সাতসতেরো

বাংলাদেশে জলবায়ু দুর্যোগ, অভিবাসন এবং ভূমি অধিকার লিপিবদ্ধকরণ

জলবায়ু সংক্রান্ত আসন্ন আন্তর্জাতিক সংলাপের এই প্রাতক্ষণে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষক তাদের জীবন ও জীবিকার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলা বিভিন্ন জলবায়ু দুর্যোগ মোকাবেলায় সুদৃঢ় ও সুলিপিবদ্ধ ভূমি অধিকারের গুরুত্বের ওপর জোর দিচ্ছেন। এ ইস্যুতে তাদের কণ্ঠস্বর আরো জোরালো করতে ল্যান্ড পোর্টাল ফাউন্ডেশন ও গ্লোবাল ফোরাম অন এগ্রিকালচারাল রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন (জিফার)-এর সহযোগিতায় বাংলাদেশে এসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (এএলআরডি) এবং এশিয়ান এনজিও কোয়ালিশন ফর অ্যাগ্রেরিয়ান রিফর্ম অ্যান্ড রুরাল ডেভলপমেন্ট (অ্যানগক)-এর নেতৃত্বে একটি সোশ্যাল মিডিয়া ও তথ্য প্রচারাভিযান বা ক্যাম্পেইন চলমান রয়েছে।

এ সময়ে, আমরা সম্মিলিতভাবে এটি নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নিয়েছি যে, সবচেয়ে ঝুকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জলবায়ু অভিযোজন ক্ষমতা তৈরিতে ভূমি অধিকার যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, জলবায়ু সংক্রান্ত নীতিনির্ধারণের আলোচনায় সেটিকে যেন অবহেলা না করা হয়। আপনি #IfOnlyTheEarthCouldSpeak #landmatters #land4climate #COP28 -এই হ্যাশট্যাগগুলো ব্যবহার করে এবং টুইটারে আমাদের অনুসরণ করে আরও জানতে এবং অবদান রাখতে পারেন।

বাংলাদেশের বস্তির বাসিন্দাদের প্রায় ৭০ শতাংশ পরিবেশগত চ্যালেঞ্জের কারণে স্থানান্তরিত হয়েছেন। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দুর্যোগপ্রবণ দেশ। প্রধান নদ-নদীর প্লাবনভূমিতে অবস্থিত বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, ভূমির বৈশিষ্ট্য এবং মৌসুমী জলবায়ু দেশটিকে বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন প্রভাবে বাস্তুচ্যুত বাংলাদেশিদের সংখ্যা ৭.১ মিলিয়ন বা ৭১ লক্ষের ওপরে, যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫ শতাংশ। ২০৫০ সালের মধ্যে এ সংখ্যা ১৩.৩ মিলিয়ন বা এক কোটি ৩৩ লক্ষে পৌঁছাবে। যদিও অনুমিত এ সংখ্যা বিস্ময়কর, তবে এটি বড় কোনো সংবাদ নয়। বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; ১৯৮০ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে এ দেশকে মোট ২১৯টি প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হতে হয়।

ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম)-এর তথ্যমতে, বাংলাদেশের বস্তির বাসিন্দাদের প্রায় ৭০ শতাংশ পরিবেশগত চ্যালেঞ্জের কারণে স্থানান্তরিত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদন অনুসারে এটি দেশটির অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের এক নম্বর চালক। সংস্থাটি উল্লেখ করেছে যে আয় এবং জীবিকার একটি স্থিতিশীল উৎসের কাছাকাছি থাকার জন্য স্থানান্তরিত হওয়ার পেছনে রয়েছে অনিশ্চিত স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং নিরাপত্তা।

সম্ভবত এটি দীর্ঘস্থায়ী হতাশা এবং ভয়ের অনুভূতি যা গ্রামীণ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দাদের যার উপর তারা নির্ভরশীল সেই পরিবেশ রক্ষায় তৎপর করে তুলেছে, যাতে যেটিকে তারা ‘বাড়ি’ বলে সেখানে থাকতে পারে। ২০২০ সালে করোনা মহামারির তীব্রতার সময়েও হাজার হাজার গ্রামবাসীকে বাঁধ মেরামত করার সরকারি পরিকল্পনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে দেখা যায় কারণ সেটি তাদের জীবিকার অবলম্বন কৃষিজমির চাষাবাদে বাধা তৈরি করে। তাও এমন একটি জায়গায় যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ইতিমধ্যেই গ্রামীণ কৃষকদের জীবনে বিপর্যয়কর প্রভাব ফেলেছে। জমির মালিকানার সুস্পষ্ট দলিলের অভাবকে গ্রামবাসীদের অধিকারের দাবি প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে বাধা হিসাবে একজন সরকারী কর্মকর্তা উল্লেখ করেছেন। পালাক্রমে গ্রামবাসীরা বলেন, ‘আমরা আপনাদের সকলকে অনুরোধ করছি, দয়া করে আমাদের জমি কেড়ে নেবেন না। আমরা কখনই আমাদের জমি ছাড়ব না।’

জলবায়ু দুর্যোগ পরবর্তী ট্রমা মোকাবেলায় একটি 'বাড়ির অনুভূতি' একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান

২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলা আঘাত হানে এবং ২০২০ সালে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান যখন আবার এই অঞ্চলে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, তখন প্রতাপনগর গ্রামের আমজাদ হোসেন একবার নয়, দুবার গ্রাম ছেড়ে চলে যাবার কথা ভাবেন। জমির মালিক হলেও এই সত্যটি পরিবর্তন হয়নি যে এলাকায় ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় এবং জোয়ার-ভাটা তার বেশিরভাগ জমিকে অনুৎপাদনশীল করে তুলেছিল, যার বেশিরভাগই দুর্যোগের পরে বছরের পর বছর ধরে নোনা পানির নিচে ডুবে ছিল। অন্যান্য বেশিরভাগ প্রতিবেশীর মতো, আমজাদ হোসেনের জমিও অনেকাংশে অনুৎপাদনশীল হয়ে পড়ে। তার জীবিকা নির্বাহের ঝুঁকি ও প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও, জমির উপযুক্ত স্বত্ব থাকাই শেষ পর্যন্ত তাকে এবং তার পরিবারকে স্থানান্তরিত হতে নিরুৎসাহিত করেছিল।

বিপুল পরিমাণ কৃষি জমি বিকল্প বাঁধের বাইরে চলে গেছে। এ জমি উদ্ধারের কোনো উদ্যোগ নেই। আশাশুনি উপজেলার হরিশখালী গ্রাম থেকে তোলা ছবি

ভূমিহীনতা (বা ভূমি অধিকার বঞ্চণা) প্রায় ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রামীণ পরিবারের দারিদ্র্যের কারণ এবং প্রভাব উভয়ই বিবেচনা করা যেতে পারে। কিন্তু ভূমিস্বত্বে যাদের সুরক্ষিত ও লিপিবদ্ধ অভিগম্যতা আছে তারা কি দুর্যোগ-পরবর্তী ঘুরে দাঁড়ানো এবং অভিযোজন সক্ষমতার ক্ষেত্রে সত্যি কি ভালো অবস্থানে থাকেন? 

‘যাদের নিজস্ব জমি নেই তারা টিকতে পারেন না। তার কারণ শুধু এটি নয় যে তাদের জীবিকা নির্বাহের উপায় নেই বরং এটিও একটি কারণ যে তারা এমন জায়গায় থাকেন যেখানে তাদের কোন আইনগত প্রতিকার এবং অধিকার কোনোটাই নেই- এটি তাদের আরও খারাপ অবস্থার দিকে ঠেলে দিতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনজনীত দুর্যোগের পর ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য ঋণ প্রাপ্তি এবং সরকারি সামাজিক পরিষেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে ভূমির মালিকানার প্রমাণ দেখানো অপরিহার্য। সর্বোপরি, এমন কিছু যার সাথে আমরা সকলেই যোগসূত্র স্থাপন বা রিলেট করতে পারি, তা হল মানসিক সুবিধা যা 'বাড়ির অনুভূতি' থাকার ফলে আসে যা ওই সকল পরিবার বা জনগোষ্ঠীগুলোর নেই। এই পরিস্থিতিতে থাকা পরিবার ও জনগোষ্ঠীর পক্ষে ফিরে আসার জন্য একটি নিরাপদ জায়গা থাকা অত্যন্ত কঠিন।’ বলেছেন এএলআরডি-র কর্মসূচি কর্মকর্তা বুলবুল আহমেদ৷

একটি আইআইএসডি রিপোর্ট অনুসারে যা প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরে জমির মালিকানার বিভিন্ন দিককে নির্দেশ করে, পরিচয়পত্র বা উত্তরাধিকারের উদ্দেশ্যে মৃত্যু সনদের মতো মৌলিক নথিপত্রের মাধ্যমে জমির মালিকানা প্রমাণ করতে সক্ষম হওয়া দুর্যোগ ত্রাণ প্রচেষ্টার একটি অনাবিষ্কৃত দিক। এই ধরনের দলিল-প্রমাণাদির ক্ষতি, ভিন্ন ভিন্ন এবং মাঝে মাঝে বিরোধপূর্ণ প্রকৃতির আইন যার অধীনে দাবিগুলো পড়তে পারে- সেটি আনুষ্ঠানিক, প্রথাগত বা ধর্মীয় হোক- কর্তৃপক্ষের জন্য উপযুক্ত পদ্ধতিতে জমি সংক্রান্ত সমস্যাগুলি সমাধান করা আরও কঠিন করে তোলে।

ভূমি রেকর্ড ডিজিটাইজ করা একটি সম্ভাব্য সমাধান প্রদান করে, কিন্তু এটি প্রতিষেধক নয়

টেকসই উন্নয়নে ভূমি প্রশাসনকে সহায়তা করার জন্য ভূমি রেকর্ডের ডিজিটাইজেশন গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সর্বাঙ্গীণ (Comprehensive)  ভূমি তথ্য ব্যবস্থা শুধুমাত্র জমির রেকর্ড লিপিবদ্ধ করার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং আরও বিস্তৃতভাবে ভূমি-সম্পর্কিত পরিষেবার ভিত্তি তৈরি করে (উদাহরণস্বরূপ, বন্যার মতো দুর্যোগের পরে বিভিন্ন অধিকার পুনপ্রতিষ্ঠার জন্য ডিজিটাইজড ভূমি রেকর্ড অপরিহার্য)। বিভিন্ন জনগোষ্ঠী এবং আদিবাসী সংগঠনসমূহ ভূমি ডেটার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিচ্ছে এবং ভূমির উপর তাদের অধিকার জোরদার করছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ক্রমবর্ধমানসংখ্যক অংশীজন এবং উদ্যোগসমূহ এখন ভূমি ডেটাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। 

‘বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ক্রমবর্ধমানভাবে তাদের ভূমি-সম্পর্কিত ডেটার জন্য দাবি জোরদার করছে। একটি বর্ধিত সচেতনতা রয়েছে যে জলবায়ু দুর্যোগের ক্ষেত্রে এই ধরনের ডেটা শুধুমাত্র জনগোষ্ঠী বা কমিউনিটিগুলোকে দুর্যোগ-পরবর্তী প্রক্রিয়ায় তাদের জমির অধিকার সুরক্ষিত রাখা নিশ্চিত করতেই কেবল সাহায্য করে না, বরং বিভিন্ন অত্যাবশ্যকীয় ভূমিতে তাদের অধিকার প্রমাণ করা কিংবা তাদের প্রাপ্য সামাজিক পরিষেবা নিশ্চিত করতেও সাহায্য করতে পারে। নিজেদের সামাজিক সাহায্যের নিষ্ক্রিয় প্রাপক হিসাবে উপলব্ধির পরিবর্তে তাদের জমির অধিকার প্রমাণ করে এমন ডেটার সাহায্যে, তাদের এখন কর্তৃত্বের নবতর চেতনা বিদ্যমান যা প্রায়শই অধিকার পুণরুদ্ধারের একটি কঠিন প্রক্রিয়ায় রূপ নেয়।’ বলেছেন ল্যান্ড পোর্টালের জ্যৈষ্ঠ ভূমি তথ্য বিশেষজ্ঞ শার্ল-থম বেয়ার ।

ভূমি অধিকার বিষয়ক ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া প্লাটফরম ল্যান্ড পোর্টাল-এ প্রকাশিত মূল ইংরেজি থেকে নিবন্ধটি বাংলায় অনুবাদকৃত

ছবি: রফিকুল ইসলাম মন্টু