সারা বাংলা

চাঁপাইনবাবগঞ্জে দুই মাসে শতাধিক মোটরসাইকেল চুরি!

বেলেপুকুরের বাড়ি থেকে গত ৭ আগস্ট মোটর সাইকেল চুরি হয় ব্যবসায়ী দানিউল হকের। প্রতিদিনের মতো দুপুরে মোটরসাইকেল নিয়ে বাড়িতে খেতে যান তিনি। বাড়ির ভেতরেই মোটরসাইকেলটি রাখেন। খাওয়া শেষে কিছু সময় বিশ্রামের পর নামাজ পড়ার উদ্দেশে ওজু করতে যান তিনি। তখনও তার মোটরসাইকেলটি যথাস্থানেই ছিলো। কিন্তু ওজু শেষে দেখেন মোটরসাইকেলটি আর নেই। 

দানিউল হক বলেন, ‘মাত্র ৪-৫ মিনিটের ব্যবধানেই চোরেরা আমার মোটরসাইকেলটি নিয়ে যায়। অথচ মোটরসাইকেলের হ্যান্ডেল লক করা ছিলো। ওই সময়ের মধ্যে চোর হ্যান্ডেল লক ভেঙে মোটরসাইকেলটি নিয়ে যায়। ঘটনার দিনই সদর থানায় অভিযোগ দিলেও এখন পর্যন্ত কোন অগ্রগতি নেই’।

পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে মাত্র ৪০০ মিটার দূরের মহল্লা বেলেপুকুর। এ মহল্লায় ১৭ দিনের ব্যবধানে অন্তত ৮ টি মোটরসাইকেল চুরি হয়েছে। চোরের ভয়ে আতঙ্কে দিন কাটছে মহল্লাবাসীর।

শুধু বেলেপুকুরই নয়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাজুড়ে চলছে মোটরসাইকেল চুরির হিড়িক। পুলিশ সদস্য, প্রশাসনের কর্মকর্তা থেকে সাধারণ মানুষ, মোটরসাইকেল চুরি থেকে বাদ যাচ্ছে না কেউ-ই। জেলায় মোটরসাইকেল চুরির ঘটনা বেড়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন- চোর চক্রকে উৎখাতে কাজ করছেন তারা।

স্থানীয় ও বেসরকারি সূত্রগুলো বলছে, গত দুই মাসে চাঁপাইনবাবগঞ্জ চুরি যাওয়া মোটরসাইকেলের সংখ্যা শতাধিক। তবে পুলিশ সুপারের কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, এ বছর মামলা হয়েছে মাত্র ৯ টি চুরির ঘটনায়। এর বাইরে বেশি কিছু অভিযোগ জমা হয়েছে থানায়। অভিযোগের সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি।   

চাঁপাইনবাবগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল কালাম সাহিদ জানান- দুই মাসে জেলার বিভিন্ন থানায় মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগ হয়েছে। অভিযোগগুলো আমলে নিয়েছে পুুলিশ। অভিযোগ পর্যালোচনা করে চোরদের ধরতে সব ধরনের তৎপরতা চলমান রয়েছে।

বেলেপুকুর মহল্লা থেকে বেশিরভাগই মোটরসাইকেল চুরি করতে চোরেরা ৫ মিনিটের কম সময় নিয়েছে। এ থেকে ভুক্তভোগীদের ধারণা সংঘবদ্ধ চোর দলের দক্ষ সদস্যরাই এই চুরির সঙ্গে জড়িত। এই মহল্লা থেকে একজন পুলিশ কর্মকর্তা, একজন মোহরারের মোটরসাইকেল চুরি হয়েছে। 

বেলেপুকুরে ভাড়া বাড়িতে থাকা একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হাসান আলীর মোটরসাইকেলটি চেষ্টা করেও চুরি করতে পারেনি চোরেরা। হাসান আলী জানান, একদিন বিকালে কয়েকজন চোর তার মোটরসাইকেলটি চুরির জন্য হ্যান্ডেল লক ভেঙে ফেলে। ঠিক ওই মুহূর্তেই তিনি বাইরে বের হন। তাকে দেখে চোরেরা দৌড়ে পালিয়ে যায়। এরপর থেকেই মোটরসাইকেল নিয়ে ব্যাপক আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন তিনি।

১১ আগস্ট সদর উপজেলার চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়নের ল্যাংড়ারমোড়ের একটি মসজিদের সামনে থেকে মোটর সাইকেল চুরি হয় তরিকুল ইসলাম নামের এক যুবকের। তিনি জানান, মসজিদের সামনে মোটরসাইকেলটি রেখে নামাজে যান তিনি। নামাজ পড়ে এসে দেখেন মোটরসাইকেলটি নাই। আশেপাশে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কোন হদিস পাওয়া যায়নি। পুলিশের উপর হতাশা থেকে তিনি থানায় কোনো অভিযোগও দেননি। তরিকুল ইসলাম জানান, চুরি হওয়া মোটরসাইকেল উদ্ধার করতে পারে না পুলিশ, উল্টো মোটরসাইকেল মালিকদের হয়রানীর শিকার হতে হয়। তাই তিনি অভিযোগ দেন নি।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার দূর্গাপুরের মুক্তারুল ইসলামের মোটরসাইকেল চুরি হয় ২০ আগস্ট। ওইদিন তিনি থানায় অভিযোগ করতে গিয়ে শোনেন একইদিন আরো তিনজনের মোটরসাইকেল চুরি হয়েছে।

 ৩১ জুলাই সদর উপজেলার ঘুসিরাপুকুর এলাকা থেকে গোলাম আজম সারোয়ার, আগষ্ট ২২ তারিখ দুপুরে নিয়ামতনগর থেকে মামুন ও ১৩ এপ্রিল এ কে এম এল রহমান চৌধুরী, ২৩ জুলাই সার্কিট হাউজ রোড থেকে নাসিম আল আরাফাত, ১ সেপ্টেম্বর বটতলা হাট মাংসপট্টি থেকে তোসিকুল ইসলামের মোটরসাইকেল চুরি হয়। তারা সবাই থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

মোটরসাইকেল চুরির শিকার একাধিক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন- জেলাজুড়ে এত মোটরসাইকেল চুরি হলেও পুলিশ অজ্ঞাত কারণে নিরব ভূমিকা পালন করছে। মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগ নিয়ে থানায় গেলে পুলিশ তাদের নিরুৎসাহিত করে। পুলিশ কর্মকর্তারাই বলেন- অভিযোগ করে কি করবেন। এতক্ষণে মোটরসাইকলে জায়গামতো পৌঁছে গেছে। ওটা আর পাবেন না’। এক ভূক্তভোগি ক্ষোভ ঝেড়ে বলেন ‘কিছুদিন আগে নাটোরে চুরির বেশ কিছু মোটরসাইকেলসহ চোর চক্রকে ধরে পুলিশ। কিন্তু চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুলিশ ঘুমাচ্ছে।’

অনুসন্ধানে জানাগেছে, সংঘবদ্ধ অন্তত চারটি চক্র সক্রিয় রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জে। এদের বেশিরভাগ সদস্যই জেলার বাইরে থেকে আসে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় বাসা ভাড়া বা মেস অথবা হোটেল অবস্থান করেন। এরপর টার্গেট অনুযায়ী মোটরসাইকেল চুরি করে চম্পট দেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্রও এই তথ্য নিশ্চিত করেছে। সূত্রগুলো জানিয়েছে- চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে চুরি হওয়ায় মোটরসাইকেলর অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে দেখা গেছে বেশিরভাগ মোটরসাইকেল চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে রাজশাহীর দিকে নিয়ে গেছে চোরেরা। শহরের বিশ্বরোড মোড় থেকে দ্বারিয়াপুর মোড় পর্যন্ত সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে এ তথ্য নিশ্চিত হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শহরের আরামবাগ, মাষ্টারপাড়া, শাহীবাগসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় অবস্থান করে জেলার বাইরে থেকে আসা চোরেরা। তারা আগে টার্গেট ঠিক করে নেয় কোন মোটরসাইকেলটি চুরি করবে। তারপর সেই মোটরসাইকেলটিকে অনুসরণ করা শুরু করে। এক পর্যায়ে সুযোগ বুঝে মোটরসাইকেল চুরি করে পালিয়ে যায়। চুরি যাওয়া মোটরসাইকেলগুলো নিয়ে যাওয়া হওয় রাজশাহী ও নওগাঁর একাধিক গ্যারেজে। সেখানে পৌঁছামাত্রই মোটরসাইকেল সব পার্টস আলাদা করে ফেলা হয়। পরবর্তীতে আবারে পার্টস জোড়া দিয়ে বিক্রি করা হয়।