সারা বাংলা

আলোর ফাঁদের ব্যবহার জনপ্রিয় হচ্ছে সিরাজগঞ্জে 

রোপা আমন ধান খেতে কীটনাশক ব্যবহার না করে ক্ষতিকর পোকা দমনে সিরাজগঞ্জের ৯টি উপজেলায় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ‘আলোর ফাঁদ’ এর ব্যবহার। এই ফাঁদ খেতের পাশে পেতে রাখলে ক্ষতিকর পোকা আলোতে আকৃষ্ট হয়ে ফাঁদে আটকা পড়ে মারা যায়।

স্থানীয় কৃষকেরা জানান, আলোর ফাঁদ ধানের পোকা দমনে একটি পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি। এই ফাঁদ তৈরিতে বৈদ্যুতিক বাল্ব ও সৌরবিদ্যুতের সোলার প্যানেল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ফাঁদটি ধানখেত থেকে ১০০ মিটার দূরে বাঁশের খুঁটির সাহায্যে মাটি থেকে ২-৩ ফুট ওপরে লাগানো হয়। একটি বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বালিয়ে এর নিচে একটি পাত্রে ডিটারজেন্ট পাউডার অথবা কেরোসিন মিশ্রিত পানি রাখা হয়। সন্ধ্যার পর এই আলোর ফাঁদের আলোয় আকৃষ্ট হয়ে ধানখেতের বিভিন্ন পোকামাকড় এসে পাত্রের পানিতে পড়ে মারা যায়। অতি অল্প খরচে তৈরি এ আলোর ফাঁদ অন্ধকার রাতে দেখতেও বেশ দৃষ্টিনন্দন। এটি ব্যবহার করে আমরা বেশ উপকৃত হচ্ছি।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে জেলার ৯টি উপজেলায় ৭৫ হাজার ৪৪৫ হেক্টর জমিতে আমন ধানের চাষ অর্জিত হয়েছে। কোনো প্রকৃতিক দুর্যোগ না হলে এবারে বাম্পার ফলনের সম্ভবনা রয়েছে। ইতোমধ্যে সদর উপজেলায় ১২ হাজার, কাজিপুরে ১১ হাজার ১০০, কামারখন্দে ৫ হাজাার ৭৪৩, রায়গঞ্জে ১৯ হাজার ১৭৪, তাড়াশে ১৩ হাজার ৬৯২, উল্লাপাড়ায় ১১ হাজার ৫০৫, শাহজাদপুরে ২৬০, চৌহালীতে ১৬১, বেলকুচিতে ১ হাজার ৮১০ হেক্টর জমিতে স্থানীয় জাতের আব্দুল গুটি, কাটারী ভোগ, ব্রি-৯০, ব্রি- ৪৯, ব্রি-৫১, ব্রি-৫৮, ব্রি-৩৪ ও ব্রি-৩৬ জাতের রোপা আমন ধান আবাদ করেছেন চাষিরা। চলতি মৌসুমে জেলার ৯টি উপজেলায় ১ হাজার ৫০টি আলোর ফাঁদ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ক্ষতিকর পোকা চিহ্নিত করণসহ তা দমনে কাজ চলছে। সপ্তাহের প্রতি রোববার স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে নিয়ে জেলার বিভিন্ন ব্লকে আলোর ফাঁদ প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা।

সদর উপজেলার শিয়ালকোল ইউনিয়নের শ্যামপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল মমিন বলেন, এ মৌসুমে সময় মতো বৃষ্টি হওয়ায় এবং সারের কোনো ঘাটতি না থাকায় ধানের জমিগুলোতে বেশ ভালো ফলনের আশা করছি। কিন্তু ধানের থোড় আসার সময় জমিতে ইঁদুরের আক্রমণ দেখা দিয়েছে। ইঁদুর আমাদের কাঁচা ধান গাছ কেটে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

তাড়াশ উপজেলার দেশিগ্রামের কৃষক জাহিদুল ইসলাম বলেন, আলোর ফাঁদ তৈরি করে জমিতে পোকা দমনে অনেকটাই সফলতা পেয়েছি। সেই সঙ্গে এই ফাঁদ দিয়ে ক্ষতিকারক পোকা সম্পর্কে ধারণা নিয়ে কৃষি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে অল্প পরিমাণ কীটনাশক প্রয়োগ করেছেন রোপা আমনের জমিতে। এতে কীটনশাক খরচ গত বছরের চেয়ে অর্ধেকের কম হয়েছে।

উল্লাপাড়ার পুর্ণিমাগাঁতী গ্রামের আব্দুল মমিন, ইউসুফ আলী, নবির উদ্দিন, আরমান সরকার, শরিফুল ইসলাম, মোবারক হোসেনসহ একাধিক কৃষক জানান, বর্তমানে রোপা আমনের কিছু জমিতে রাসায়নিক সার দেওয়ার পর থেকেই কিছু বাদামী ঘাস ফড়িং বা কারেন্ট পোকা, পাতা মোড়ানো পোকা ও চুঙ্গি-মাজরাসহ নানা ধরনের ক্ষতিকারক পোকার আক্রমণ দেখা দেয়। তবে আলোর ফাঁদ ব্যবহারের কারণে এসব পোকা তেমন দেখা যাচ্ছে না।

সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা (কৃষিবিদ) আনোয়ার সাদাত বলেন, আলোর ফাঁদ ব্যবহারে কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ খুব একটা নেই। মাজরা পোকা কিছু ছিল। বৃষ্টির কারণে এবং প্রয়োজনীয় কিটনাশক প্রয়োগের ফলে তা আর নেই বললেই চলে। তবে পাতা মোড়ানো পোকার আক্রমণ রয়েছে। তা দমনে কৃষকদের প্রয়োজনীয় কিটনাশক ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ইঁদুরের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য কৃষকদের ধানের জমিতে বিলি করে দিতে, জমিতে কলা গাছের খোসা দিতে এবং ইঁদুরের গর্তের মুখে কিটনাশক ও গ্যাসের ট্যাবলেট রাখার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। আশা করি আমরা ক্ষতিকর পোকা ও ইঁদুর দমন করে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সক্ষম হবো।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ডিডি) বাবলু কুমার সূত্রধর জানান, চলতি মৌসুমে জেলায় ৭৫ হাজার ৪৪৫ হেক্টর জমিতে আমন ধানের আবাদ হয়েছে। আলোর ফাঁদ প্রযুক্তিটি কৃষকদের জন্য খুবই উপকারী একটি পদ্ধতি। কৃষকরা আলোর ফাঁদ ব্যবহার করে উপকৃত হচ্ছে। ইচ্ছে করলে এ পদ্ধতিটি যে কোনো কৃষক নিজ উদ্যোগেও ব্যবহার করতে পারেন।

তিনি আরও বলেন, জমিতে যাতে পোকা ফসল নষ্ট না করতে পারে তার জন্য কৃষকদের আলোর ফাঁদ বা পাচিং পদ্ধতির মাধ্যমে  প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে। এখন ফসল উৎপাদনে কীটনাশকের ব্যয় অনেক কমে এসেছে। যে কারণে আলোর ফাঁদ বা পাচিং পদ্ধতি দিনদিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তবে ক্ষতিকর পোকা না থাকলে আলোর ফাঁদ ব্যবহারের কোনো প্রয়োজন নেই।