সারা বাংলা

ভাষা শহিদ আবুল বরকত সম্পর্কে জানে না বর্তমান প্রজন্ম

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের মিছিলে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে শহিদ হন আবুল বরকত। পরে এই বীর ভাষা সৈনিককে রাজধানীর আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়।

ভাষা শহিদ আবুল বরকতের পরিবারের আবাসস্থল গাজীপুরে। তবে প্রচার ও প্রকাশের অভাবে আগামী প্রজন্মসহ অনেক মানুষ জানে না যে, ভাষা শহীদ আবুল বরকতের উত্তরসূরীরা এখানকার বাসিন্দা।

বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিলিয়ে দেওয়া এই সূর্যসন্তানের নামে গাজীপুরে রয়েছে একটি স্টেডিয়াম (গাজীপুর শহিদ বরকত স্টেডিয়াম), গাজীপুরের চান্দিনায় শহিদের নামে রয়েছে একটি সড়ক (বরকত সরণী)। তবে সেটিতে করা হয়নি কোনো গেইট। এছাড়া গাজীপুরে তেমন কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বরকতের বাবা শামসুজ্জোহা ভুলু মিয়া ভারতে মারা যান। এরপর পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ থেকে আংশিক সম্পত্তির বিনিময়ে দুই ছেলে ও চার মেয়েকে নিয়ে এদেশে চলে আসেন হাসিনা বিবি। নিবাস গড়েন গাজীপুর মহানগরের চান্দিনাতে। পরে তিনি ১৯৮২ সালের ২১ এপ্রিল সেখানেই মারা যান। ভাষা শহিদ বরকতের মা হাসিনা বিবিকে গাজীপুর মহানগরীর চান্দিনাতে করব দেওয়া হয়। কবরের চারপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার পাশাপাশি লাগানো হয়েছে কিছু ফুলগাছ। সারাবছর অবহেলায় সবার মনোযোগ ও দৃষ্টিসীমার বাইরে থাকলেও ফেব্রুয়ারিতে অনেকেই এখানে খোঁজখবর নেন।

শহিদ বরকতের একমাত্র ভাই আবুল হাসনাত ১৯৬৮ সালের ২১ সেপ্টেম্বর রোগে ভুগে মারা যান। বরকতের সব বোনই মারা গেছেন। তবে বরকত, তার মা ও ভাইয়ের মৃত্যু যেন একই সূত্রে গাঁথা। এদের সবাই মারা গেছেন বিভিন্ন বছর বিভিন্ন মাসের ২১ তারিখে। এখন বরকতের ছোট ভাই আবুল হাসনাতের সন্তানরাই আঁকড়ে ধরে আছেন এই ভাষা শহিদের ব্যক্তিগত সব স্মৃতি।

আবুল বরকতের ভাতিজা আইনউদ্দীন বরকত বলেন, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের মিছিলে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন আমার চাচা। প্রতিবছর একুশ আসে কিন্তু আমাদের পরিবারের খোঁজ কেউ নেয় না। বরকতের ৫টি পরিবার রয়েছে। তার মধ্যে ৩টি পরিবার খুবই দরিদ্র। এদের পাশে রাষ্ট্রের দাঁড়ানো উচিত ছিল। এমনকি এই ভাষা শহিদের ইতিহাস সংরক্ষণে সরকারিভাবে তেমন কোনো উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। আবার প্রচার ও প্রকাশের অভাবে গাজীপুরের আগামী প্রজন্মসহ অনেক মানুষ জানে না তার সম্পর্কে।

তিনি আরও বলেন, যারা ভাষার জন্য শহিদ হলেন তাদের পরিবারের কোনো সদস্যকেই বাংলা একাডেমিতে একুশে বইমেলার কোনো অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেওয়া হয় না। রাষ্ট্রীয়ভাবে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে ফুল দেওয়ার অনুষ্ঠানেও তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয় না। এমনকি প্রচারণা না থাকার ফলে শহিদের পরিবারের কথা আগামী প্রজন্ম জানেই না।

আইনউদ্দীন বরকত বলেন, আমার চাচা ভাষা শহিদ আবুল বরকত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নামে কোনো হল নেই। আমাদের আশা ও দাবি যারা মাতৃভাষার জন্য জীবন দিয়েছেন তাদের স্মরণে আরও অনেক কিছু করা প্রয়োজন। ভাষা শহিদদের ২০০০ সালে মরণোত্তর একুশে পদক দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাদের ভাগ্যে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা ও স্বীকৃতি ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ জোটেনি।

আইনউদ্দীন বরকত আরও বলেন, বরকতের মায়ের কবরের পাশে ৯ শতাংশ জায়গার মধ্যে একটি মসজিদ তৈরি করেছি। প্রতিবছর এখানে প্রায় দেড় হাজার লোক খাওয়ানো হয়। এর ব্যয়ভার আমরা নিজেরাই বহন করি। তবে আমরা চাই কবরের পাশে মসজিদ নির্মাণে সরকার সহযোগিতা করুক।

গাজীপুর জেলা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জেলার স্থায়ী বাসিন্দা মো. মেরাজ হোসেন বলেন, ভাষা শহিদ বরকত ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য শহিদ হয়েছেন। এরচেয়ে বেশি কিছু জানি না।

শহিদ এ পরিবারের কোন খবর সে জানে কিনা এ প্রশ্নের জবাবে বলেন, না।

একই কথা বলেন, একই জেলার বাসিন্দা ও একই কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আলী হোসেন, যুবরাজ সরকার ও সানোয়ার হোসেন।

কাজী আজিম উদ্দিন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তানজিম হাসান বলেন, ২ বছর ধরে প্রায় প্রতিদিন এখান দিয়ে কলেজে যাই অথচ গত সপ্তাহে জানলাম শহিদ বরকতের মায়ের করব এখানে। পরে বন্ধুদের নিয়ে দেখতে এসেছি। মাতৃভাষার জন্য জীবন দেওয়া ভাষা শহিদের মায়ের কবর আরও পরিষ্কার ও সমৃদ্ধ থাকা প্রয়োজন।

এ বিষয়ে গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. মামুনুল করিম বলেন, ভাষা শহিদ বরকত গাজীপুরের গর্ব। ইতোমধ্যেই এই বীর সম্পর্কিত তথ্য বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম শুরু করেছে গাজীপুর জেলা প্রশাসন। শহিদ বরকতের মায়ের কবরের পাশে মসজিদ নির্মাণে জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে সহযোগিতা করা হবে।