সারা বাংলা

ইটভাটা গিলছে কৃষিজমি, বিপন্ন পরিবেশ

কৃষিজমির মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে ইটভাটায়। চুল্লিতে পুড়িয়ে সেই মাটি ইট হয়ে পাড়ি দিচ্ছে নানা অঞ্চলে। কিছু দিন আগেও যেখানে ছিল সবুজ ধানখেত, এখন সেখানে তৈরি হচ্ছে জলাশয়।

প্রশাসনের নজর এড়িয়ে বদলে যাচ্ছে জমির চরিত্র। কমছে জমির উর্বরতা। কোথাও কৃষক স্বেচ্ছায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করছেন, আবার কোথাও বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। এছাড়া, ইট তৈরির প্রক্রিয়ায় আগুনের তাপ, ধোঁয়া ও ধূলাবালিতে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারাও।

ঢাকার সাভার ও ধামরাই উপজেলা জুড়ে এমন দৃশ্য এখন খুব স্বাভাবিক। বেশিরভাগ ইটভাটা গড়ে উঠেছে ফসলি জমি, আবাসিক এলাকা ও নদীর পাড় ঘেঁষে। ইটভাটা মালিকরা জানান, বছরের নভেম্বর মাস থেকেই ইট প্রস্তুতের কাজ শুরু হয়। চলে পরের এপ্রিল পর্যন্ত। সক্ষমতা অনুযায়ী একেকটি ভাটা এই সময়ে ৬০ লাখ থেকে এক কোটি ইট প্রস্তুত করে। যেখানে ৫ লাখ থেকে ৯ লাখ ঘনফুট মাটির প্রয়োজন হয়। এসব মাটির বেশিরভাগই সংগ্রহ করা হয় ফসলি জমি থেকে। কিছু আসে নদী, বিল বা পুকুর খননসহ সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প থেকেও।

সম্প্রতি সাভার ও ধামরাইয়ের বেশ কয়েকটি এলাকায় গিয়ে মাটি কেটে নেওয়ার দৃশ্য চোখে পড়ে। সাভারের শিমুলিয়া ইউনিয়নের গাজীবাড়ি, বিক্রমপুর, সামারটিকি, ধামরাইয়ের কুশুরা ইউনিয়নের বড় কাঠালিয়া, বালিয়া ইউনিয়নের দুনিগ্রাম, নয়াচর, আমতা ইউনিয়নের জেঠাইল ব্যাপারি পাড়াসহ বিভিন্ন এলাকার ফসলি জমিতে খনন করতে দেখা যায়। এসব মাটি যাচ্ছে ইটভাটায়।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নগদ টাকার প্রলোভনে ও পার্শ্ববর্তী জমির মাটি বিক্রি করায় বাধ্য হয়ে অন্যান্য জমির মালিকরা জমির মাটি বিক্রি করছেন। এছাড়া মাছ চাষে উদ্বুদ্ধ করে জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে মাটি কিনে নিচ্ছেন ইটভাটার মালিকপক্ষ।

কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি বিক্রি করায় জমির উর্বরতা কমে যাচ্ছে। ধামরাইয়ের কাওয়ালীপাড়া থেকে বালিয়া সড়কের মাদারপুর, বাস্তা এলাকায় সড়কের উভয় পাশের বেশ কয়েকটি স্থানে ইটভাটার জন্য গভীর করে কৃষি জমির মাটি কেটে নেওয়ায় সেখানে তৈরি হয়েছে গভীর খাঁদ।

সাভার ও ধামরাই উপজেলার ইটভাটাগুলোর অধিকাংশ কৃষি জমি ও আবাসিক এলাকায় গড়ে ওঠায় এসব ইটভাটার তাপ, ধোঁয়া ও ধূলাবালিতে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এসব এলাকার বাসিন্দারা। এছাড়া খোলা ট্রাকে মাটি পরিবহনের সময় ট্রাক থেকে সড়কে পড়া মাটি পরে ধুলোয় রূপান্তরিত হয়ে চলে যাচ্ছে সড়ক লাগোয়া ফসলি জমি ও বসতবাড়িতে। এতে সড়ক লাগোয়া জমির ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বসতবাড়িতে বসবাসকারীরা পড়ছেন বিপাকে।

পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সাভার উপজেলা ও ধামরাই উপজেলায় মোট ২৮৪টি ইটভাটা রয়েছে। যার ৬৭টি অবৈধ। অবৈধ ইটভাটা বন্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর ও উপজেলা প্রশাসন প্রতি বছরই সাভার ও ধামরাইয়ের বিভিন্ন অবৈধ ইটভাটায় অভিযান চালিয়ে আর্থিক জরিমানাসহ ইটভাটার চিমনি ও চুল্লির আংশিক গুড়িয়ে দেয়। তবে কিছুদিন পরেই ভাঙা অংশ মেরামত করে পুনরায় ইট প্রস্তুতের কার্যক্রম শুরু করে দেন ইটভাটা সংশ্লিষ্টরা।

গত বুধবার (৩১ জানুয়ারি) ধামরাইয়ের বিভিন্ন এলাকার অভিযান চালিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর সাতটি অবৈধ ইটভাটাকে মোট ৪৭ লাখ টাকা জরিমানাসহ ইটভাটার আংশিক ভেঙে দেয়। ইটভাটা সংশ্লিষ্টরা জানান, ইটভাটাগুলো কতোটুকু জায়গা নিয়ে গড়ে উঠবে সে ব্যাপারে কোনো ব্যধ্যবাধকতা নেই।

সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মোহাম্মদ সায়েমুল হুদা বলেন, আইন মেনে ইটভাটাগুলো অবশ্যই জনবসতি এলাকার বাইরে বানাতে হবে। ইটভাটার ধুলোবালি থেকে শ্বাসকষ্ট, শ্বাসনালীতে প্রদাহ, ফুসফুসে দীর্ঘমেয়াদী রোগ হতে পারে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জামাল উদ্দিন বলেন, সাধারণত জমির ছয় ইঞ্চি পরিমাণ মাটি যেকোনো ধরনের ফসল উৎপাদনের জন্য খুবই জরুরি। কিন্তু ইটভাটায় জমির ১ ফুটের বেশি গভীর করে মাটি কেটে নেওয়া হয়। এর ফলে জমি উর্বরতা হারিয়ে ফেলে। ইট পোড়ানোর ক্ষেত্রে খনিজ কয়লা ব্যবহার করা হয়। এছাড়া আইন না মেনে অনেকে কাঠ পুড়িয়ে সেই কয়লা ইটভাটায় ব্যবহার করছে।

তিনি আরও বলেন, কয়লা পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট ধোঁয়ার কার্বন ডাই অক্সাইডে বায়ু দূষিত হচ্ছে। বিশেষ করে খনিজ কয়লা থেকে উৎপন্ন সালফার ডাই অক্সাইড ও কার্বন মনো অক্সাইড এবং নাইট্রাস অক্সাইড এ তিন ধরনের গ্যাস বায়ু দূষণ করে। ইটভাটার ধুলাবালি গাছপালা ও ফসলের উপর পড়ে পুরু আস্তরণ তৈরি করে। এতে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়ে জীববৈচিত্র্য’র উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। ফলে উৎপাদন ব্যহত হয়।

পরিবেশ অধিদপ্তর ঢাকা জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. জহিরুল ইসলাম তালুকদার বলেন, ইতোমধ্যে ধামরাইয়ে অভিযান চালিয়ে ৭টি ইটভাটাকে মোট ৪৭ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এ অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

ভেঙে দেওয়া অবৈধ ইটভাটায় পুনরায় সংস্কার করে কার্যক্রম শুরুর বিষয়ে তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, পরিবেশ অধিদপ্তরের জেলা কার্যালয়, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়, উপজেলা ভূমি কার্যালয় ও কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি সেল গঠন করা হলে এ সমস্যা সমাধান সম্ভব। অন্যথায় কারো একার পক্ষে এটি মনিটরিং এবং সমাধান করা কঠিন।

ধামরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাজওয়ার আকরাম সাকাপি ইবনে সাজ্জাদ বলেন, ইতোমধ্যে ৪-৫টি অভিযান চালিয়ে অবৈধভাবে কৃষি জমির মাটি কেটে নেওয়ার সঙ্গে জড়িতদের ৩-৪ লাখ টাকা আর্থিক জরিমানা করা হয়েছে। এছাড়া ২১টি ড্রাম ট্রাক ও চারটি ভেকু জব্দ করা হয়েছে। ইটভাটা তৈরির ক্ষেত্রে জমির সুনির্দিষ্ট কোনো পরিমাণ নেই। যে পরিমাণ জমি নিয়ে ইটভাটা নির্মাণ করা হয় সেই পরিমাণ জমির খাজনা আদায় করা হয়ে থাকে।

তিনি আরও বলেন, বায়ু দূষণ কমাতে জিগজাগ পদ্ধতিতে ইটভাটা পরিচালনার জন্য ইটভাটার মালিকদের উদ্বুদ্ধ করতে উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় আইসিডিডিআরবি’র উদ্যোগে উপজেলা কমপ্লেক্সে কর্মশালা করা হয়েছে।