সারা বাংলা

বদলে যাচ্ছে পাহাড়ি জনপদ, অর্থনৈতিক বিপ্লবের হাতছানি

দুর্গম পাহাড়ের বুকে পিচঢালা সুগম পথ। সবুজের মাঝে আঁকাবাঁকা সড়ক যেমন দৃষ্টিনন্দন, তেমনি তা পাল্টে দিয়েছে পাহাড়ি জীবন।

গত এক দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সড়ক যোগাযোগে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। পাহাড়ের দৃষ্টিনন্দন সড়ক ও সেতু নির্মাণের ফলে এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থার যেমন উন্নত হয়েছে, পাশাপাশি এখানকার পর্যটন, কৃষিক্ষেত্রেও অনেকটা পরিবর্তন এসেছে।

রাঙামাটি সড়ক বিভাগ জানিয়েছে, নির্ধারিত সড়ক তৈরি, সড়ক ব্যবস্থাপনাই হলো সড়ক বিভাগের মূল কাজ। রাঙামাটি পার্বত্য জেলার রাজধানী ঢাকা,চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য তিন জেলার বিভিন্ন উপজেলার অধীনে জাতীয়, আঞ্চলিক প্রায় ২৩৫ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে।

জেলা সড়ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার বগাছড়ি-নানিয়ারচর-লংগদু সড়কের ১০ কিলোমিটারে নানিয়ারচরের চেঙ্গী নদীর ওপর ৫০০ মিটার দীর্ঘ সেতু নির্মিত হয়েছে। এই সেতুর নতুন নামকরণ করা হয়েছে চুনীলাল দেওয়ান সেতু। সেতুর মোট ব্যয় ২২৭ কোটি ৬১ লাখ টাকা।

দীর্ঘ ৬০ বছর পর নানিয়ারচরে এই সেতু নির্মাণের ফলে এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিসহ এখানকার কৃষিপণ্য ক্রয়-বিক্রয় সহজলভ্য হবে। এতে নানিয়ারচরের কৃষক লাভবান হবে।

এই সেতুর মাধ্যমে অল্প সময়ে রাঙামাটির লংগদু, খাগড়াছড়ির দিঘীনালা হয়ে বাঘাইছড়ির সাজেকে পৌঁছানো যাবে। এরই মধ্যে সেতুটি ভ্রমণপিাপাসু মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। রাঙামাটি জেলা ছাড়াও বিভিন্ন জেলা থেকে পর্যটকরা সেতুর পাশের অপরূপ দৃশ্য দেখতে ভিড় করেন প্রতিদিন। ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর সেতুর নির্মাণ শুরু হয়।

এদিকে, জেলা সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে (চট্টগ্রাম জোন) ১৬২৪.৯৯ কোটি টাকা। বগাছড়ি নানিয়ারচর লংগদু সড়ক উপ-প্রকল্পের, নানিয়ারচরের বগাছড়ি-নানিয়ারচর লংগদু সড়ক। এতে মোট ব্যয় হয়েছে ৩৭৪.৭৮ কোটি টাকা।

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অধীনে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ৬টি সড়ক নির্মাণ উন্নয়ন প্রকল্প। যেটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২০ ইসিবি কর্তৃক বাস্তবায়ন করেছেন। চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পে খরচ হয়েছে ৩৮৯১.৫৫ কোটি টাকা। রাঙামাটির ঘাগড়া -চন্দ্রঘোনা বাঙালহালিয়া-বান্দরবান সড়ক (রাঙামাটি অংশ) উন্নয়নে ব্যয় হয়েছে ৩০১৮.০৪ কোটি টাকা। রাঙামাটির রাজস্থলী-বাঙালহালিয়া সড়কে ব্যয় হয়েছে ১৮৫৮.৫০ কোটি টাকা।

রাঙামাটি সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, পিরিয়ডিক মেইনটেন্যান্স প্রোগ্রাম (পিএমপি) এর আওতায় রাঙামাটির যেসব সড়কগুলোর কাজ সম্পন্ন হয়েছে সেগুলো হচ্ছে-ঘাগড়া-চন্দ্রঘোনা বাঙালহালিয়া-বান্দরবান আঞ্চলিক মহাসড়কের দ্বিতীয় কিলোমিটার সড়কে ৪০.৯৭৪ মিটার পিসি গার্ডার (ঘাগড়া ব্রিজ) সেতু নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে ৭.৪৬ কোটি টাকা।  ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে এই সেতুর কাজ সম্পন্ন হয়।

রাঙামাটি শহরের পুরাতন শহীদ মিনার পর্যটন সড়কের ২য় কিলোমিটারে ২.৯২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে ২২.৬৮ মিটার তবলছড়ি সেতু। এটির কাজ সমাপ্ত হয় ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে। চট্টগ্রাম-রাঙামাটি জাতীয় মহাসড়কের ২৬ কিলোমিটারে ২০.৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে বিটুমিনস সার্ফেসিং এর কাজ সম্পন্ন করা হয়। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছর রাঙামাটি সদর ও কাউখালী উপজেলায় এই সড়কের কাজ করা হয়।

ঘাগড়া-চন্দ্রঘোনা-বাঙালহালিয়া-বান্দরবান আঞ্চলিক মহাসড়কে ২৩ কিলোমিটার ১৭.৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে বিটুমিনস সার্ফেসিং কাজ। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে রাঙামাটির কাপ্তাই ও কাউখালী উপজেলায় সড়কের কাজ শেষ হয়।

রাঙামাটি-মানিকছড়ি-মহালছড়ি-খাগড়াছড়ি আঞ্চলিক মহাসড়কে ১৮ কিলোমিটার ৯.৮৮ কোটি টাকা ব্যয়ে সম্পন্ন করা হয় বিটুমিনস সার্ফেসিং এর কাজ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাঙামাটি সদর, নানিয়ারচর ও খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ি উপজেলা সড়কের কাজ করা হয়।

২০২১-২০২২ অর্থবছরে চট্টগ্রাম-রাঙামাটি জাতীয় মহাসড়কের ১০.৫৯ কিলোমিটারে ১৩.৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে বিটুমিনস সার্ফেসিং এর কাজ শেষ হয়।  এছাড়া ২৮৭ কোটি টাকা ব্যয়ে রাঙামাটি সড়ক বিভাগ ২০১৭ সালে পাহাড়ধ্বসে ক্ষতিগ্রস্ত ৬টি সড়কে ৫৪৭০ মিটার স্থায়ী প্রতিরক্ষামূলক আরসিসি রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণকাজের প্রকল্প চলমান রয়েছে।

এদিকে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক তিন পার্বত্য জেলায় ‘সীমান্ত সড়ক (রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলায়) নির্মাণ প্রকল্প-১ম পর্যায়ের প্রকল্পের কাজ চলমান আছে। এ প্রকল্পের আওতায় রাঙামাটির ৪টি উপজেলায় (রাজস্থলী, বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি ও বরকল) ১৩০ কিলোমিটার সীমান্ত সড়ক নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে।

জানা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা জোরদার করতে এবং অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে প্রধানমন্ত্রী এ সীমান্ত সড়ক তৈরির উদ্যোগ নিয়েছেন।

রাঙামাটি সড়ক বিভাগ জানায়, পার্বত্য জেলায় মোট ২১টি বেইলী সেতু ছিল। এর মধ্যে ৪টি সেতু নির্মিত হয়েছে। নির্মাণাধীন রয়েছে ৭টি সেতু। রাঙামাটিতে বর্তমানে আরও ১০টি বেইলী সেতু এখনো বিদ্যমান আছে।

রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের বাস ড্রাইভার মো. ইউছুপ বলেন, ১০ বছর আগে রাঙামাটি চট্টগ্রাম সড়ক অনেক ছোট ছিল। এই সড়কে গাড়ি চালানো অনেক কষ্টসাধ্য এবং সময় সাপেক্ষ ছিল।

রাজস্থলীর ঘিলাছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রবার্ট ত্রিপুরা বলেন, সীমান্ত সড়ক হওায়ার কারণে দুর্গম এলাকার জনগণ বর্তমানে প্রত্যন্ত এলাকা থেকে কৃষিপণ্য থেকে শুরু করে বিভিন্ন পণ্য রাজস্থলী সদরে এনে বিক্রি করতে পারছেন। শুধু রাজস্থলী উপজেলা নয় জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি উপজেলার মানুষও এ সড়কের ফলে উপকৃত হবে। ভবিষ্যতে এই সড়ক পর্যটনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

চট্টগ্রাম-রাঙামাটি মোটর মালিক সমিতির রাঙামাটি অঞ্চলের সভপতি মো. শহীদুজ্জামান মহসিন রোমান বলেন, বর্তমান সরকারের ১৫ বছরের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় রাঙামাটি পার্বত্য জেলায় বিভিন্ন উপজেলার সড়কগুলোতে যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে।

রাঙামাটি সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সবুজ চাকমা বলেন, নিরাপদ, যুগোপযোগী ও টেকসই মহাসড়ক বিনির্মাণে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের মাধ্যমে যে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে সেটা অত্যন্ত সময়োপযোগী পদক্ষেপ। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা জনগণের অর্থনৈতিক, সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে।