মতামত

বাংলা ভাষার উত্তরাধিকার

মাতৃভাষার জন্য আমাদের পূর্বপুরুষেরা জীবন দিয়েছেন, এই ইতিহাস পৃথিবীর আর কোথাও নেই। পুরো পৃথিবীর আলাদা-আলাদা জাতিগোষ্ঠীর স্ব-স্ব মাতৃভাষা রক্ষার জন্য, আমাদের ভাষা আন্দোলন একটি বৈশ্বিক উদাহরণ। যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হচ্ছে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।

বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা রক্ষার জন্য জীবন দিয়েছেন আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, রফিকউদ্দিন আহমদ, আবদুস সালাম ও শফিউর রহমানসহ আরও অনেকে। নাম জানা, না জানা সেই ভাষা শহিদদের চেনতা যেন হারিয়ে না যায়।

আমরা দাবি করি বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য আছে। এই ঐতিহ্যের গৌরব ও সৌরভ প্রজন্মের পর প্রজন্ম পেতে পারে বাংলা ভাষা চর্চার মাধ্যমে। আর এজন্য অবশ্যই আমাদেরকে বাংলা ভাষা চর্চার প্রতি অগ্রাধিকার দিতে হবে। আমি কখনোই বলছি না যে, অন্য ভাষা শেখা যাবে না। আরবি, ফারসি, ইংরেজি যার যে ভাষায় আগ্রহ আছে, তিনি সেই ভাষা শিখবেন। এতে দোষের কিছু নেই।

ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যুগে যুগে এই ভূখণ্ডের মানুষের রাষ্ট্রীয় ভাষায়ও পরিবর্তন এসেছে। ব্রিটিশ শাসনামলে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ভাষা ছিল ইংরেজি। ইংরেজি ভাষায় যারা পারদর্শী ছিলেন তারা উচ্চপর্যায়ে থেকে কাজ করতে পেরেছেন, বিভিন্ন সুযোগ সুবিধাও পেয়েছেন। কিন্তু ওই সময়টাতেও বাংলা ভাষা চর্চারও একটি স্ফুরণ ঘটেছিল।

আঠারোশো বিশ থেকে উনিষশো বিশ সাল এই সময়কালটার দিকে ফিরে তাকালে বাংলা সাহিত্যের প্রধান প্রধান সাহিত্যিকদের সাহিত্য খুঁজে পাবো। ওই সময়টাতেও মাতৃভাষা বাংলা রক্ষার প্রচণ্ড চাপ ছিল। যার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটেছে পাকিস্তান শাসনামলে উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে।

মুঘলরা তাদের ভাষা আমাদের ওপর চাপাতে চেয়েছে, পাঠানরাও তাদের ভাষা আমাদের উপর চাপাতে চেয়েছে; এবং চাপিয়েছে। কারণ তারা তাদের ভাষায় রাষ্ট্রীয় কার্য পরিচালনা করেছে, বাংলা ভাষায় নয়।

দীর্ঘ একটা সময় এভাবে পার করে পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালি তার মাতৃভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য বিদ্রোহ করেছে, আন্দোলন করেছে এবং জীবন দিয়েছে। যা পৃথিবীর আর কোথাও ঘটেছে বলে জানা যায় না। আমাদের স্লোগান ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। আজ-এখানে দাঁড়িয়ে আমরা আমাদের স্লোগান থেকে সরে গিয়েছি। নিজেরাই রাষ্ট্র ভাষা থেকে বাংলাকে আস্তে আস্তে সরিয়ে দিচ্ছি। এখন পর্যন্ত উচ্চশিক্ষা, ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার মাধ্যম ইংরেজি।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, পর্তুগিজ পাদ্রি ম্যানুয়েল-দা-আস্সুম্পসাউ বাংলা ভাষায় অভিধান রচনার প্রথম প্রয়াসের সফল রচয়িতা। একটা সময় আমরা-সহ বিদেশি-উপনিবেশিক শক্তি যারা ছিলেন; তারাও অনেকে আমাদের বাংলা ভাষা রক্ষার জন্য কাজ করেছেন। খাঁটি বাংলা ভাষা বলতে আমরা যে ভাষা বুঝি মধ্যযুগের কবিদের লেখায় আমরা কিন্তু সেই ভাষা পাই না। মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে বাংলাভাষার লিখিত আধিপত্য বিস্তার লাভ করেছে। লিখিত বাংলা ভাষা আরও সহজবোধ্য হয়েছে শরৎচন্দ্রের লেখার মাধ্যমে।

পরবর্তীতে উনিশ শতকের চল্লিশের দশক থেকে আশির দশক পর্যন্ত যেসব কবি-সাহিত্যিকদের রচিত সাহিত্যের মাধ্যমে সাধারণের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে বাংলা ভাষার সমৃদ্ধ রূপ ও সাহিত্য। সবশেষ যার অবদান স্বীকার না করলেই নয়, তিনি হুমায়ূন আহমেদ। যিনি বাঙালিকে বাংলা সাহিত্য পড়িয়েই ছেড়েছেন।

বাংলা ভাষা চর্চার ফলে এই সাহিত্যিকেরা বাঙালির সুখ, দুঃখ, আনন্দ-উৎসব, চাওয়া-পাওয়া, শাসন- শোষণ, স্বাধীনতা থেকে স্বাধিকারের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরতে পেরেছেন। এর মাধ্যমে বাংলা ভাষা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্য পাঠের কারণে, তখনকার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর লেখনীর মান ছিল অনেক উন্নতমানের।

নব্বই দশকের পর থেকে এখন পর্যন্ত পাশ্চাত্যের সঙ্গে আমাদের যোগসূত্রটা এমন ভাবে তৈরি হয়েছে যে, আমাদের শ্রেণি কাঠামো ভেঙে পড়েছে। এর আগ পর্যন্ত আমদের মূলত পরিচালনা করত বাঙালি মধ্যবিত্ত। এখন যতদিন যাচ্ছে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিটাই থাকছে না। একটা শ্রেণি হয় উচ্চবিত্ত আরেকটা শ্রেনী নিম্নবিত্ত যাচ্ছে। অর্থনৈতিক কাঠামোটা এমন হয়ে গেছে যে, মধ্যবিত্ত শ্রেণিটা থাকছে না। হয় তারা উপরে উঠে যাচ্ছে না হয় নেমে যাচ্ছে। 

সমস্যা হয়ে গেছে যারা উচ্চবিত্ত তারা বাংলা ভাষা চর্চা থেকে সরে যাচ্ছে, নিম্নশ্রেণিটা এই ভাষার শুদ্ধ ব্যবহার করছে না। একটা সময় পর্যন্ত ধারণা ছিল যে উর্দুতে কথা বলা হচ্ছে খানদানি লক্ষণ। এখন প্রবণতাটা হচ্ছে বাসা বাড়িতে, আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে, নিজেদের মধ্যে ইংরেজিতে কথা বলা মানে নিজেদেরকে খানদানি প্রমাণ করা। মানে তিনি একটু পশ, সাধারণ বাঙালি নন। এই অবস্থাকে আমি মনে করি যে মানসিক বিকারের একটা অবস্থা। জাতিগতভাবে এটা কোন সুস্থ্যতার লক্ষণ না।

আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত থেকে নিজেদের এবং পরবর্তী প্রজন্মকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের প্রত্যেকের। মনে রাখতে হবে মাতৃভাষা ছাড়া আর কোনো ভাষাতেই কেউ নিজের অনুভূতির সঠিক প্রকাশ ঘটাতে পারে না। আমাদের নিত্যদিনের হাসি-কান্না হোক আমাদের ভাষায়। পৃথিবীর সব মাতৃভাষার মানুষেরা তাদের মায়ের ভাষায় হাসুক-কাঁদুক; কথা বলুক।