সারা বাংলা

যশোরে ইটভাটার আগুনে পুড়লো ৩০ হেক্টর জমির ধান

স্বামী তালাক দেওয়ার পর থেকেই ৩৫ কাঠা জমিতে চাষাবাদ করে সংসার চলে শামসুর নাহারের (৫২)। সেই জমিতে ধারদেনা করে মাস পাঁচ আগে হাবু ধান রোপন করেছিলেন তিনি। ধান বপন, রোপন থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত তার খরচ হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। অন্যের কাছে ধার-দেনা করে, লোন তুলে এই খরচ করেছেন। সার ও কীটনাশকের দোকানেও বাকি পড়েছে। আশা ছিলো ধান ঘরে তোলার পর ধার-দেনা, লোন ও বাকি পরিশোধ করবে। এখন ভাটার প্রভাবে পুরো ফসল নষ্ট হয়েছে।

শুধু যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার দোহাকুলা মাঠের শামসুর নাহার নয়, এই গ্রামের প্রায় দেড় শতাধিক কৃষকের স্বপ্ন পুড়েছে ইটভাটার আগুনে।

শামসুর নাহার বলেন, ‘মাঠের ৩৫ শতক জমিই আমার সম্বল। এই জমিতে চাষাবাদ করে যা ফসল হয় তাই দিয়েই সংসার চলে। ধার দেনা করে ৩৫ কাঠা জমিতে আমন ধান লাগিয়ে ছিলাম। প্রায় ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ধান না হলে এই টাকা কিভাবে শোধ করবো আর কিভাবেই সংসার চালাবো’।

তিনি বলেন, ‘একটি ধানের দানাও পাওয়া যাবে না। এখন নিজে খাবো কী, আর ধারদেনা ও লোনই বা পরিশোধ করবো কী দিয়ে এই চিন্তাতেই দিনা পার করতে হচ্ছে।’

বাঘারপাড়ার দোহাকুলা মাঠের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা জানান, তাদের ধানক্ষেতের পাশেই ‘ফাইভ স্টার ব্রিক্স’ নামে একটি ইটভাটা রয়েছে। এই ভাটায় ইট পোড়ানোর পর ভাটা দ্রুত ঠান্ডা করতে মালিক গত রোববার রাতে চুলার মুখ খুলে দেন। এতে রাতে ভাটার আগুন ৩০ থেকে ৪০ হাত উপরে উঠে যায়। এ সময় ভাটার উত্তর ও উত্তরপশ্চিম পাশের দুই শতাধিক বিঘা (৩০ হেক্টর) জমির আমন ধানের পাতাসহ গাছ পুড়ে গেছে। কমপক্ষে ১৫০ জন কৃষকের আমন ধানের ক্ষতি হয়েছে। মাঠের বেশির ভাগ জমিতে গুটিস্বর্না ও হাবু ধানেরগাছগুলো লালচে হয়ে পুড়ে গেছে। কোথাও কোথাও শীষসহ পুরো গাছই পুড়ে গেছে। 

পাশাপাশি টমেটো, লিচু, কলাসহ অন্যান্য ফসল পুড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা হয়েছে দেড় শতাধিক কৃষকের। এসব কৃষক পরিবারের আশঙ্কা, যদি এসব ফসলের ক্ষতিপূরণ পাওয়া না যায় তাহলে পরিবার-পরিজন নিয়ে তাদের না খেয়ে দিন কাটাতে হবে।

এ ঘটনা পর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও কৃষি কর্মকর্তার কাছে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা লিখিত অভিযোগ করেছেন। অভিযোগ পেয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও কৃষি কর্মকর্তা ক্ষতিগ্রস্ত মাঠ পরিদর্শন করেছেন এবং কৃষকদের সাথে কথা বলেছেন। তবে কৃষকদের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়গুলো নিয়ে উপজেলা প্রশাসন কাজ করছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার।

মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, দোহাকুলা মাঠের উত্তর পশ্চিম মাঠের ধানের গাছগুলো কালো ও লালচে বর্ণ হয়ে গেছে। পুড়ে গেছে সদ্য বের হওয়া ধানের শীর্ষগুলোও। এছাড়া আখ ক্ষেতের বিভিন্ন পাতা, ও বিভিন্ন সবজির ক্ষেতেও গাছের পাতাগুলোও পুড়ে গেছে। বাসাবাড়ির বিভিন্ন জলপাই গাছ, পেয়ারা গাছের পাতাও পুড়ে গেছে। ইটভাটার একেবারেই কাছের জমিটি দোহাকুলা এলাকার মোস্তাক হোসেনের। পাশাপাশি দুই খণ্ডে তার প্রায় আড়াই বিঘা জমি। দুটি জমির ধানই তার পুড়ে গেছে ভাটার আগুন ও ধোঁয়াতে।  তিনি বলেন, ‘এই পরিবেশ দেখা যায় বলেন! এত কত কষ্ট করে এতদিন ধরে পরিশ্রম করে আমার ধানের এই অবস্থা। কি করবো ভাবতে পারছি না’।

আবু তালেব বলেন, ‘অনেক টাকা খরচ করে ছয় বিঘা জমিতে ধানের আবাদ করেছিলাম। কিছুদিনের মধ্যে ধানের মোচা আসা শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু এর আগেই পাশের ফাইভ স্টার ইটভাটার আগুন ও ধোঁয়ায় এলাকার সব ক্ষেতের ধান পুড়ে গেছে। আমরা চরমভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছি’।

আকতার হোসেন বলেন, ‘মাঠে তো ধান আখ সবজি নষ্ট হয়েছে। বাড়ি এসে একটু শান্তি করে ঘুমাবো; সেইটুকু করা যাচ্ছে না ইটভাটার কারণে। যখন ভাটার ইট পোড়ানো হয় তখন বাড়ি থাকা যায় না। গন্ধ বের হয়। ছোট্ট বাচ্চারা কাশি দেয়। আব্দুর রউফ মোল্লার পাঁচ বিঘার জমির সব ধানেই পুড়ে গেছে। ইটভাটার আগুনে এতবড় ক্ষতি হলো। ইটভাটা হওয়ার পর থেকে এখানে চাষাবাদে সমস্যা হচ্ছে। তিনি কৃষি জমির পাশ থেকে ইটভাটা উচ্ছেদের দাবি জানান।

এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইয়েদা নাসরিন জাহান জানান, তিনি এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সরেজমিনে ওই মাঠ পরিদর্শন করেছেন। প্রায় ৩০ হেক্টর জমির ধানক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কৃষকরা বলছেন, ইটভাটার আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিষয়টি তদন্তের জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাকে (কৃষি কর্মকর্তা) তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছেন। তিনি দ্রত তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করবেন।

বাঘারপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হোসনে আরা তান্নি বলেন, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। ঘটনা তদন্তে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর এ ব্যাপারে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

অভিযোগের ব্যাপারে ‘ফাইভ স্টার ব্রিক্স’র মালিক শাহিন হোসেন বলেন, ‘গত ৭/৮ মাস ধরে ভাটা চলছে। কৃষকের কোনো ক্ষতি হয়নি। হঠাৎ করে মাঠের ধানগাছ লাল হয়ে যাওয়ায় ভাটার দোষ দেওয়া হচ্ছে। ভাটার আগুন-ধোঁয়ায় দু-এক বিঘা জমির ধান নষ্ট হতে পারে। কিন্তু দুইশ বিঘা জমির ধানগাছ তো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে না’।