খেলাধুলা

ইতিহাসে বিশ্বকাপ : ১৯৬২ বিশ্বকাপের শিরোপাও সাম্বার দেশে

আয়োজক নির্ধারণ : ইউরোপ টানা দুটি বিশ্বকাপ (১৯৫৪ ও ১৯৫৮) আয়োজন করে। ফলে ১৯৬২ বিশ্বকাপের আয়োজক হতে আমেরিকান ফুটবল ফেডারেশন ফিফাকে এক প্রকার হুমকি দিয়ে বসে। তারা জানায় ১৯৬২ বিশ্বকাপ দক্ষিণ আমেরিকার কোনো দেশে আয়োজিত না হলে তারা ১৯৩৮ সালের মতো টুর্নামেন্ট বর্জন করবে। এই বিশ্বকাপের আয়োজক হতে চিলি, আর্জেন্টিনা ও জার্মানি আগ্রহ প্রকাশ করে। জার্মানিকে বুঝিয়ে আগেই সরিয়ে নেয় ফিফা। আয়োজক হতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় চিলি ও আর্জেন্টিনার মধ্যে। ভোটাভুটিতে চিলি ৩২ ভোট পেয়ে আয়োজক নির্বাচিত হয়। আর আর্জেন্টিনা পায় মাত্র ১১ ভোট।

নতুন দল : কলম্বিয়া ও বুলগেরিয়া প্রথমবারের মতো এই বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। অনুপস্থিত দল : সুইডেন, ফ্রান্স ও অস্ট্রেয়া এই বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়।

নতুনত্ব : এই বিশ্বকাপের পরই ফিফা আইন করে, যদি কোনো খেলোয়াড় একবার কোনো জাতীয় দলের হয়ে বিশ্বকাপ খেলে থাকে সে আর অন্য কোনো দেশের হয়ে বিশ্বকাপ খেলতে পারবে না। ফ্রেঞ্চ পুসকাস, হোসে শান্তামারিয়া ও হোসে আলতাফানি ১৯৫৮ বিশ্বকাপ এক দলের হয়ে খেলার পর ১৯৬২ বিশ্বকাপে অন্য দলের হয়ে খেলেন। বিতর্ক ও তুচ্ছ ঘটনা : এটাই ছিল প্রথম বিশ্বকাপ যেটা ইউরোপে টেলিভিশনে সম্প্রচার হয়নি। সেমিফাইনালে ব্রাজিলের তারকা খেলোয়াড় গারিনকাকে লাল কার্ড দেয়া হয়েছিল। ফলে তিনি ফাইনালে খেলার যোগ্যতা হারান। কিন্তু ব্রাজিলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ত্রানক্রেদো নেভাস ফিফাকে বিষয়টি ভালোভাবে বুঝিয়ে লাল কার্ড তুলে নিতে অনুরোধ জানান। ফলে ফিফা লাল কার্ড তুলে নেয় এবং গারিনকা ফাইনালে খেলতে পারেন।

গ্রুপপর্বে ইতালি ও স্বাগতিক চিলির ম্যাচে মারাত্মক ফাউলের ঘটনা ঘটে। যা ফুটবল ইতিহাসে ‘ব্যাটেল অব সান্তিয়াগো’ নামে পরিচিত। এ বিষয়ে ওই ম্যাচের রেফারি কেন অ্যাস্টন বলেছিলেন, ‘আমি কোনো ফুটবল ম্যাচ পরিচালক করিনি। আমি মিলিটারির কোনো কৌশলগত যুদ্ধের আম্পায়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি।’

বাছাইপর্ব : ১৯৬২ বিশ্বকাপে অংশ নিতে ৫৭টি দল আগ্রহ প্রকাশ করে। শেষ পর্যন্ত ৫২টি দল বাছাইপর্বে অংশ নেয়। আয়োজক দেশ হিসেবে চিলি এবং ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ব্রাজিল সরাসরি বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে।

বাকি ১৪টি দল বাছাইপর্ব খেলে বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। এই ১৪ দলের ৮টি ইউরোপ থেকে, ৩টি দক্ষিণ আমেরিকা থেকে, ১টি করে আফ্রিকা, এশিয়া, উত্তর আমেরিকা ও সেন্ট্রাল আমেরিকা থেকে সুযোগ পায়।

স্কোয়াড : এই বিশ্বকাপে প্রতিটি দল ২২ জন করে খেলোয়াড় নিয়ে দল ঘোষণা করে। কেবল উরুগুয়ে ২৩ জন নিয়ে দল ঘোষণা করে।

ফরম্যাট : এই বিশ্বকাপের ফরম্যাট ১৯৫৮ বিশ্বকাপের অনুরুপ ছিল। ১৬টি দলকে চারটি গ্রুপে ভাগ করা হয়। প্রত্যেক গ্রুপ থেকে পয়েন্টের ভিত্তিতে সেরা দুটি দল পরের রাউন্ডে উত্তীর্ণ হয়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে থাকা দলের পয়েন্ট সমান হলে প্লে-অফের মাধ্যমে পরের রাউন্ডে যাবে বিজয়ী দল। জয়ের জন্য ২ পয়েন্ট এবং ড্রয়ের জন্য ১ পয়েন্ট দেয়া হয়।

গ্রুপপর্ব : ষোলোটি দলকে ৪টি গ্রুপে ভাগ করা হয়। ‘এ’ গ্রুপে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুগোস্লাভিয়া, উরুগুয়ে ও কলম্বিয়া। এখান থেকে সেভিয়েত ইউনিয়ন ও যুগোস্লাভিয়া দ্বিতীয় রাউন্ড তথা কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে। ‘বি’ গ্রুপে ছিল পশ্চিম জার্মানি, চিলি, ইতালি ও সুইজারল্যান্ড। এই গ্রুপ থেকে পশ্চিম জার্মানি ও চিলি কোয়ার্টার ফাইনালের টিকিট পায়।

‘সি’ গ্রুপে ছিল ব্রাজিল, চেকোস্লোভাকিয়া, মেক্সিকো ও স্পেন। কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে ব্রাজিল ও চেকোস্লোভাকিয়া। ‘ডি’ গ্রুপে ছিল হাঙ্গেরি, ইংল্যান্ড, আর্জেন্টিনা ও বেলজিয়াম। কোয়ার্টার ফাইনালে সুযোগ পায় হাঙ্গেরি ও ইংল্যান্ড।

কোয়ার্টার ফাইনাল : নক আউট পর্বে মুখোমুখি হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন-চিলি, ব্রাজিল-ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট জার্মানি-যুগোস্লাভিয়া, হাঙ্গেরি ও চেকোস্লোভাকিয়া। এই রাউন্ড থেকে যথারীতি সেমিফাইনালের টিকিট পায় ৪টি দল চিলি, ব্রাজিল, যুগোস্লাভিয়া ও চেকোস্লোভাকিয়া।

সেমিফাইনাল : সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয় চিলি-ব্রাজিল ও যুগোস্লাভিয়া-চেকোস্লোভাকিয়া। স্বাগতিক চিলিকে ৪-২ গোলে উড়িয়ে দিয়ে ফাইনালে ওঠে ব্রাজিল। অন্যদিকে যুগোস্লাভিয়াকে ৩-১ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের মতো ফাইনাল নিশ্চিত করে চেকোস্লোভাকিয়া। সেমিফাইনালে ব্রাজিলের হয়ে জোড়া গোল করেন গারিনকা ও ভাভা।

ফাইনাল : ১৯৬২ সালের ১৭ জুন অনুষ্ঠিত ফাইনালে ১৫ মিনিটের মাথায়ই পিছিয়ে পড়ে ব্রাজিল। অবশ্য ১৭ মিনিটেই আমারিলদোর গোলে সমতায় ফেরে তারা। ১-১ গোলের সমতা নিয়েই বিশ্রামে যায় উভয় দল। বিরতির পরের গল্পটা কেবলই ব্রাজিলের। ৬৯ মিনিটে জিতোর গোলে লিড নেয় সাম্বার দেশ। ৭৮ মিনিট ভাভার গোলে চেকোস্লোভাকিয়ার পরাজয়ের ষোলোকলা পূর্ণ হয়। টানা দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা জিতে নেয় ফুটবলের পরাশক্তি ব্রাজিল।

এক নজরে ১৯৬২ বিশ্বকাপআয়োজক : চিলিতারিখ : ৩০ মে-১৭ জুন, ১৯৬২দল : ১৬টিভেন্যু : ৪টিচ্যাম্পিয়ন : ব্রাজিলরানার্স আপ : চেকোস্লোভাকিয়াতৃতীয় : চিলিচতুর্থ : যুগোস্লাভিয়ামোট ম্যাচ : ৩২টিমোট গোল : ৮৯টিমোট দর্শক : ৮ লাখ ৯৩ হাজার ১৭২ জনসেরা খেলোয়াড় : গারিনকা (ব্রাজিল)

বি.দ্র: ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বিশ্বকাপের ট্রফির নাম ছিল ফিফার প্রথম সভাপতি জুলের রিমের নামানুসারে ‘জুলে রিমে ট্রফি’। এটা ফিফা বিশ্বকাপ ট্রফি হয় ১৯৭৪ বিশ্বকাপ থেকে।

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ জুন ২০১৪/আমিনুল