সারা বাংলা

সরকারি চাল খাচ্ছেন মৃত ব্যক্তিরা!

ফরিদপুরে একাধিক ডিলারের বিরুদ্ধে সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল বিতরণে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। তালিকার মৃত ব্যক্তিরাও ‘চাল উত্তোলন করে নিয়ে যাচ্ছেন’— এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে। 

জেলার সদর উপজেলার ৮ নং কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের ভাবানীপুর গ্রামের বিষ্ণুপদ দাস (৪৮) গত দুই বছরের বেশি হলো মারা গেছেন। অথচ সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল তার নামে নিয়মিত উঠানো হচ্ছে। কর্মসূচির ৮৭ নং কার্ডধারী মৃত বিষ্ণুপদ দাস ওই গ্রামের মৃত সুশীল কুমার দাসের ছেলে। অথচ, মারা যাওয়া ব্যক্তির ছবি পরিবর্তন করে তোলা হচ্ছে চাল। 

বিষ্ণুর ভাই সুশান্ত দাস রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমার ভাইয়ের ১০ টাকা কেজি চালের কার্ড ছিল। সে দুই-আড়াই বছর হলো মারা গেছে। তারপর থেকে আমরা চাল পায়নি। ডিলার কাবিরের কাছে গেয়েছি, মেম্বারের কাছেও, কেউ কিছু করল না। বর্তমান আবেদ মেম্বার আমাদের ডেকে বলল, তোমরা কি চাল পাও? আমরা বলি না। কিন্তু সে জানায়, তোমার মৃত ভাইয়ের চাল তো তুলে নিতেছে! কিন্তু কে নেয়, আমরা তা বলতে পারবো না’।

স্থানীয় বাসিন্দা শুনিল কুমার জানান, তালিকায় আমার ছবি মৃত বিষ্ণুর নামের ওপর বসানো। আমার নিজের অরিজিনাল আলাদা কার্ড আছে। সেই কার্ডে আমি চাল পাই। কিন্তু মানুষজন লিস্ট উঠানোর পর দেখি, আমার নিজের ছবি আবার সেখানে বসানো। শুনলাম, মারা যাওয়া বিষ্ণুর কার্ডের চাল অন্য কেউ তুলে নিচ্ছে। আমার ছবি অন্যায়ভাবে ব্যবহার করে যারা মরা মানুষের চাল উঠিয়ে খায়, তাদের বিচার চাই। 

মারা যাওয়া একাধিক ব্যক্তির নামে চাল উত্তোলন, নিয়মের বাইরে স্বামী-স্ত্রীর নামে কার্ড ইস্যু; একই পরিবারের একাধিক কার্ডসহ অনলাইন তালিকায় নাম আছে— এমন অসংখ্য মানুষ আবার চাল-ই পায় না। বহু কার্ডে দেখা গেছে, একই লোকের ছবি একাধিক কার্ডে।

৪নং ওয়ার্ডের ডিলার মো. সাইফুল ইসলামের তালিকায় কার্ড নং-১১২৬ আব্দুল করিম বেপারী, তারা মুন্সী-১৩৫৮, অশোক কুমার শীল-১৩৩২ মারা গেলেও, তাদের চাল উত্তোলন হচ্ছে। এ ছাড়াও, নাজমা বেগম-১২৭২, ফিরোজা বেগম-১৪৫২, আলাল মল্লিক-১২১৮, নিরাঞ্জন মালো-১২৮১, আবুল হোসেন-১৪৯২ আবার চাল পায় না। অন্যদিকে, একই পরিবারের একাধিক কার্ডধারী সদস্য সুপার শেখ-১৩৭২, ‘দুজন ভূঁইয়া ও শামেলা বেগম স্বামী-স্ত্রী’— এমন অনেক নামের তালিকা তৈরি করে চাল না পাওয়ার অভিযোগ করেন ৪নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবেদ আলী। আবার আবু বক্কর ছিদ্দিকের তালিকায় লিপি বেগম-২৩, শ্যামলী শীল-৫১২, কাউছার কাজী-১৫, বারেক সেক-৩৭২, ছালাম সেক-৩৮৭— এদের মত অনেকের তালিকায় নাম থাকলেও চাল না পাওয়ার অভিযোগ জানান মেম্বার ও স্থানীয়রা। 

২০১৬ সাল থেকে অসহায়, দরিদ্র ও নিম্নায়ের মানুষের জন্য ১০ টাকা কেজিতে চাল বিক্রির কর্মসূচি হাতে নেয় সরকার। বর্তমানে বছরের পাঁচ মাস একজন কার্ডধারী ব্যক্তি ১৫ টাকা দরে ৩০ কেজি চাল পেয়ে থাকেন। কিন্তু ইউনিয়নটির ২১০০ কার্ডের মধ্যে বহু অনিয়ম ও দুর্নীতি থাকায় ডিলারদের বিরুদ্ধে উপজেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ করে পরিষদ। 

ইতিপূর্বে একাধিক ডিলারের বিরুদ্ধে ওজনে চাল কম দেওয়াসহ নানা অপরাধে জরিমানা করেন খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তাবৃন্দ। জেলার সদর উপজেলার ৮নং কৃষ্ণনগর ইউনিয়ন বেশকিছু ভুক্তভোগী নারী-পুরুষ খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির তালিকায় নাম থাকা সত্বেও চাল না পেয়ে ইউনিয়ন পরিষদ, খাদ্য নিয়ন্ত্রক অফিস, প্রেসক্লাবসহ দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন অভিযোগ নিয়ে। 

সুরাপ খান-১৩৭৪ কার্ডধারী রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘চাল আনতে গেলে ডিলার বলে, তোমাদের কার্ড হয়নি। কার্ড আসলে চাল দেওয়া হবে। বাড়ি যাও, পড়ে ফোন দিবানে। আমার নামে চাল ওরা খায়, ওরা ছাড়া কারা খায়! আমরা চাল চাই, কার্ড চাই’।

বারেক শেখ-৩৭২ ও সাইফুল সিকাদার-১০৩২ রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমার সিরিয়াল নম্বরে কোনও চাল দেয় না। আমি চাল পাই না। কার্ড করেছি অনেক আগে। তাই ফুড অফিসে অভিযোগ জানাইছি’।

জাহানারা বেগম-১১৭৭ রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘কার্ড করার জন্য আমার ও আমার বাপের ছবি নিয়ে ফিঙার নিছে। এরপর আমার বাপের কার্ড দিয়ে আমারে চাল খাওয়াছে। আর আমার কার্ড যে করে দিছে, সে খায়। পরে মেম্বার বলেছে, কারও কাছে আর বইলেন না, ওরা আপনাকে চাল দেবে। তা-ও ডিলার কার্ডও দেয় না, চালও না। অভিযোগ দিতে ফুড অফিসে গেছি, প্রেসক্লাবে আসলাম’।

৪নং ওয়ার্ডের বড়মাধবপুর গ্রামের মৃত আব্দুল কমির বেপারী (১১২৬)’র মেয়ে রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমার বাবা এ বছর কোরবানির আগে মারা গেছেন। এখনও চাল পাই। কিছুদিন আগেও পাইছি। যা খাবো, তা তো আর মিথ্যা কথা বলব না’। 

জানতে চাইলে অভিযুক্ত ডিলার মো. সাইফুল ইসলাম বিল্লাল রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘চাল দেওয়ার সময় অনেক ভিড় থাকায় সবকিছু দেখা সম্ভব হয় না’। অনিয়ম-দুর্নীতির অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের রোষানল ও ষড়যন্ত্রের শিকার’। 

তিনি আরও বলেন, ‘বই বা কার্ড দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের না। এটার দায়িত্ব ফুড অফিসে। অনলাইনের নতুন ২০টি বই গত দেড় মাস আগে আমাকে দিয়েছেন। এখনও সেগুলোর চাল দেওয়া হয়নি। আমার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ প্রমাণ হলে, যে কোনো শাস্তি আমি মাথা পেতে নেব’।

আরেক অভিযুক্ত ডিলার আবু বক্কর সিদ্দিক কাবির রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমাদের কাজ হলো ফুড অফিস থেকে চাল উত্তোলন করা। দোকানে যে কার্ড নিয়ে যাবে, তাকে আমার চাল দিয়ে দিয়েছি। আমি কোনও অনিয়ম করিনি। ফুড অফিসে অভিযোগ গিয়েছে, কোতয়ালী ফুড অফিসার তদন্ত করছে। তদন্ত অফিসার বলতে পারবেন, আমাদের কোনও ভুল-ত্রুটি পেয়েছে কি না। সারা ইউনিয়নব্যাপী আমি চাল দিই। আমাদের কাছে কার্ড আসে, সেটা দেখে চাল বিতরণ করি’। তবে, মৃত ব্যক্তিদের কার্ডের বিষয়ে সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি। 

জানতে চাইলে ৮নং কৃষ্ণনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান একেএম বাদশা মিয়া রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘ডিলাররা নিজের ইচ্ছামত চাল বিতরণ করেন। মৃত ব্যক্তির চাল অন্য কেউ তুলে নেয়। এক পরিবারের একাধিক কার্ড আছে। কেউ পায়, কেউ না। এগুলো ডিলাররা আত্মসাৎ করে খাচ্ছেন। ইউনিয়নের ২১০০ কার্ডের মধ্যে প্রায় ৫০০ কার্ডের উপরে ঝামেলা আছে। বিভিন্ন অনিয়মের কারণে আমরা ডিলার বাতিলের দাবিতে উপজেলা প্রশাসন বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। গরিব, অসহায় ও হতদরিদ্র যেন খাদ্যবান্ধব চাল কম দামে ক্রয় করে খেতে পারে। সেই কার্ড নিয়ে যারা অনিয়ম-দুর্নীতি করছে, তাদের শাস্তি দাবি করছি’। 

সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার লিটন ঢালী রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে ৩-৪ মাস আগে লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তাকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়। তদন্ত করে দ্রুতই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ডিলারশিপ আইনের বাইরে কোনও অনিয়ম প্রমাণিত হলে, তাদের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে’।

জেলা প্রশাসক মো. কামরুল আহসান তালুকদার রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘শুধু কৃষ্ণনগর নয়, জেলার ৮১টি ইউনিয়নেই এই খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল বিতরণে অভিযোগ অনুযায়ী তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে’। 

উল্লেখ্য, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় জেলার ৮১টি ইউনিয়নে মোট ৮৬ হাজার ৩৫০ জন নারী ও পুরুষ কার্ডধারী সুবিধাভোগী রয়েছেন।