শিল্প ও সাহিত্য

উনিশ শ একাত্তর

চৈত্র মাসের অমাবস্যার রাত।   দূরে কোথাও থেকে থেমে থেমে গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। শহর থেকে পালিয়ে আসা কিছু নারী-পুরুষ হালিমের গোয়াল ঘরে আশ্রয় নিয়েছে। অন্ধকারে এতগুলো মানুষ জুবুথুবু হয়ে বসে আছে। উসখুস করছে। একটি শিশু খুঁৎখুঁৎ করে কেঁদে ওঠে। শিশুর মা কান্না থামাতে চেষ্টা করে। কান্নার শব্দ শুনে হালিম দরজা খুলে ভিতরে ঢোকে।   ‘কথা কয়েন না। কোনো কথা নাই। ওর কাদঁন থামান। একজনের লাগি বেবাক মরবেন!’ ‘ভাই, শব্দ তো একেবারে কাছেই মনে হয়।’ শহরের মানুষদের মধ্যে একজন হালিমের কানের কাছে এসে ফিসফি করে বলল।  ‘জ্বি। কাছে। একদম কাছে। আপনেরা একবারে চুপ থাকেন। ওর কাঁন্দন থামান। কষ্ট করি রাতখান কাটান। ফজর হইলে একখান ব্যবস্থা হইব।’

হালিম গোয়াল ঘর থেকে বেরিয়ে আবার অন্ধকারের মধ্যে সন্তর্পনে ঘরে ফিরে যায়। ঘরের এক কোণে ফরিদা জবুথুবু হয়ে বসে আছে। বাইরে তখনও প্রচণ্ড গোলগুলির শব্দ হচ্ছে।  ‘হেরা এত মাতের ক্যানে?’ ফরিদা ফিসফিস করে জানতে চাইল। ‘বিপদে পড়ল্যে বেবাক মাইনষ্যে ছটফট করে।’ ‘এতো গুলির শব্দ!’ ‘যুদ্ধ শুরু হয় গেছে। মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতার যুদ্ধ।’  ‘এত খবর পাইলা কত্তুন তুঁই?’ ‘বাজারে টানজিস্টারে হুনছিলাম। এন্ডিয়ার আকাশবাণী আর বিবিসি বেবাক খবর কয়।’  ‘তাইলে তুঁই আগে যাইনতা?’ ‘বুঝতে পারছিলাম যুদ্ধ ঘনায় আইছে। তবে কুন সময় হইব হেয়ান বুঝি নাই।’ ‘শব্দ তো মনে হয় জোড়াপইরের কাছে হইব।’ ‘না ... না আরো কাছে। আরো কাছে।’ ‘এহানে মুনে হয় থাহন নিরাপদ না।’ ‘কয় যাইবা?’ ‘বুঝবার পারছি না। চল, খাটের নিচে ঢুকি যাই। হেই জায়গায় গুলি লাগত না।’

ওরা দুজন ঘাটের নিচে ঢুকে পড়ে। তারপরও ফরিদার কথা থামে না।  ‘অহন আমরার কী করার আছে?’ ‘মুক্তিবাহিনীর লাগি কিছু করণ দরকার আছে।’ ‘যা পার কর।’ ‘মুক্তিবাহিনীররাই দ্যাশ স্বাধীন করব।’ ‘আমরার কী আছে যে দ্যাশের লাগি দিতে পারি?’ ‘আরে কও কী? গরিব মানষ্যেই পারে বেবাক কিছু দিতে। বড় মাইনষ্যে আর কি দিবে? তাগো জানমালের ভয় বেশি।’  ‘তা ঠিক কইছ।’  ‘সুযোগ পাইলে আমিও যুদ্ধে যামু।’  ‘যাইবা? তাইলে আমার কি অবস্থা হইব?’ ‘বেবাকের যা হইব, তুমারও তা হইব।’ ‘ঘরে চাল-ডাল নাই। যুদ্ধ কদিন চলব?’ ‘মনে হয় সহজে ছাড়ব না।’  হালিম তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, ‘আঁইও যদি যাইত পারতাম।’

ঘরের দরজায় তখনই টকটক শব্দ হয়। ফরিদা হালিমের মুখে হাত দিয়ে কথা থামিয়ে দেয়।  ‘কথা কইও না। মনে হয় মেলিটারি।’ ‘এহানে মেলিটারি কিয়ের লাগি আইব?’ বাইরে থেকে কেউ একজন হালিমের নাম ধরে ডাকে, ‘হালিম... হালিম’। ‘তুমারে ডাকে।’ ‘হুনছি।’ ‘তুমার নাম জানছে কেমনে?’ ‘পরিচিত মনে হয়।’     বাইরে থেকে হালিম ... হালিম আবার আওয়াজ আসে। কেমন যেন পরিচিত কণ্ঠস্বর। হালিম এবার সাড়া দেয়, ‘কেডা?’ ‘হালিম আমি এমরান।’ ‘এমরান ভাই। কমান্ডার এমরান ভাই আইছে আমরার কাছে। এমরান ভাই, খারান। আইতাছি।’  

হালিম খাটের নিচে থেকে বের হয়ে কুপি জ্বালিয়ে দরজা খুলে। কমান্ডার এমরান ভাই এবং টিটু হুরমুরিয়ে ঘরে ঢুকে। বাইরে কয়েকজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা পাহাড়ায় থাকে। হালিম দরজা বন্ধ করে দেয়।   ‘এমরান ভাই ব্যাপার কি? যুদ্ধ শুরু হই গেল নাকি?’ ‘হুঁ।’ টিটু একটু বিস্তারিত বলা শুরু করে। ‘মুক্তিযুদ্ধ শুরু হইছে। পাকিস্তানি আর্মি ঢাকা মেছাকার কইরা দিছে। গণহত্যা.. গণহত্যা শুরু করছে। ঢাকা ভার্সিটি, জগন্নাথ হল, ঢাকার পিলখানায় কাউরে জীবিত রাখে নাই। বিস্মিত হালিম জানতে চাই, ‘কাউরে বাঁচায় রাখল না!’ এমরান ভাই মাথা ঝাঁকিয়ে বলেন,    ‘না। আইজ ফজরে বিবিসি কইছে।’  টিটু একটু বিরক্তি প্রকাশ করে। ‘হালিম ভাইয়ের কাছে দেহি কোনো খবর নাই। এসব খবর রাহন লাগব।’ হালিম লজ্জা পেয়ে বলে, ‘আইজকা বাজারে যাই নাই তো।’ টিটু বুঝতে পারে হালিম ভয় পাচ্ছে। তাকে সাহস দেওয়ার জন্য বলে, ‘আমরাও বইয়া নাই। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করছে। আমরাও সারা দ্যাশে মাইর শুরু করে দিছি।’ ‘স্বাধীনতার ঘোষণা তো বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ দিয়া দিছে। ‘‘যার যা কিছু আছে, তাই নিয়া শত্রুর মোকাবেলা কর।’’ এতক্ষণ তাইলে যুদ্ধ চলছিল!’  সগর্বে এমরান ভাই এবার নিজেদের যুদ্ধের বর্ণনা দিতে শুরু করেন, ‘আমরা আগে খবর পাইছিলাম হেরা এটাক করব। রেডি আছিলাম। নিশানার মধ্যে আইবার লগে লগে মাইর শুরু করি দিছি।’  ‘তারপর?’ ‘আপাতত পিছু হটছে। তয় আবার আইব। হইত পারে কাইল ফজরেই আইব।’  ‘দুই চারজন মেলিটারি মারা পরছে তো?’ ‘হালার পুতে গো জান খুব শক্ত। তোয় মরছে। চার-পাঁচজন মরছে।’ ‘আমরার মাইনষ্যের কিছু হনি তো?’ ‘না। হালিম, তুমরার সাহায্য করণ লাগব।’  ‘কওন কি করন লাগব। কিছু করতে পারলে খুব ভালায় লাগব। আমিও যুদ্ধে যাইতে  চাই।’ ‘দেখলা টিটু, আমি কয়ছিলাম না, হালিম আমরার দলের মানুষ।’ ‘আমরার মনে ঢর আছিল হালিম ভাই আফনে আমাগো লগে যোগ দিবা কিনা।’ ‘কিয়ের ঢর টিটু ভাইজান?’ ‘আফনে আমরারে জায়গা দিবান কিনা।’  ‘আরে কি যে কও। এমরান ভাই, কন কী করন লাইব?  আমারে অফনাগো লগে লন।’ ‘যাইবা হালিম?’ ‘হ আমিও যুদ্ধে যাইবাম এমরান ভাই। দু-চার খান শত্রু খতম কইরা আসি।’ ‘অস্র লই যুদ্ধ করলেই হুধা হইব না। আরও কাম আছে। হেগুনও করন লাগব।’ ‘আমারে কিছু কাম দেন। বহুতদিন নিজের কাম করছি। অন দ্যাশের কাম করতাম  চাই।’ ‘হালিম, আমরার কিছু জিনিস পৌঁছান লাগব। তুমার নাও আছে না?’ ‘আছে ...আছে। তা অহন কামে লাগব?’ ‘কয়খান পেটি পৌঁছায় দেওন লাগব।’ ‘কই পাঠাইবেন?’ ‘ভারম্ভা ঘাট। হেইডে আমরার মানুষ থাকব। তুমি গেলেই পাবা।’ ‘খালি পৌঁছায় দেওন আমার কাম। এ আর কঠিন কি। কুন চিন্তার দরকার নাই।’ ‘জায়গা বরাবর পৌঁছায় দিমু।’ ‘জয়বাংলা। এই হইল সাচ্ছা বাঙালি। আমরায় পারুম দ্যাশ স্বাধীন করতে।’ ‘আমরার নেতা বঙ্গবন্ধু কয়ছে না, দাবাইয়া রাখতে পারবা না।’

টিটু আর কথা বাড়াইতে চাইল না। সে তাড়া দিল- ‘চলেন হালিম ভাই, পেটিগুলান বুঝায় দিই।’ ‘আগে কিছু খাইয়া লন টিটু ভাইজান।’ টিটু মুখে কিছু না বললেও মনে মনে রাজি হলেও এমরান ভাই খাইতে রাজি হলেন না- ‘না ... না। আইজ থাক। আরেকদিন আসুম খাওনের লাগি। অহন দেরি হই যাইব।’ টিটুও বলল, ‘চলেন ... চলেন।’ ‘চলেন যাই টিটু ভাইজান। আফনেরা বের হন। আমি একবার ঘরে জানায় আসি।’ 

এমরান ভাই আর টিটু উঠে ঘরের বাইরে যায়। হালিম ফরিদার কাছে যায়। এক রুমের ছোট্ট ঘরটির অদূরে দাঁড়িয়ে ফরিদা এতক্ষণ সব কথা শুনেছে।  ‘ফরিদা, আমি গেলাম। তুমি বাত্তি নিভাই ঘুমায় যাও।’ ‘সাবধানে যাইবা।’  এমরান ভাই বাইরে থেকে তাড়া দেন- ‘হালিম আইও...আইও। দেরি করণ যাইত ন।’ হালিম ফরিদার মাথায় হাত রাখে। তারপর বেরিয়ে যায়।

এমরান ভাই, কিশোর টিটু এবং কয়েকজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে হালিম জোড়পুকুর পাড়ে চলে আসে। ওখানে কয়েকটা কাঠের পেটি খড়-লতা পাতা দিয়ে ঢেকে রাখা আছে। হালিম সবার সঙ্গে সাবধানে পা ফেলে পেটিগুলোর কাছে আসে। ফিসফিস করে কথা বলে। এমরান    ভাই বললেন, ‘এই পেটিগুলা পৌঁছায় দেওন লাগব।’ ‘এ আর এমন কঠিন কী?’ টিটু হেসে বলল, ‘কঠিন আছে। কঠিন আছে হালিম ভাই। আর্মি, রাজাকারের চোখ ফাঁকি দিয়া যাওন লাগব।’ ‘হে কথা আর কওন লাগব না। পাকিস্তানির বাপও জানবার পারব না। সামনে আইলে বৈঠা আছে না? এক বারিতেই মাথা দুই ফালা কইরা দিমু।’ ‘আইজ আর সময় নাই। কাল রাইতে যাওন লাগব।’ এমরান ভাইয়ের তখন আরেক প্রশ্ন, ‘এত সুময় পাহাড়া দিব কে?’ ‘ক্যান আমি দিমু।’ হালিমের নিঃসংকোচ জবাব। ‘মাইনষ্যে দেইখা ফেলব না? খাড়ায় খাড়ায় পাহাড়া দেওনের টাইম নাই। এগুন লুকায় রাহন লাগব।’ ‘তাইলে কওন কি করা যায়?’ টিটু প্রস্তাব করে, ‘এমরান ভাই, পানিতে চুবাই রাখি। ভিতরে প্লাসটিক আছে। অসুবিধা হইব না।’ 

এমরান ভাইয়ের নির্দেশের পর হালিম ভারি ভারি পেটিগুলি টেনে পানিতে নামানো শুরু করে। এমরান, টিটু আর কিশোর মুক্তিযোদ্ধারা সহযোগিতা করে। এতো কথাবার্তার মধ্যে কিশোরগুলো কিন্তু নীরব। ওরা শুধু এমরান ভাইকে অনুসরণ করে চলেছে। হালিম পেটি নামায় আর ক্ষণে ক্ষণে ওদের দিকে তাকায়। ‘এমরান ভাই, আমরা বাড়িতে কিছু মানুষ  আশ্রয় লইছে।’   ‘কও কি হালিম? এত সুময় তুমি তো কিছু কয়লা না!’ ‘শহরত্থুন পালায় আইস্যে।’  ‘কয় দেখলাম না যে হালিম ভাই!’ ‘গরুঘরে লুকায় রাখছি। শহরের মানুষ। বাচ্চা পোলাপানও আছে। খুব কষ্ট হয়তাছে। অভ্যাস নাই। কওন তু কী করা যায়?’  ‘কাইল তারারে পার করি দেওনের ব্যবস্থা কর। পারবা না হালিম?’ ‘জ্বি পারতে তো হইবই। এক কাপড়ে পালায় আইছে। একজন তু পরিবার পর্যন্ত আনতি পারে নাই। তারা নাকি বাপের বাড়ি আছে।’   ‘কিছু করার নাই হালিম ভাই। কেউই গুছাইয়া গাছাইয়া আইতে পারে নাই। পাকিস্তানিরা তু আর কয় বলি যুদ্ধ শুরু করে নাই। কয়ছিল বঙ্গবন্ধুর লগে আলোচনা করব। আয়ছিলও। তলে তলে যুদ্ধের প্রস্তুতি লইছে।’  ‘খবর বার্তা লইয়া বাহির হইবা। হালিমের কাম কিন্তু দুইখান হইল। সাবধানে করবা। বুঝলা হালিম, কি কয়লাম?’ ‘তারার খওন-দাওনের ব্যবস্থা কি হইছে হালিম ভাই?’ ‘আমরার যা কিছু আছিল তাই দিয়ায় ব্যবস্থা করছি।’

সবাইরে বিদায় দিয়ে হালিম ভেজা কাপড়ে অন্ধকারে ঘরে ফিরে। হালিমকে দেখতে পেয়ে ফরিদার টেনশান কমে- ‘তারা তুমারে কয় লইয়া গেল। আমার না খুব ভয় করছিল।’  ‘আরে না। তারা হইল মুক্তিবাহিনী। এমরান ভাই মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার। তাদের দলে আমারে নিছে।’  ‘তুমি যুদ্ধ করবা? পারবা?’ ‘কী কও! আমার নাওর বৈঠা আছে না? এক বারিতে মাথা দুই ফালা কইরা দিমু।’ ‘তারা মারত্য না তুমারে।’ ‘আমারে পাইব করতুন?’ ‘কহন যাইবা?’ ‘কাইল রাইতে যাওন লাগব।’  ‘কী জিনিস দিলো?’ ‘কওন যাইব না।’ ‘আমারেও না?’ ‘কয়লাম না কওন যাইব না।’  ‘নিষেধ আছে?’ ‘হুঁ। জান গেলেও কাউরে কওন যাইব না।’ ‘থাক, দরকার নাই।’  ‘রাগ করল্যা বউ। কমান্ডারের মানা। কোনো কথা কাউরে কওন যাইত না। কাউরে না। পয়লা পরীক্ষায় ফেল করলে তু হইব না।’ 

দু’জন মুক্তিযোদ্ধা নদীর ঘাটে উদ্বিগ্ন হয়ে পায়চারী করছে। হালিমের নৌকা ঘাটে ভিড়তেই মুক্তিযোদ্ধা দু’জন ছুটে যায়। মুখে কিছু বলে নাই। ওরা হালিমকে একটা সংকেত দেখায়। হালিমও ওদের একটা সংকেত দেয়। অতঃপর ওরা নৌকা থেকে  পেটিগুলো নামাতে থাকে। নামাতে নামাতে কথা বলে। ‘ভাই, আয়বার সুময় পরিস্থিতি কেমন দেখলেন?’ ‘খালি লাশ আর লাশ ভাসতাছে। লাশ ঠেইল্যা ঠেইল্যা আইলাম।’ ‘খারান। পাইয়া লই। আমরা হে রকম করি শালার পুতগো লাশ ফেলামু।’ ‘ভাই, জলদি জলদি করেন । আবার ত হে পতেই যওন লাগব।’ ‘ভাই, ডরাইলেন নাকি?’ ‘মুক্তিযোদ্ধার খাতায় নাম লেখাইছি। ডরাইলে চলবো? জয়বাংলা!’ ‘জয়বাংলা! এই তো ভাই কইলেন লাখ কথার এক কথা। মুক্তিযোদ্ধাদের ভয় পাইলে চলব না।’ পেটি নামানো শেষ হলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের বিশেষ সংকেতের জিনিসটা হালিমের হাতে দেয়। হালিম তার বিশেষ সংকেতের জিনিসটা ওদের দেয়। এভাবে বার্তা বিনিময়ের পর বিদায় নেয়।

হালিম খালি নৌকাটা নিয়ে ফিরে আসে। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। হালিম আর এমরান ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারেনি। সেই রাতে ফরিদা কুপির আলোতে ভাত খেতে বসেছে। এক দলা ভাত মুখে দিবে এমন সময় বাইরের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। ফরিদা মুখে ভাত না দিয়ে কান খাড়া করে। হালিম কান খাড়া করে কড়া নাড়ার শব্দ শোনে।  ‘কেবা?’ হালিম আমি এমরান ভাই। তুমি নিরাপদে আসতে পারলা?’ ‘এমরান ভাই? খারান। অল্পক্ষণ আগে আসলাম।’   হালিম বসা থেকে উঠতে উঠতে ফরিদার উদ্দেশ্যে বলে, ‘এমরান ভাই আইছে।’ হালিম উঠে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দেয়। এমরান ভাই আর টিটু দ্রুত ঘরে ঢুকলে এদিক ওদিক দেখে হালিম দরজা বন্ধ করে দেয়। তারপর হারিকেনের আলো বাড়িয়ে দেয়।

‘সব ঠিকঠাক মতো বুঝায় দিসি।’ টিটু জানতে চায়, ‘ওরা কিছু দিছে না?’ হালিম বালিশের নিচে লুকিয়ে রাখা ঐ বিশেষ সংকেতটি বের করে এমরান ভাইয়ের হাতে তুলে দেয়। তারপর জানতে চায়, ‘কয় থাইকা আইলেন এমরান ভাই?’ ‘কালারপুল ব্রিজ উড়াইয়া দিলাম। এক্কেবারে কাম শেষ। শালারা কেমনে আইয়ে দেহি।’  ‘ক্যান কিছু হুনছেন নাকি?’ ‘হুনছি মানে? কাইল মেলেটারি কালারপুল দিয়া আইবার কথা। যুয়ান পোলা একজনরেও ব্যাঁচায় রাখতো না। মাইয়া মানষ্যরে ধরি ধরি ক্যাম্পে নিব। গোটা গেরাম ছাড়খাড় করি দিব।’  টিটু ফিসফিসিয়ে বলল, ‘পাকিস্তান পোড়া মাটি নীতি লইছে। সারা দেশ জ্বালায় পোড়ায় শেষ করি দিব। এইডা হইল তাদের পোড়া মাটি নীতি।’  ‘অহন নিশ্চয় বেবাক রক্ষা পাইব?’ ‘মেলেটারি আওনের বেবাক রাস্তা বন্ধ করি দিছি। গেরামে ঢুকার বেবাক পথ অহন বন্ধ।’ ‘দারুণ একখান কাম হইছে টিটু ভাইজান।’ ‘হালিম ভাই, পেট একবারে চিরমির করছে। কিছু খাওন থাকলে দেওন। সারাদিন পেডে দানা পানি পড়ে নাই।’  ‘খাড়ান টিটু ভাইজান। আয়তাছি।’ 

এমরান ভাই আর টিটুকে বসিয়ে হালিম ভিতরে যায়। ফরিদা এদের আসার কারণে আর ভাত খায়নি। ভাত পাতে বসে বসে ওদের কথা শুনে। হালিম ফরিদাকে ভাত পাতে দেখে ওর মুখের দিকে তাকায়। ফরিদা কি আর বলবে। সে তার খাবার টুকুন থালায় সাজিয়ে দেয়। ভাতের পাতিল থেকে সর্বশেষ ভাতটুকুও তুলে দিয়ে দেয়। ফরিদা করুণ দৃষ্টিতে হালিমের দিকে তাকায়। কোনো জবাব না দিয়ে মাথা ঝাঁকায়।  ‘তোমার লাগি তু আর থাকল না?’ ‘আগে তারা খাউক।’ ফরিদা ভাতের থালাটা হালিমের হাতে তুলে দেয়। হালিম একবার ভাতের থালা আর একবার ফরিদার দিকে তাকিয়ে চলে যায়। ফরিদা গ্লাসের পানিটুকু খেয়ে ভাতের পাতিল ঘুড়িয়ে রাখে।  এরমান ভাই আর টিটু ভাত খেয়ে চলে গেলে হালিম গোয়াল ঘরে শহরের মানুষগুলোর কাছে যায়। অন্ধকার নিশুতি রাতে হালিম মানুষগুলোকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিতে নৌকায় নিয়ে তুলে। নৌকার ভেতর পালিয়ে আসা মানুষগুলো জুবুথুবু হয়ে গাদাগাদি করে বসে। হালিম সাবধানে নৌকা বেয়ে ওদের নিয়ে যায় ভুবন বিশ্বের পোলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে।   ফরিদা হালিম ফিরে না আসা পর্যন্ত ঘরে ছটফট করে। একবার বাইরে যায়। একবার ভিতরে আসে। একা একা বিড়বিড় করে। হালিম ফিরে আসে পরদিন। হালিমকে দূর থেকে আসতে দেখে ফরিদা ছুটে যায়।  ‘এতক্ষণ দেরি করল্যা যে? কয় রাখি আইলা?’ ‘বোহুত দূরের পথ। ভোন বিশ্বর পোলত নাও রাখি শুরু করলাম পশ্চিমদিকে  হাঁটা। তারপর আরও সাত-আট মাইল হাঁটলাম। আমিই কাহিল হয় গেলাম। তারা তু হইল শহরের মানুষ। হাঁটার অভ্যাস নাই।  কিছু হাঁটে তো কিছু বইয়ে।’   ‘বেচারাদের খুব কষ্ট হইছে। তারপর?’ ‘ঐ জায়গা মানুষ ঠিক আছিল। তারাই লয় গেছে।’  ‘খাওন নাই। পরিবার পরিজনের খবর নাই। বাঁচি আছে কিনা হেও  জানে না।’  ফরিদা একটা লম্বা করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ‘লও তুমারে কিছু খাইবার দিই। গোসল করি আয়ও।’ ‘ক্যান তুমি খাইবা না?’ ‘রোজা রাখছি।’ ‘দ্যাশের লাগি?’ ‘ফরিদা মাথা নাড়ে।’  ‘জয়বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু। আমারে কয়লা না ক্যান? দুইজনে একত্রে  রাখত্যাম।’  ক্লান্ত হালিম দাওয়ায় বৈঠাটা রেখে ঘরে ঢুকে। বৈঠাটা ফরিদা হাতে নিয়ে দেখে। তারপর ওটা কাপড়ের আঁচল দিয়ে মুছে যত্ন সহকারে  রেখে ঘরের ভিতরে যায়। 

পরদিন দুপুরে ফরিদা চুলায় ভাতের হাঁড়িতে পানি ফুটতে দেয়। পাত্রে চাউল নেই। খালি পানি ফুটছে। ফরিদা গালে হাত দিয়ে বসে বসে ভাবছে। সে সময় হালিম ব্যাগ ভর্তি চাউল-ডাল নিয়ে ঘরে ফিরে। ‘কী আনলা?’ ‘চাইল, ডাইল। কানুনগোপাড়া থাকি পাঠাইছে।’ ‘ভিক্ষার চাইল, ডাইল?’  ‘ধুর। কানুনগোপাড়া থাকি পাঠাইছে। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়া তুলছে। এমরান ভাইরা আইব।’  ফরিদা আর কথা বাড়ায় না। রান্নার আয়োজন করে। তাঁরা আসে রাতে। ফরিদা যত্ন করে খাওয়ায়। এমরান হালিমের পিঠে হাত রেখে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। ‘খুব খাওয়াইলা। তুমরার লাগি রাখছ তো?’ ‘আছে। আছে। বেবাক আছে।’ ‘আমরা যাই। একখানেত বেশিক্ষণ থাকন ঠিক না।’ ‘জ্বি আইচ্ছা। সাবধানে যাইয়েন। চারদিকে যে উৎপাত।’ টিটু হালিমকে সাবধান করে, ‘হালিম ভাই, আমরার আয়ওন-যাওনের কথা যাতে ফাঁস না হয়।’

এমরান হালিমকে বুকে জড়িয়ে ধরে। তারপর চলে যায়। হালিম ঘরের দরজা বন্ধ করতেই ফরিদা কাছে আসে। ‘খাওন লও।’  ‘খাওন সব শেষ। আর নাই। অল্প চুড়া-মুড়ি আছে।’ ‘লও। দুজনে ভাগ করি খায়।’ ফরিদা পেছন দিয়ে চিড়া-মুড়ি আনতে যাওয়ার সময় হালিম তাকে আবার ডাক দেয়- ‘হুন।’ ফরিদা ফিরে আসে। ‘মনে কষ্ট পাইলা?’ ‘ক্যান?’  ‘খাওন ফুরায় গিয়ে যে। সেদিনও খাইতে পারলা না।’ ‘যা করছি দ্যাশের লাগি করছি। স্বাধীনতার লাগি করছি।’ ‘সাবাস। জয়বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু। যাও চিড়া-মুড়ি লও । দুইজনে মিলি খাই।’

হালিম একখানা খবর নিয়ে এমরান ভাইয়ের আস্তানায় এসে দেখে ঘরের দরজা বন্ধ।  কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা পায়চারি করে পাহাড়া দিচ্ছে। হালিম ইশারায় জিজ্ঞেস করে। মুক্তিযোদ্ধা মাথা নাড়ে। একজন দরজা খুলে দেয়। হালিম ভিতরে ঢুকে দেখে এমরান ভাই রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবর শুনছে। ঘরে আর কেউ নেই। ‘হালিম, কোনো খবর আছেঅ’ ‘এমরান ভাই ভয়ানক খবর! কাইল রেজাকারেরা কানুনগোপাড়া এটাক করব।’ ‘কয় খবর পাইলা?’  ‘বোহুতদিন পর আইজ সাহস করি জাল লইয়া বাহির হয়ছিলাম। ঘাটে দেখা পাইলাম দুই রেজাকার। তারা জুর করি নাওত চড়ি বইল। তারারে নিয়ারে নামাইলাম ভোন বিশ্বর পোলে। হে সমুত দুজনে কথা কউতে হুনছি।’ ‘কী হুনলা?’ ‘মেলিটারির লগে মিটিং করার লাগি যায়।’ ‘মেলিটারি আর রেজাকারেরা এক লগে আক্রমণ করব?’ ‘হেই রকমই মনে হইছে।’ ‘ঠিক আছে। আমরাও প্রস্তুত আছি। বুঝায় দিয়াম আমরা কেমন বিচ্ছু।’  ‘তইলে অহন তুঁই যাও। এককাম করবা। তুঁই কাইল বাড়িত থাকবা না। বউরেও লয় যাইবা। বেজন্মাদের আবার তো মা-বোইন বাদ বিচার নাই। নয়া খবর বার্তা পাও কিনা দেখবা।’ 

হালিম যাওয়ার কিছু সময় পর টিটু এসে ঢুকে। ক্ষুধায় টিটুর পেটে চোঁ চোঁ করছে। টিটু একদম ক্ষুধা সহ্য করতে পারে না। তাই ঢুকেই এমরান ভাইয়ের পাশে রাখা চিড়া-মুড়ির টিন নিয়ে বসে। ‘বেশি ক্ষুধা লাগছে?’ ‘হও ভাই। খুব পরিশ্রম হইছে।’  ‘পুরা গ্রাম রেকি করি আইছ তো।’   ‘হও ভাই।’ ‘অস্ত্রপাতি কি পরিমান আছে?’  ‘বেশি না।’ ‘কুনদি গেলে কি হইব। তারা কুন কুন দিক থাইকা আইতে পারে? কুনদির শেল্টার বেশি কামে আইব?’ ‘ধোরলার শেল্টার বেশি দরকার হইব।’  ‘কানুনগোপাড়া এটাকের প্লেন করতাছে।’  ‘আর্মি?’ ‘আর কারা?  রাজাকারও থাকব। হালিম খবর নিয়া আছিল।’  ‘তাইলে তু মানুষজনরে সরি পরতে কওন দরকার।’  ‘দায়িত্বখান তোমার পালন করন পড়ব। হালিমরে বেশি মানষ্যে চিনলে আমরার সমস্যা হইব।’  ‘ভাই, খবর পাইলাম প্রিন্সিপাল শান্তিময় খাস্তগীর স্যাররে রাজাকাররা নিয়া গেছে।’ ‘রাজাকাররা নিয়া গেলে কি আর ব্যাঁচায় রাখছে? হেরা তু সাক্ষাৎ আজরাইল।’ 

কিন্তু সব কিছু হঠাৎ অন্যরকম হয়ে গেল। এক কিশোর হাঁপাতে হাঁপাতে এমরান ভাইয়ের সামনে এসে দাঁড়ায়। কিশোরটিকে হাঁপাতে দেখে এমরান রেডিও বন্ধ করে। টিটু খাওয়া শুরু করেছে মাত্র। কিশোরটিকে এমন করে হাঁপাতে দেখে খাওয়া বন্ধ করে ওর দিকে তাকায়। ‘কী হইছে? কী হইছে? হাঁপাওর ক্যা?’ ‘এমরান ভাই, হালিম ভাই ধরা পড়ছে।’ ‘কী কও। ক্যামনে?’  ‘জানি না।’ ‘আর কুন খবর?’ ‘আমরার কথা কইব না তো?’ ‘না। হালিম মুখ খুলব না।’ ‘তারপরও মনে হয়, আমরার সরি পড়া দরকার।’ ‘আস্তনা বদল করা দরকার। হালিমের বউয়ের খবর কি?’ ‘জানি না। খবরখান পাইয়া আপনার কাছে দৌঁড়ায় আসলাম।’ ‘হালিমের খোঁজ লও। ছাড়ন যাইত না। টিটু রেডি হও।’ টিটু এতক্ষণ কোনো কথায় বলেনি। এবার সে বলল, ‘এমরান ভাই, হালিম ভাইয়রে পাই আর না পাই তারারে ছাড়তাম না।’ ‘কোনো ক্ষমা নাই। জয়বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।’ জয়বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।

রাজাকারদের বুঝায় একটু ভুল হয়ে গেছে। মৃত ভেবে হালিমকে ওরা রাস্তার ধারে ফেলে আসে। অজ্ঞান অবস্থায় রাস্তার ধার থেকে ফরিদা তাকে উদ্ধার করে। রাজাকারের নির্মম আঘাতে মারাত্মক আহত হালিম হাঁটা চলা করতে পারছে না। বিছানায় শুয়ে আছে দিন কাটছে। তাকে সেবা করছে ফরিদা। গরম পানি দিয়ে ক্ষত স্থানগুলো মুছে দিচ্ছে। ফরিদা কিছু লতা-পাতা পাটায় পিষে ক্ষত স্থানে লাগিয়ে দেয়। হালিম উ ... মাগো বলে চিৎকার করে।

‘হালারপুত হালা। হারামখোর। আমি জয় বাংলার নামে শপথ করছি, আমার নেতা বঙ্গবন্ধুর নামে শপথ করছি, আমারে যেমন করি মারছে, তাগোও তেমন করি মারন পড়ব। আমার শরীল থুন যেমন করি রক্ত ঝরছে, সে রকম করি রক্ত তাগো শরীল তুনও ঝরব। আ ... মাগো ... উ ... মাগো।’ ‘আস্তে আওয়াজ কর। হেরা জানতে পারলে আবার আসি শেষ করে দিব।’ ‘আমার বৈঠাখান কই?  হাতের কাছে রাখ। এবার একজনরে লই মরুম।’ ‘আগে ভালা হইয়া লও। এমরান ভাইরা নিশ্চয় খাওন-দাওনের সমস্যায় আছে।’ ‘ভালা হইয়া লই। আবার বেয়াকের লগে যোগাযোগ করুম। দেশ স্বাধীন করন লাগব।’

তখনই হালিমের দরজায় টোকা পড়ে। হালিম কান খাড়া করে। ফরিদা মুখে আঙুল দিয়ে কথা না বলতে ঈশারা করে। ফরিদা তাড়াতাড়ি বাতি নিভিয়ে দেয়। দরজার টোকা থেমে যায়।  ‘ভাবি। আমি এমরান।’ ‘এমরান ভাই আইস্যে। বাত্তি জ্বালাও।’ ফরিদা বাতি জ্বালিয়ে দরজা খুলে দেয়। এমরান দ্রুত ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। বাইরে ক’জন মুক্তিযোদ্ধা পাহাড়া দিচ্ছে। ‘ভাবি, হালিমের কী খবর?’   ‘এমরান ভাই, আমারে মারতে পারে নাই।’ ‘হালিম ফিরি আইছ।’ ‘হও ভাই। মরি গেছি মুনে করি ফেলায় দিছে। আফনার ভাবি রাস্তা থাকি কুড়ায় আনছে।’ ‘আমরার লাগি আইজ তুমারে এত অত্যাচার সহ্য করতে হইল।’ ‘কী কন এমরান ভাই। কত মানুষ পরাণ দিল। আমি না হয় অল্প রক্ত দিলাম। এ হেন কিছু না। দ্যাশের লাগি এর তাথি বেশি করন দরকার। তয় আফনারার খবর কওন।’ ‘আমরা ঠিক আছি।’ ‘হালিম, তুমারে যে রকম কইরা মারছে, আমরাও তাগো হেইভাবে মারুম। মাফ নাই কারো। জয় বাংলার নামে শপথ করিছি, বঙ্গবন্ধুর নামে শপথ করিছি।’ ‘হও ভাই, ছাড়ন যাইব না।’ ‘হালিম, তুমার ওষুধপত্র দরকার। তুমি চিন্তা করো না। সব ব্যবস্থা করছি। টিটু নিয়া আইব।’ ‘আমার লাগি ভাবেন না। আফনারা কাম করেন। দ্যাশ স্বাধীন করেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মানেন।’ ‘তোমার তাড়াতাড়ি ভালা হওন দরকার।’ ‘টাকা-পয়সা কয় পাইবেন?’ ‘আরে কী কও? দেশ বিদেশের কত মানুষ আমাগো লাগি চিন্তা করতাছে।’ ‘ভারত, রাশিয়া আমাগো লাগি আছে। ভুটান আমাদের স্বীকৃতি দিয়া দিছে। কতজন লন্ডনে, কলকাতায় আমাগো লাগি গান কইরা টাকা উঠাইতেছে।’ 

এমরান ভাই যাওয়ার পর ফরিদা হালিমের আঘাতের জায়গাগুলো পরখ করছে। তখনই আবার দরজায় টোকা। ফরিদা দরজা খুললে টিটু একটা পোটলা ফরিদার হাতে দিয়ে দ্রুত ঘরে ঢুকে পড়ে। ‘ভাবি, হালিম ভাই অহন ক্যামন আছে?’ ‘আগের চাইতে ভালা।’ ‘টিটু ভাই, আর মরতাম না।’ ‘আরে মরার কী আছে? আফনার লাগি ওষুধ আনছি। তাড়াতাড়ি ভালা হয় যান।’ ‘ক্যান তোমরা খালি খালি এতু টাকা খরচা করছ!’ ‘আরে আফনার কাম আছে বোহুত? এতদিন আফনে আমরারে খাওয়াছেন। আইজ আফনারে খাওয়ামু। উঠেন চাই। খাইয়া লন।’ টিটু হালিমকে তুলে বসিয়ে সঙ্গে আনা খাওয়াগুলো খেতে দেয়। হালিমের চোখ দিয়ে পানি ঝড়ে।

সপ্তাহখানেক পরের কথা। দেখতে দেখতে নয় মাস পার হয়ে গেল। অগ্রহায়ণ মাস এসে গেছে। গ্রামে শীতের আমেজ চলে এসেছে। ফরিদা অপেক্ষা করছে। এমরান ভাইরা আজ রাতে আবার খেতে আসার কথা। কিন্তু আসছে না। কেন আসছে না সে খবরও নেই। হালিম আর ফরিদ সারা না খেয়ে জেগে বসে থাকে। যে কোনো সময় হয়ত আসতে পারে সে আশায়। কিন্তু আসেনি। এ জন্য হালিম-ফরিদা কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে।  পরদিন সকালে উদ্বিগ্ন হালিম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এমরান ভাইদের খোঁজে আস্তানায় যায়। ওখানে গিয়ে হালিম দেখে, এমরান ভাই এবং অন্য মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীন বাংলার পতাকা আনন্দ নৃত্য করছে। ব্যান্ড বাজাচ্ছে। হালিমকে আসতে দেখে এমরান ভাই ছুটে আসে- ‘ব্যাপারখান কী এমরান ভাই?’ ‘হালিম দেশ স্বাধীন । জয়বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।’ ‘জয়বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু। দেশ স্বাধীন হইছে টিটু ভাইজান!’ হালিম খুশিতে আঘাতের কথা ভুলে গিয়ে টিটুকে কোলে তুলে নেয়। আনন্দ স্ফূতির মধ্যে এক সময় এমরান ভাই হালিমের হাতে স্বাধীন বাংলার একটি পতাকা তুলে দেয়। হালিম পতাকাটা হাতে নিয়ে একটু তাকায়। তারপর চিৎকার করতে করতে দৌঁড় দেয়- ‘দেশ স্বাধীন হইছে। দেশ স্বাধীন হইছে।’

হালিম পতাকা হাতে জয়বাংলা..জয় বঙ্গবন্ধু..দেশ স্বাধীন.. চিৎকার করতে করতে বাড়ির দিকে ছুটে। আশে পাশের মানুষ বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসে। হালিমের চিৎকারে ফরিদাও বের হয়।  ‘দেশ স্বাধীন হইছে ফরিদা। আমরার দেশ স্বাধীন হইছে। এই দেখ, আমরার স্বাধীন দেশের স্বাধীন পতাকা। এই দেখ। ধরি দেখ।’ ফরিদা পতাকাটা ধরে। মাথায় ঠেকায়। গালে ঠেকায়। আদর সোহাগে ভরিয়ে দেয়। দু’জনে মিলে পতাকাটা উড়ায় কিছুসময়। তারপর হালিম একটা বাঁশের মাথায় পতাকাখানা বেঁধে উঠানের মাঝবরাবর পুঁতি রাখে।  পুঁততে পুঁততে বলে, ‘মানুষ দেখব। আর জানব এই হলো আমরার স্বাধীন দেশের স্বাধীন পতাকা।’

সেই থেকে হালিমের বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে।  মানুষ এ পতাকা দেখে মনে করে, উনিশ শ একাত্তরের কথা। আমাদের স্বাধীনতার কথা। তবে এখন হালিমের বাড়িতে যে পতাকাটি উড়ছে সেটি উনিশ শ একাত্তরের সেই পতাকাটি নয়। রঙ জ্বলে গেলে কয়দিন পরপর হালিম নয়া পতাকা কিনে আনে।