খেলাধুলা

সাফল্যের গল্পে ‘বিরাট’ পরিশ্রমের নিবেদিত ‘কোহলি’

কাগিসু রাবাদার বলটা কভারে ঠেলেই খুলে ফেললেন হেলমেট। ব্যাট তুললেন আকাশপানে। উঠে দাঁড়িয়েছে পুরো ইডেন। মুহুর্মুহু করতালির সঙ্গে ‘বিরাট… বিরাট’ চ্যান্ট। তুমুল উল্লাসে মেতে উঠেছে ‘সিটি অব জয়’ খ্যাত কলকাতা। অথচ যে ছেলেটার জন্য সমগ্র ভারত এক হয়ে ইডেনকে মহসমুদ্রে পরিণত করলো, তিনি কলকাতার নয়, দিল্লির ঘরের ছেলে।

সৌরভ গাঙ্গুলি নয়, আজ কলকাতার ‘মহারাজা’ হয়ে ইডেনের ঘাসজুড়ে শাসন করে গেলেন বিরাট কোহলি। তুলে নিলেন ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ৪৯তম শতক। ছুঁয়ে ফেললেন ‘ক্রিকেট ঈশ্বর’ শচীন টেন্ডুলকারকে। জন্মগত প্রতিভার বলে নয়, স্রেফ পরিশ্রম আর নিবেদন এক করে নিজের সাথে লড়াইয়ে ঈশ্বরের শিখরে অধিষ্ঠিত হলেন ভারতীয় ক্রিকেটের বরপুত্র।

লড়াইটা কেমন? ২০১৯ থেকে ২০২২! তিনটে বছর, একদম মোক্ষম সময়ের হিসেব ধরলে ১০২০ দিন। এই সময়ের মাঝে একটা শতকের জন্য তৃষ্ণার্ত কাকের মতো উড়ে বেরিয়েছেন কোহলি। কিন্তু সেঞ্চুরি নামক জলটুকুর নাগাল পাননি। বিদ্ধ হয়েছেন সমালোচনার তীরে। সবাই তার ‘শেষ’ দেখে ফেলেছিল এক নিমিষে! কিন্তু কোহলি পরিশ্রম করে গেছেন। তার অভিধানটাই তো এমন; শেষের গল্প থেকে নতুন অধ্যায়ের শুরু।

রঞ্জি ট্রফির ম্যাচ। দিল্লির হয়ে ব্যাট করছিলেন কিশোর কোহলি। খবর এলো পিতৃবিয়োগের। দিনের খেলা শেষে ছুটলেন দিল্লিতে। শেষকৃত্য শেষেই আবার মাঠে। আটত্রিশ ইঞ্চির উইলোর প্রতিটি ইঞ্চিতে পিতার ‘শেষকৃত্যের’ শোক নিয়ে কোহলি হয়ে উঠলেন দিল্লির ত্রাতা। ভারতীয় ক্রিকেট জানান দিলো নতুন ঊষার আগমনী বার্তা। পিতার মৃত্যু থেকে সেঞ্চুরিহীন হাজার দিন; প্রতিটা শেষ থেকেই হয়েছে কোহলির শুরু। আঁধারের নিস্তব্ধতা ভেঙে দেখা দিয়েছে আলোর রোশনাই।

বিনোদ কাম্বলি কিংবা শচীনের মতো জন্মগত প্রতিভা ছিল না। স্বপ্ন ছিল, শিখর ছোঁয়ার নেশা ছিল। পরিশ্রম আর নিবেদনের এক দৃঢ় মেলবন্ধন ছিল। কোহলি তার প্রতিফলন দেখিয়েছেন বাইশগজে। ব্যাটের বিচ্ছুরণ ছড়িয়ে দিয়েছেন উন্মাতাল গ্যালারির প্রতিটি প্রান্তরে। ছোট্ট বিরাট থেকে হয়েছেন দেড়’শ কোটি মানুষের কোহলি।

শচীনের ৪৯ সেঞ্চুরির রেকর্ড কোহলি ছুঁয়েছেন মাত্র ২৭৭ ইনিংসে। যেখানে স্বয়ং শচীনের লেগেছিল এর প্রায় দ্বিগুণ অর্থাৎ ৪৫১ ইনিংস। ২০০৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর মাত্র ২১ বছর বয়সে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডেতে প্রথমবার তিন অংকের ম্যাজিক ফিগার ছোঁয়া বিরাট এক যুগের বেশি সময় পর এসে স্পর্শ করলেন ৪৯তম ম্যাজিক ফিগার।

যার রেকর্ডে কোহলি ভাগ বসালেন, কীর্তিতে হয়ে উঠলেন যশস্বী। সেই শচীনের ভাষ্য? আনন্দে যেন ঢেউ খেলে গেল মাস্টার ব্লাস্টারের মনে, ‘দারুণ খেলেছো বিরাট। চলতি বছরের শুরুতে (বয়স) ৪৯ থেকে ৫০-এ যেতে আমার ৩৬৫ দিন লেগেছিল। আমি আশা করছি তুমি ৪৯ থেকে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ৫০-এ পৌছে যাবে এবং আমার রেকর্ডটা ভেঙে দিবে।’ অগ্রিম অভিন্দনও জানিয়ে রাখলেন তাকে।

কোহলি জবাব দেন ব্যাটে, তাকে ঘৃণা করা ব্যক্তিকেও বাধ্য করেন ভালোবাসতে, মোহ করে ফেলেন ব্যাটিং সৌন্দর্য্যের অদ্ভুত মায়ায় কিংবা পেশাদারিত্বের সর্বোচ্চ চেষ্টার প্রতিফলনে। ক্রিকেটও তাকে দিচ্ছে দু’হাত ভরে। তিনি দেখিয়ে দিচ্ছেন পরিশ্রম কিংবা নিবেদনের সাথে কোনো আপোষ নয়।

আজ থেকে ঠিক এক শতাব্দী পরও যদি ক্রিকেটের সৌন্দর্য্যের ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হয়, পরিশ্রম-নিবেদনে শূন্য থেকে শিখর ছোঁয়ার চূড়ান্ত উদাহরণ দেখতে চাওয়া হয়, তবে নির্দ্বিধায় বলে দেয়া যাবে কোহলির নাম। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম যাবে আসবে, ক্রিকেটে রথী-মহারথীদের তালিকাও ভারী হবে। কিন্তু তাদের কাছে একজন বিরাট কোহলি কিংবা পরিশ্রমের গল্পটা নতুনই রয়ে যাবে। যে গল্পের শেষের আদি কিংবা অন্ত নেই।