অর্থনীতি

আগামী ৫ বছর হবে বাংলাদেশের গোল্ডেন ইকনোমিক ডে’স

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেছেন, বিগত দুই-তিন বছর করোনা মহামারি পরবর্তী সময় থেকে কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং, রোড শো এবং ইনভেস্টমেন্ট ইনভাইটেশন যৌথভাবে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সঙ্গে আমরা শুরু করেছি। তার জন্য অনেক বিদেশি বিনিয়োগ এখন পাইপ লাইনে রয়েছে। তারা শুধু নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছিলো। এখন বিডা ও বিএসইসি এই দুই প্রতিষ্ঠানই বাংলাদেশে বড় বিনিয়োগ আসার অপেক্ষায় আছি। আমরা চেষ্টা করছি এবং যতটুকু করণীয় করেছি। সে কারণে আশা করছি যে, আগামী পাঁচ বছর হবে বাংলাদেশের ‘গোল্ডেন ইকনোমিক ডে’স’।

নতুন বছরের প্রত্যাশা নিয়ে রাইজিংবিডির সঙ্গে আলাপকালে বিএসইসি চেয়ারম্যান এসব কথা বলেন।

শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, নির্বাচনের পরে দেখা যায় যে, মানুষ খুব আশাবাদী হয়। তারা মনে করে, পরবর্তী পাঁচ বছরে জন্য আমরা একটা সরকার পেয়েছি। সরকারের এই পাঁচ বছরের স্ট্যাবিলিটির কথা চিন্তা করে মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্যে আরো বিনিয়োগে ঝাপিয়ে পড়ে। প্রতি নির্বাচনের পরেই অর্থনীতিতে একটি মোমেন্টাম আসে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো হতে থাকে। আমরা তাই আশা করছি, এবার এমন কিছুই হবে।

বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার মতোই স্মার্ট পুঁজিবাজার নিয়ে কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। যেমন- সেন্ট্রাল কাউন্টপার্টি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিসিবিএল) কাজ নতুন বছরেই শুরু হয়ে যাবে। আমাদের কমোডিটি এক্সচেঞ্জের সকল কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। আমরা এ মাসে লাইসেন্স হস্তান্তর করবো। এছাড়া রিয়েল এস্টেট রুলস আমরা দুই মাসের মধ্যে অনুমোদন দিয়ে দিবো। আমাদের এরকম নতুন নতুন ১৮-১৯টি আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে। এসবই নতুন নতুন প্রোডাক্ট। সামনের দিনে এগুলো আসতেই থাকবে। এগুলো সব আমাদের ক্যাপিটাল মার্কেটে মিসিং। আমাদের যারা আগের কমিশন ছিলেন তাদের উচিত ছিলো এগুলো করে যাওয়া। তাহলে আজকে আপনারা এর ফলগুলো পেতেন। আমরা এখন করছি বলে ফল আসতে আরো ৫ থেকে ৭ বছর লাগবে। আমি এখন দেখি যে আমাদের আগের কমিশনের সদস্য তারা বিভিন্নভাবে সমালোচনা করেন। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে যে, এই প্রোডাক্টগুলো তারা কেনো আনেন নাই। তারা কি জানতেন না, ডেবট ইন্সট্রুমেন্ট ক্যাপিটাল মার্কেটে থাকে। ডেরিভেটিভস মার্কেট যা আনা হয়নি। আমরা এখন এগুলো নতুন করে এনে ক্যাপিটাল মার্কেটকে একটা পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছি। আশা করি টোটাল আইটি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ক্যাপিটাল মার্কেটের সকল অর্গানকে একটা সিঙ্গেল প্লাটফর্মে নিয়ে আসার যে পরিকল্পনা রয়েছে, সেটাও এ বছরে কিছু দেখতে পারবেন।

তিনি বলেন, যারা ক্ষুদ্র নারী বিনিয়োগকারী এবং এসএমই’র মধ্যে পড়েন, তাদের জন্য আমরা পিঙ্ক বন্ড নিয়ে কাজ করছি। আর যারা বড় প্রতিষ্ঠিত উদ্যোক্তা বা বড় ব্যবসায়ী, যারা ব্যবসা করে করে একটা স্থিতিশীল অবস্থায় চলে এসেছেন, এখন তারা ব্যবসা প্রসার করতে চান- তাদের জন্য আমরা অরেঞ্জ বন্ড নিয়ে আসছি। এটা আমরা দুই তিন মাসের মধ্যেই সবাইকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানাবো।

পুঁজিবাজারে বহাল থাকা ফ্লোর প্রাইস প্রসঙ্গে বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, এটা তো তুলে দিতে হবে। ফ্লোর প্রাইস কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। এটা ইমপোজ করা হয় কোনো একটা সিচুয়েশনে। আমাদের এই টেনিওরে তিন-চারটি কঠিন ঘটনা ঘটে গেছে, যার একটাই মার্কেটকে ধস নামিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। 

যেমন- করোনার সময় একবার, ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধের সময় একবার, ইউক্রেন প্যালেস্টাইন যুদ্ধে একবার এবং নির্বাচনি উত্তাপ চলাকালে পুঁজিবাজার নরমাল সিচুয়েশনে ছিলো না। অনেকেই তুলনা করেন অন্য দেশের ক্যাপিটল মার্কেটের সাথে। অন্য দেশের ক্যাপিটাল মার্কেটে তো ৮০ শতাংশ ইনস্টিটিউশন ইনভেস্টর। সেখানে ফ্লোর প্রাইস থাকুক আর না থাকুক ইনস্টিটিউশন খুলবে বা বন্ধ হবে। কিন্তু আমাদের এখানে ৮০ শতাংশ রিটেইলার ইনভেস্টর। ফ্লোর প্রাইস হঠাৎ তুলে দিলে আমাদের এখানে ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরা নিঃস্ব হয়ে যাবে। তাই একবার কোনো ব্যক্তি হয়ে গেলে সে বা তার পরিচিত কেউই কোনোদিন এ মার্কেটে বিনিয়োগে আসবে না। তাই আমরা ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও ফ্লোর প্রাইস বহাল রেখেছি।

তিনি আরো বলেন, আমরা চাই যে কোনো ভাবেই বিনিয়োগকারীদের পু্ঁজি যেন নষ্ট না হয়। পুঁজিবাজারে যদি পুঁজি না টিকে তাহলে কে আসবে। পুজিটা রক্ষা করার পরে লাভ ক্ষতি যা হয় হোক। নির্বাচন পরবর্তী পুঁজিবাজার যদি ভালো দিকে যেতে থাকে তাহলে আমরা খুব তাড়াতাড়ি ফ্লোর প্রাইজ উঠিয়ে দিবো। কিন্তু সরকারের একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা কখনোই চাইবো না পুঁজিবাজারের কারণে কখনো কারো ক্ষতি হোক। আমরা চাইবো বিনিয়োগকারীদের যেন লাভ হয়। আপনারা আমাকে যখন প্রশ্ন করেন প্রশ্নের মেইন বিষয় থাকে সেকেন্ডারি মার্কেট। এটাই হয়ে গেছে প্রবলেম। আমাদের তিন বছর ফ্লোর প্রাইজ থাকুক বা না থাকুক কোম্পানিগুলো বিনিয়োগে ডিভিডেন্ড দিচ্ছে। কোম্পানিগুলো ছাড়া মিউচুয়াল ফান্ড ডিভিডেন্ড দিচ্ছে। আমাদের বন্ডের কুপন পেমেন্ট হচ্ছে। সব সময় যেমন হয় সেভাবেই হচ্ছে। হয়তো বাহিরের যুদ্ধ বিগ্রহ বা তারল্য ব্যবস্থাপনা বা ফরেন এক্সচেঞ্জ ভোলাটিলিটির জন্য বেশি হতে পারে। ক্যাপিটাল মার্কেট মানেই এক্সিট প্ল্যান নয়। আপনারা যেটা সেকেন্ডারি মার্কেট মনে করেন, সেটা এক্সিট প্ল্যান। সুতরাং ক্যাপিট্যাল মার্কেটের অন্যান্য অর্গান ঠিকভাবে কাজ করছে। খালি সেকেন্ডারি মার্কেটে আমরা ফ্লোর প্রাইস দিয়েছি মানুষকে রক্ষা করার জন্য। এজন্য এই ইস্যুটাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বানিয়ে ফেলার জন্য মানুষের বুঝতে অসুবিধা হয়। ক্যাপিটাল মার্কেটের যারা সমালোচক বা যারা এখানে আগে দায়িত্বে ছিলেন তারা ক্যাপিটাল মার্কেটকে প্রাইমারি আর সেকেন্ডারি মার্কেটের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে গিয়েছে। এখানে ক্যাপিটাল মার্কেট রিলেটেড কত কম্পোনেন্ট আছে, তা এর আগের ৩০ বছরে কিন্তু কেউই আনেনি। আমরা এসেই এই ডেবট ইনস্ট্রুমেন্ট, ডেরিভিটিভস মার্কেট, কমোডিটি এক্সচেঞ্জ, রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টমেন্টসহ আরো ভিভিন্ন প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করছি। আমরা আরো অনেক প্রোটাক্ট নিয়ে কাজ করবো, যেগুলো সারা পৃথিবীতে আছে কিন্তু আমাদের ছিলো না। সেগুলার রিটার্নে কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

বর্তমান পুঁজিবাজার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি আবারো বলছি, পুঁজিবাজার ভালোই আছে। আমাদের নিজেদের মধ্যে কোনো সমস্যা নেই। এটা বাহিরের সমস্যা। সেটা আমাদের উপরে একটু প্রভাব রাখে। বাহিরের সমস্যা যতদিন ঠিক না হবে, আমরা নিজেরা তো ঠিক করতে পারবো না। তারপরও বলছি শেয়ারবাজার বা ক্যাপিটাল মার্কেট মানেই সেকেন্ডারি মার্কেট না। ক্যাপিটাল মার্কেট মানে অন্যান্য অনেক কিছু যেগুলো সবই ঠিক আছে। সেকেন্ডারি মার্কেটটা আমরা মানুষের বড় ক্ষতি থেকে রক্ষা করার জন্য ফ্লোর প্রাইস দিয়ে হেল্প করছি।

এই অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, বিনিয়োগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে আমি শিক্ষক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন থাকা অবস্থায় খেয়াল করেছি, বাংলাদেশি ভাই বোনেরা যারা বিদেশে থাকেন তারা কেউ কেউ পলিটিকাল ইন্টারেস্টে বিদেশে বসে বাংলাদেশের বদনাম করেন। ওই দেশে বাংলাদেশকে ছোট করা হয় এবং বাংলাদেশকে ওই সব দেশের পত্রপত্রিকায় পয়সা দিয়ে বা এমনভাবে বাংলাদেশকে পরিচিত করা হয়, যেন বাংলাদেশের অবস্থা খুবই খারাপ। এটা হয়তো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে অনেকেই করেন। তবে আমার অনুরোধ থাকবে রাজনীতি আমরা যে পক্ষেরই করি না কেনো, দেশ তো সবার উপরে। মাতৃভূমিকে মায়ের মত ভালবাসতে হবে এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিন্তু কোনো পার্টিকুলার পার্টির হয় না, তা সবারই হয়। সুতরাং দেশের সবার উন্নতির জন্য আমি মনে করি যে, পৃথিবীর সবার উচিত বাংলাদেশের যে সত্যিকারের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা তথ্যচিত্র ঠিকভাবে তুলে ধরা। আমি মিথ্যা বলতে বলছি না, সত্যটা তুলে ধরতে বলছি। সে জন্যই আমরা কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং নিয়ে কাজ করেছি। আমাদের ইনভেস্টমেন্ট এর যেসব সামিটগুলো দেশ-বিদেশে হয়েছে, সেখানে যারা আসতো বিভিন্ন বিনিয়োগকারী, উদ্যোক্তা ও স্টেকহোল্ডার্স, তারা আমাদের প্রেজেন্টেশন দেখে বিশ্বাসই করতো না। বলতো যে আমরা জানতাম না এবং তখন ওরা জেনে ওদের কাজ শুরু করে। সুতরাং আমরা মনে করি যে, দেশ-বিদেশে এখন সত্য তথ্য তুলে ধরছি। বড় বড় ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া আমাদের তথ্যগুলো দিচ্ছে।

শিবলী রুবাইয়াত আরো বলেন, হিমালয়ের পাদদেশে পৃথিবীর অর্ধেক জনগোষ্ঠী থাকে। প্রায় ৩০০ থেকে ৩৫০ কোটি লোক। সারা পৃথিবীতে ব্যবসা করার যে সুযোগ, এই হিমালয়ের পাদদেশে ব্যবসা করার তার অর্ধেক সুযোগ রয়েছে। আবার এখান থেকে প্রায় ১৫০ কোটি লোক আছে আফ্রিকাতে। এরকম সবকিছু মিলিয়েই আমরা কাজ করছি। আশা করি, বড় মার্কেট টার্গেট করে যদি সকল উইং একসাথে কাজ করে তাহলে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্র থেকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা বিফলে যাবে না।