সারা বাংলা

যশোর জিলা স্কুলের পুনর্মিলনীতে প্রাণের ছোঁয়া

‌‌‘১৯৭০ সালে প্রথম এই স্কুলে পর্দাপন করেছিলাম। সেই সময়ের অনুভূতি আর এখনাকার অনুভূতি ভিন্ন। আজকে এসে ফিরে গেলাম ৭০ দশকে। শহরের চাঁচড়া চোরমারা দিঘীপাড় থেকে হেঁটে স্কুলে আসতাম। পড়া না পারলে স্যারদের বেত্রাঘাত। পরে আবার আলাদা ডেকে আদর করা। সেই স্মৃতিটা আজকে বেশি মনে পড়ছে। স্যারদের প্রতি ছিল আমাদের অগাধ শ্রদ্ধা। বারবার তাকাচ্ছি পুরনো সব ভবনের দিকে। আমার সেই ক্লাস রুমের দিকে। আগে যেমন ছিলো, এখন তেমনটা নেই। অনেক স্থপনা বেড়েছে। এই বয়সে অনেক নবীন প্রবীণদের দেখে ভালো লাগছে।’ 

যশোর জিলা স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে শুক্রবার (২৬ জানুয়ারি) বিকেলে ঝিনইদহ-৩ (মহেশপুর) আসনের সংসদ সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) সালাহউদ্দি মিয়াজী এসব কথা বলেন। ১৯৭৯ সালে তিনি যশোর জিলা স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। ১৮৩৮ সালে যশোর জিলা স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়।

‘নবীন-প্রবীণ এক প্রাণ’ স্লোগানে যশোর জিলা স্কুলের ১৮৬ বছর উদযাপন ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের পুনর্মিলনী উপলক্ষে দুই দিনব্যাপী মিলনমেলার আয়োজন করা হয়েছে। শুক্রবার বিকেলে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবরাউল হাছান মজুমদারসহ অতিথিরা ১৮৬টি বেলুন উড়িয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন। যশোর জিলা স্কুল প্রাক্তন ছাত্র সমিতি এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

স্মৃতিচারণ করে ১৯৬০ ব্যাচের গোলাম ফারুক বলেন, ‘অনেক বয়স হয়ে গেছে। জানি না কতদিন আর বাঁচবো। এমন আয়োজন যেন আমাকে আরও বেশি দিন বাঁচিয়ে রাখার প্রেরণা দিলো।’ একই ব্যাচের মেজর জেনারেল জামিল ডি এহসান বলেন,  ‘এই মিলনমেলায় একই সঙ্গে স্কুলের চেনা-অচেনা অনেককে দেখতে পেয়ে আনন্দ লাগছে।’ 

যশোর মেডিক্যাল কলেজের প্রভাষক ডা. আলাউদ্দিন আল মামুন স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘এই আয়োজন ঘিরে যে প্রাণের স্পন্দন তৈরি হয়েছে, সেটি আমাকেও স্পর্শ করছে। এমন আয়োজন জিলা স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করেছে। এই বন্ধন যেন ভবিষ্যতেও অটুট থাকে।’

যশোরের ডেপুটি সিভিল সার্জন নাজমুস সাদিক রাসেল বলেন, ‘পুনর্মিলনীতে এসে মনে পড়ে যাচ্ছে বিদ্যালয়ে পড়ার সেই ছোটবেলার স্মৃতিগুলো। আমরা যেদিন বিদায় নিয়েছিলাম, সেদিন সহপাঠীদের বলেছিলাম, আবার দেখা হবে। কিন্তু বাস্তবতার কারণে অনেকের সঙ্গে দেখা হয়নি এরপর থেকে।’ 

স্কুল জীবনের একটি ঘটনা স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘স্কুল বন্ধ করতাম খুব। পরের দিন স্কুলে এসে বলতাম স্যার অসুস্থ ছিলাম। প্রায় অসুস্থতার কথা বলে স্কুল বন্ধ করতাম। পরবর্তীতে শ্রেণি শিক্ষকের কাছে মার খেয়ে স্কুল বন্ধ করা বাদ দিয়ে দিলাম। পুনর্মিলনীতে এসে অনেকের সঙ্গে দেখা হলো। সত্যিই নস্টালজিক হয়ে পড়েছি আমরা।’

যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের সহকারী অধ্যাপক হামিদুল হক বলেন, ‘বহু বছর পর বিদ্যালয়ের পরিচিত মুখগুলো একসঙ্গে আজ। ছোটবেলার সেই রঙিন দিনগুলো বারবার মনে পড়ছে। এই মিলনমেলা যেন আমাদের সামনে এগিয়ে চলার শক্তি আরও দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।’ 

যশোর জিলা স্কুলের বর্তমান শিক্ষার্থী অর্জন বলেন, ‘এই স্কুলে আমার দাদা পড়েছেন, বাবা-চাচারা পড়েছেন, আমিও পড়ছি, আমরা ছোট ভাইরাও পড়ছে। নবীন-প্রবীণদের একসঙ্গে পেয়ে অনেক ভালো লাগছে।’

সরেজমিন দেখা যায়, জিলা স্কুলের মাঠে টাঙানো হয়েছে শামিয়ানা। বসানো হয়েছে বিশাল মঞ্চ। আলোকসজ্জায় সেজেছে পুরো উৎসবস্থল। মাঠের একপাশে রয়েছে পিঠার স্টল। পুরোনো বন্ধুদের কাছে পেয়ে কেউ কুশল বিনিময়ে ব্যস্ত। একে অন্যকে বুকে জড়িয়ে ধরছেন কেউ। কেউ খুলেছেন গল্পের ঝাঁপি। অনেকেই গল্প করছেন আর বিভিন্ন স্বাদের পিঠা খাচ্ছেন। নবীন-প্রবীণ শিক্ষার্থীরা এই অনুষ্ঠানে এসে যেন ফিরে গিয়েছিলেন সেই ছোটবেলার সোনালি দিনগুলোতে। স্কুল প্রাঙ্গণের প্রাক্তনদের কণ্ঠ থেকে ভেসে আসছিল, ‘বন্ধু, কী খবর বল, কত দিন পর দেখা’, ‘এই মাঠেই তো খেলে বেড়াতাম, আজ চেনাই যায় না’ তারা বলছিলেন মনের গহিনে জমে থাকা নানা কথা। অনুষ্ঠানে সেনা কর্মকর্তা, আইনজীবীসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত প্রাক্তন ছাত্র ও তাদের স্বজনেরা উপস্থিত ছিলেন। তারা শৈশবের স্মৃতিচারণা আর দীর্ঘদিনের জমানো কথা বলে জমজমাট আড্ডায় মেতে ওঠেন।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও ঝিনইদহ-৩ (মহেশপুর) আসনের সংসদ সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) সালাহউদ্দি মিয়াজী, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবরাউল হাছান মজুমদার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) বেলাল হোসাইন, যশোর জিলা স্কুল প্রাক্তন ছাত্র সমিতি ঢাকার সভাপতি এ এম জাকারিয়া মিলন, জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক শোয়েব আলী। 

সমিতির সভাপতি এ জেড এম সালেকের সভাপতিত্বে  স্বাগত বক্তব্য রাখেন- সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহীন চৌধুরি। শোক প্রস্তাব করেন সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক এস এম তৌহিদুর রহমান। সন্ধ্যা থেকে সাংস্কৃতিক পর্বে শুরু হয়। রাতে নৈশ্যভোজের মাধ্যমে প্রথমদিনের অনুষ্ঠান শেষ হয়। 

শনিবার (২৭ জানুয়ারি) সকাল থেকে রাত অবধি শোভাযাত্রা, স্মৃতিচারণা, আড্ডা, প্রাক্তন শিক্ষক সংবর্ধনা ও বর্তমান শিক্ষক পরিচিতি, বৃত্তি প্রদান, পৃষ্ঠপোষক সম্মাননা, র‍্যাফেল ড্র, আতশবাজির আয়োজন রাখা হয়েছে। সাংস্কৃতিক পর্বে জনপ্রিয় ব্যান্ড মাইলস সংগীত পরিবেশন করবে।