কৃষি বিভাগের সর্বশেষ হিসাবমতে— মুন্সীগঞ্জ জেলার ৬৩টি হিমাগারে এখনও আলু সংরক্ষিত রয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার ৩৯ মেট্রিক টন। বীজ আলু রয়েছে ৭৬ হাজার ৯৯৪ মেট্রিক টন। জেলায় এ বছর মোট আলুর ফলন হয়েছে ১০ লাখ ৫৬ হাজার ৪৬৩ মেট্রিক টন। ইতিমধ্যে প্রায় সাড়ে ৯ লাখ মেট্রিক টন আলু খাবারের জন্য বিক্রয় হয়েছে। অবশিষ্ট মাত্র সোয়া ১ লাখ মেট্রিক টন আলু দিয়ে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত মুন্সীগঞ্জসহ সারা দেশের ভোক্তা পর্যায়ে আলুর চাহিদা পূরণে সংকট তৈরি হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন জেলার হিমাগার মালিক, ব্যবসায়ী ও কৃষকসহ আলুভিত্তিক চাষের উপর নির্ভরশীল সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে, সরকার নির্ধারিত দামে খুচরা পর্যায়ে আলু ৩৬/৩৭ টাকা বেধে দিলেও বাজারে আলু বিক্রি হচ্ছে আগের ৪৫ টাকা দরে। তবে হিমাগারগুলো থেকে ৩০ টাকা দরে আলু বের হচ্ছে বলে হিমাগার সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। হিমাগার মালিকদের দাবি, হিমাগার থেকে ২৭-৩০ টাকায় আলু বের হলেও খুচরা পর্যায়ে ৪৫ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খুচরা ব্যবসায়ীরাই অতিরিক্ত মুনাফা করছে। সংকট আসলে সেখানেই তৈরি হচ্ছে।
অন্যদিকে, খুচরা ব্যবসায়ীদের আঙ্গুল হিমাগার মালিক ও পাইকার আরতদারদের দিকে। তাদের দাবি, ‘পাইকারি ব্যবসায়ীরা কোনোভাবে সরকারের বেধে দেওয়া দামে আলু দিচ্ছে না। আড়তদার থেকে নিয়ে আমরা কেজিতে মাত্র ২/৩ টাকা লাভ করি।’
স্থানীয় সুত্রে জানা যায়, বাজার নিয়ন্ত্রণে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মুন্সীগঞ্জে ৬ উপজেলায় ১০ ট্রাক আলু সরকার নির্ধারিত দরে ৩৬ টাকায় বিক্রয় করা হয়। প্রশাসনের এই আলু সংগ্রহে ক্রেতাদের ভিড় লক্ষ্যক করা গেছে।
দেওভোগ বাজার থেকে আলু ক্রয় করেছেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক রশীদ আহমেদ। তিনি জানান, এভাবে কি বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। এভাবে বাজার আরও অস্থিতিশীল করে তুলছে। সারা দেশের মানুষ যাতে আলু ন্যায্য মূল্য পায় এই জন্য সুষম বণ্টনের ব্যবস্থা করা দরকার। নইলে আলুর বাজারে আরও সংকট তৈরি হতে পারে। তখন দাম নিয়ন্ত্রণ করা আরও অসম্ভব হয়ে পড়বে।
মুন্সীগঞ্জ কদম রসুল হিমাগারের ব্যবস্থাপক প্রশান্ত কুমার মন্ডল দুলাল বলেন, ‘কৃষি বিভাগের হিসাবের সঙ্গে সব সময় আমাদের হিসাব মেলে না। তাদের মাঠপর্যায়ের লোকজন মাঠ থেকে সঠিক তথ্য দেয় না। এ বছর বৈরী আবহাওয়াসহ (সময়মত বৃষ্টি না হওয়ায়) নানা কারণে গত বারের তুলনায় ৩০ ভাগ আলুর ফলন কম হয়েছে। আবাদ হয়েছেও কম। এই তথ্য কৃষি বিভাগে পাবেন না।’
আলু বর্তমান অবস্থা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দুলাল মন্ডল আরও বলেন, ‘আলুর ফলন কম হওয়াতে এবার বাসা বাড়িতে সংরক্ষিত আলু দ্রুত শেষ হওয়ার কারণে হিমাগার অন্যান্য বছরের তুলনায় আলু ২ মাস আগেই খুলে দিতে হয়েছে। সাধারণত আলু মৌসুমে হিমাগার আগস্ট মাসে খুলে দেওয়া হয়। এবার আলুর সংকট থাকায় জুনের প্রথম সপ্তাহে খুলে দিতে হয়েছে। এসব কিছুই এবার আলুর বাজারে প্রভাব পড়েছে। এবার শুরুতে আলুর সংকটের কারণে ২/৩ টি হিমাগার ব্যতিত বাকি হিমাগার পরিপূর্ণভাবে আলু সংরক্ষণ করতে পারেনি। গত ২ বছর আলুতে কৃষক, ব্যবসায়ী ও হিমাগার মালিক লোকসান গুনলেও সব হিমাগার আলুতে পরিপূর্ণ ছিল।’
সিরাজদিখান উপজেলার মালখানগর তালতলা এলাকার আলু চাষি মো. মাসুদ বলেন, ‘গত ২০২১ ও ২০২২ সালে আলুতে আমার ৪০ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। গত বছর আলুর দাম বস্তা প্রতি (৫০ কেজি) ২০০ টাকা হওয়ায শেষ পর্যন্ত হিমাগার ভাড়া উঠবে না ভেবে হিমাগার থেকে আলু আর আনতে যাইনি। সব মিলে গত ২ বছরের লোকসান কাটিয়ে এবার ভালো দাম পাব ভেবেছি, এমন অবস্থায় সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রশাসন থেকে দাম বেধে দিয়ে আলুর বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। গত ২ বছরের মতো এবারও যদি কৃষক, ব্যবসায়ী ও হিমাগার মালিক লোকসান গোনে তবে আগামীতে আলু ভিত্তিক অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়বে।’
সদর উপজেলা টরকী গ্রামের আলু চাষি জাকির হোসেন বেপারী বলেন, ‘গত ২ বছর যখন আমরা আলুতে লোকসান খেয়ে আবারও ধারদেনা করে আলু চাষ করি, আবার যেন ঘুরে দাঁড়াতে পারি। শুরুতে আলু তোলার পরে এপ্রিল মাসে লগ্নির টাকা পরিশোধ করতে ৫০০ বস্তা আলু ১৫ টাকা কেজি দরে জমি থেকে বিক্রি করে দেই। বাকি ১ হাজার বস্তা হিমাগারে রাখি ভালো দাম পাওয়ার আশায়। কিন্তু এমন অবস্থায় সরকার আলুতে দাম নির্ধারণ করে আমাদের আশায় গুড়েবালি করে দিয়েছে। এক কেজি মুলা ৬০ টাকা, ধুন্দোল ৮০ টাকাসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় শাকসবজির দামও চড়া। কই সরকারতো সেইগুলির দাম বেধে দেয়নি। আমরা গত ২ বছর যখন লোকসান গুনলাম তখনও যদি সরকার থেকে আমাদের কথা ভেবে দাম বেধে দিত, তখন আমরা এত লোকসান হতো না। এবার আমাদের লাভ কম হলেও চলতো।’
জেলা কৃষি সম্প্রসাণ অধিদপ্তর সুত্রে জানা যায়, চলতি বছর জেলায় ৩৪ হাজার ৩৪৬ হেক্টর জমিতে আলু আবাদ হয়। গত বছরের তুলনায় এবার ১৪ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে আলু আবাদ কম হয়। ২ বছর আলুতে লোকসান খেয়ে চাষিরা ভুট্রা ও সরিষা চাষে ঝুকেছেন। আলুর ফলন কম হওয়াতে শুরুতে ১৪ থেকে ২০ টাকা দরে বাসা বাড়ি ও জমিতে সংরক্ষিত আলু জুলাই মাসের মধ্যে সব বিক্রি হয়ে যায়। ফলে ২ মাস আগে জুনের মধ্যে হিমাগার খুলে দিতে হয়।
জেলা কঞ্জুমার এসোসিয়েশণ অব বাংলাদেশের সভাপতি জাহাঙ্গীর সরকার মন্টু বলেন, হিমাগারে কৃষকের চেয়ে ব্যবসায়ীরাই আলু রেখেছে বেশি। মুনাফা অতিরিক্ত করা ঠিক না। কৃষক যদি এই অতিরিক্ত মুনাফা পেত, তাও হতো। হিমাগারে আলু মজুতদার ও ব্যবসায়ীরাই বেশি লাভ নিয়ে যাচ্ছে। এরসঙ্গে খুচরা ব্যবসায়ীরা যুক্ত রয়েছে। এ সব কারণে সরকার নির্ধারিত দাম, যাতে যে কোনোমুল্যে কার্যকর করা হয়, সেই দিকে স্থানীয় প্রশাসনকে ভুমিকা রাখতে হবে।
এদিকে খোজ নিয়ে জানা যায়, বুধবারও হিমাগারগুলো থেকে সরকার নির্ধারিত মুল্যে রশিদের মাধ্যমে আলু বের হয়েছে। হিমাগার থেকে আলু বের হওয়া ব্যবসায়ীরা বন্ধ করে দিয়েছে— এমন অপপ্রচার গত কয়েক দিন ধরে ছড়িয়ে পড়লেও এমন তথ্যের ভিত্তি নেই বলে উড়িয়ে দেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক হাবিবা নাসরিন।
হাবিবা নাসরিন জানান, হিমাগারগুলোতে এখনও ১ লাখ ২৬ হাজার মেট্রিকটন খাবার আলু রয়েছে। সরকারের বেধে দেওয়া দামে ব্যবসায়ী ও কৃষকের লোকসান হবে বলে জেলা প্রশাসকের কাছে দাম বৃদ্ধির জন্য দাবি জানিয়েছেন। তবে প্রশাসন থেকে হিমাগারে ২৭ টাকা ও খুচরা পর্যায়ে ৩৬ টাকা দরেই বিক্রির সিদ্ধান্ত বহাল রাখেন।
জেলা ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আব্দুস সালাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা হিমাগার ও বাজার দুই স্থানেই অভিযান অব্যাহত রেখেছি। যেখানে অনিয়ম দেখছি, সেখানেই জরিমানাসহ দণ্ড দেওয়া হচ্ছে। সরকারের বেধে দেওয়া দামে আলু বিক্রি করা না হলে আমাদের অভিযান ও নজরদারি অব্যাহত থাকবে।’