজ্রপাতে ১০ জন মারা গেছে। সর্বশেষ (১৭ জুন) হাওরে মাছ ধরতে গিয়ে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার এক জেলে ও নদী থেকে বালু উত্তোলন করতে গিয়ে বিশ্বরম্ভপুর উপজেলার দুই বারকি শ্রমিক বজ্রাঘাতে নিহত হন। এর আগে (১৫ জুন) হাওরে মাছ ধরতে গিয়ে বজ্রপাতে ছাতকে একজন জেলে ও দোয়ারাবাজারে আরেক জেলের মৃত্যু হয়।

সুনামগঞ্জে দিন দিন কী কারণে বজ্রপাত বেড়ে চলছে, তা নিয়ে দেশে তেমন গবেষণা নেই বলা যায়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা নাসা ও মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ জেলায়। আর বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটে হাওরাঞ্চলে। সম্প্রতি বজ্রপাত থেকে রক্ষায় দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে জেলার ৬টি উপজেলায় ১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ২৪টি বজ্রপাত নিরোধক দন্ড স্থাপন করা হয়েছে। তবে তাতেও কাজ হচ্ছে না। হাওরাঞ্চলে বজ্রপাতে মৃত্যু বেড়েই চলছে। এরমধ্যে বেশিরভাগ প্রান্তিক এলাকার কৃষিজীবী পরিবারের দিনমজুর, কৃষক, শিশু, কিশোররা।

বজ্রপাতে শহর এলাকায় হতাহতের ঘটনা শোনা না গেলেও বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির ক্ষতি হয়। বজ্রপাতে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি যেমন ফ্রিজ, টেলিভিশন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রগুলো ক্ষতির মুখে পড়ে। তাছাড়া বাসাবাড়িতে হার্টের রোগ বা হৃদরোগে আক্রান্ত মানুষদের নিয়ে বাড়তি দুশ্চিন্তায় থাকেন বাসিন্দারা। 

বজ্রপাত কেন হয়, আর কীভাবে হয়, সেই কথা জানালেন গবেষকরা, সাধারণ মানুষের জন্য দিলেন বেশ কিছু পরামর্শও। মেঘের ভিতর যখন প্রচুর পরিমাণে চার্জ জমা হয় তখন মেঘের ভিতর বড় স্পার্ক হয়। মাঝে মাঝে সেই চার্জ এত বেশি জমা হয় যে, সেগুলো ভূপৃষ্ঠের দিকে বিপরীত চার্জের আবেশ সৃষ্টি করে বাতাসকে আয়নিত করে ভূপৃষ্ঠের নেমে আসে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।

সুনামগঞ্জ টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজের (টিএসসি) অধ্যক্ষ মো. আজিজুল সিকদার রাইজিংবিডি-কে বলেন, বজ্রপাত একটি  প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এটি মূলত সৃষ্টি হয় মেঘমালার মাধ্যমে। মেঘ যখন ভেসে বেড়ায়, তখন প্রত্যেকটা মেঘের উপরে এবং নিচে, দুই ধরনের আয়ননেট সৃষ্টি হয়। এই উপরে যদি নেগেটিভ থাকে আর নিচে যদি পজেটিভ থাকে, তাহলে একটি মেঘমালা আরেকটি মেঘমালার পাশ দিয়ে যখন যায়, তখন এদের মাঝে আয়ন যুক্ত বিদ্যুৎয়ের উদ্ভব হয়। এবং এটি অতি ভোল্টেজের হয়। আমরা সাধারণত যে ভোল্টেজের বিদ্যুৎ একজায়গা থেকে অন্য জায়গা ট্রান্সফার করি তাদের চেয়ে বহুগুণে বেশি থাকে এই বিদ্যুতে। আমাদের ন্যাশনাল গ্রিডে ১ লাখ ৩২ হাজার ভোল্টেজের লাইন আছে, এটা বাতাসের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে না। কিন্তু বজ্রপাতের সময় যে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়, এটি কয়েক লাখ ভোল্টেজের। এটি বাতাসের ভিতর দিয়ে ভূপৃষ্ঠে চলে আসে। এই কারণে যখন এটি ভূপৃষ্ঠে চলে আসে, তখন যার উপরে পড়ে, সেটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমাদের দুশ্চিন্তার কারণ সুনামগঞ্জ এলাকা বজ্রপাতের দূর্যোগপূর্ণ এলাকা। বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা হওয়ায় প্রচুর মেঘমালা হয়। এই মেঘমালা থেকে ঝড় যেমন হয়, তখন প্রচুর বৃষ্টি হয়। জেলার পার্শ্ববর্তীতে অনেক পাহাড় রয়েছে।  এটি সাধারণত অতি চার্জস যুক্ত মেঘমালা সৃষ্টি করে, ফলে এখানে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়।

এসময় তিনি মানুষকে সচেতন ও নানা পরামর্শ দিয়ে আরও বলেন, যদি এই এলাকায় প্রত্যেকের বাড়িতে একাধিক তাল গাছ, সুপারি গাছ, নারিকেল গাছ, লাগাতে পারি, তাহলে এক সময় অর্থকরী ফসল পাওয়ার পাশাপাশি বজ্রপাতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভাবনা অনেকটা বেড়ে যাবে। এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রচুর টাওয়ার স্থাপন করা যায়, তাহলে জীবনহানির হাত থেকে রক্ষা করা যেতে পারে। 

হাওরাঞ্চলের মানুষকে বাঁচাতে বজ্র ঠেকানোর জন্য বাংলাদেশ সরকার দ্রুত সময়ের মধ্যে বিজ্ঞান ও বাস্তব সম্মত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এবং প্রতিটা হাওরে হাওরে, হাওর জনপদে বজ্র নিরোধক দন্ড স্থাপন করা অতি জরুরী বলে মনে করেন পরিবেশ ও হাওর আরেক গবেষক।

হাওর এরিয়া আপলিস্টমেন্ট সোসাইটির (হাউস) নির্বাহী পরিচালক সালেহীন চৌধুরী শুভ রাইজিংবিডি-কে বলেন, ‘সারা দেশেই বজ্রপাত বৃদ্ধি প্রবণতা লক্ষণীয়, এর মধ্যে হাওরাঞ্চল ( সুনামগঞ্জে) বজ্রপাত বৃদ্ধির হার অত্যন্ত বেশি। বিগত ২০-২৫ বছর যাবত, এই ধারা অব্যাহত রয়েছে। সুনামগঞ্জে এমন কোনো সপ্তাহ নেই যে বৃষ্টি হয় না। আর বৃষ্টি হলে বজ্রপাত হয়, আর বজ্রপাত হলে মানুষ মারা যাবে এটা যেন অবধারিত। এখানে এমনও দেখা গেছে, এক বজ্রপাতে কয়েকজন মানুষ মারা যায়। এমনকি ১৩ জন মানুষ মৃত্যুর রেকর্ড আছে এ জেলায়। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা নাসা ও মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি যৌথ গবেষণায় পত্রে দেখা যায়, মার্চ থেকে জুন এই সময়কালে সারা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় সুনামগঞ্জ। তাই সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের মানুষকে বাঁচাতে অবিলম্বে বজ্র ঠেকানোর জন্য বিজ্ঞান ও বাস্তব সম্মত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আমি মনে করি প্রতিটা হাওরে হাওরে, হাওর জনপদে বজ্র নিরোধক দন্ড স্থাপন করা অতি জরুরী।’

সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী বলেন, হাওরাঞ্চলে আরও বেশি করে বজ্র নিরোধক দণ্ড স্থাপন করার বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে। এবং বজ্রপাতে হতাহতের ঘটনায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহায়তার কথা জানালেন তিনি। 

তিনি আরও বলেন, সুনামগঞ্জ যেহেতু হাওর বেষ্টিত এলাকা। প্রত্যেক বছর এখানে বজ্রপাতসহ বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। বিস্তীর্ণ এলাকা বলে এখানে প্রত্যেক বছর বজ্রপাতে কিছু লোকের প্রাণহানি ঘটে থাকে। সেটা সুনামগঞ্জে পরিমাণে অনেক। সরকার এই বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন আছে, ইতোমধ্যে অনেক জেলায় তাল গাছ রোপন করা হচ্ছে। কিন্তু হাওরাঞ্চল তাল গাছ রোপন উপযোগী না, কারণ এখানে পানি থাকে বলে তাল গাছ বাঁচে না। এই বিষয়টি লক্ষ্য রেখে ত্রাণ ও  দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপন করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত সারা জেলায় ২৪টি দণ্ড স্থাপন করা হয়েছে। সব উপজেলায় এখন স্থাপন করা হয়নি কিন্তু সরকার চেষ্টা করছে এবং নতুন করে প্রজেক্ট হাতে নেওয়া হচ্ছে, যাতে বজ্রপাতের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করা যায়।