সারা বাংলা

জনবল সংকটে ব্যাহত হচ্ছে কাঙ্ক্ষিত সেবা

ফেনী প্রাণিসম্পদ দপ্তরে পশুচিকিৎসক সংকটের কারণে কাঙ্ক্ষিত সেবা পেতে বিড়ম্বনায় পড়ছেন প্রান্তিক পর্যায়ের খামারি ও পশু পালনকারীরা। জেলার ৬ উপজেলায় ৮৩ পদের বিপরীতে বর্তমানে শূন্য পদ ৩৫টি। পশু চিকিৎসক নেই ৫ উপজেলায়। শূন্য পদে পদায়ন না হওয়ায় প্রাণিসম্পদ সংশ্লিষ্ট অন্য যারা আছেন তাদের সহযোগিতায় সেবা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. মোজাম্মেল হক। 

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. মোজাম্মেল হক বলেন, জেলায় বর্তমানে ৮৩ পদের বিপরীতে ৩৫টি পদ শূন্য। ছয় উপজেলার মধ্যে শুধু ফুলগাজী উপজেলায় ভেটেরিনারি সার্জন আছেন। বাকি উপজেলাগুলোতে কোনো সার্জন নেই। যেসব পদে লোক নেই সেসব পদে লোকবল দেওয়া হলে আমাদের সার্বিক কার্যক্রম আরও গতিশীল হবে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। আশা করছি, খুব তাড়াতাড়ি সমস্যার সমাধান হবে। 

সরেজমিনে ফেনী সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরে গিয়ে দেখা যায়, চিকিৎসক না থাকায় হাসপাতালে আসা অসুস্থ পশুর চিকিৎসা দিচ্ছেন উপ-সহকারী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (সম্প্রসারণ) মো. ছাদেক মজুমদার। তিনি বলেন, জনবল না থাকায় আমি বাড়তি দায়িত্ব পালন করছি। ভেটেরিনারি সার্জন থাকলে আমাকে পশুর চিকিৎসা করতে হতো না। তিন জনের দায়িত্ব একজন পালন করতে গেলে সমস্যা হবে। শূন্য পদে জনবল নিয়োগ করা গেলে সেবার মান বৃদ্ধির পাশাপাশি কাজের পরিধিও বাড়বে।

জনবল সংকটের কারণে প্রান্তিক পর্যায়ে সেবা কার্যক্রম সম্ভব হয় না ফলে কোনো কোনো এলাকার মানুষ জানে না প্রাণিসম্পদ দপ্তরের কার্যক্রম সম্পর্কে। মাঠ পর্যায়ে খামারি ও পশুু পালনকারীদের সঙ্গে কথা বললে এ বিষয়টি উঠে আসে।

গত ১৫ বছর ধরে বাড়িতে গরু পালন করছেন নূর নাহার বেগম। যেকোনো সমস্যা দেখা দিলে স্থানীয় গ্রাম্য চিকিৎসক এনে টাকা দিয়ে চিকিৎসা করান পশুর। স্থানীয়ভাবে সরকারি পশু চিকিৎসক বিনামূল্যে সেবা দেন এ বিষয়ে তিনি তেমন জানেনও না। এভাবে বাড়িতে পশুপালনে নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানান পরশুরাম উপজেলার বীরচন্দ্রনগর গ্রামের এই নারী। তার মতো একই সুরে কথা বলেছেন জেলার প্রান্তিক পর্যায়ে পশুপালনে যুক্ত অনেকেই। 

জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ফেনী জেলায় গবাদিপশু গরু, মহিষ, ভেড়া ও ছাগল রয়েছে ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৯২৩টি। হাঁস-মুরগি রয়েছে ৯৯ লাখ ৭৭ হাজার ২৭১টি। এসব পশুর চিকিৎসায় ছয় উপজেলার ফুলগাজী ছাড়া অন্য পাঁচটিতেই নেই চিকিৎসক। এতে ব্যাহত হচ্ছে পশুচিকিৎসা কার্যক্রম।

সূত্র জানায়, জেলায় প্রাণিসম্পদ বিভাগের জনবলকাঠামোয় অনুমোদিত পদ ৮৩টি। এখন জনবল আছে ৪৮ জন। 

ফেনী সদর উপজেলার ইজ্জতপুর এলাকার বাসিন্দা আবদুর রহিম বলেন, বাড়িতে ৬টি গরু ও ৭টি ছাগল পালন করছি। রোগবালাই সম্পর্কে তেমন ধারণা না থাকায় প্রায় সময় পশু হাসপাতালে আসা হয়। এখান থেকে কিছু ওষুধ লিখে দিলে বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে। সরকারিভাবে যদি আরও সহযোগিতা পাওয়া যায় আমরা উপকৃত হতাম।

সদর উপজেলা পশু হাসপাতালে স্কুল পড়ুয়া ছেলের বিড়ালের চিকিৎসার জন্য আসেন শহরের একাডেমি এলাকার বাসিন্দা জহির উদ্দিন। নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, হাসপাতাল থেকে ভ্যাকসিনগুলো দেওয়া হয়। অন্য ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়। চিকিৎসক না থাকায় স্বয়ং উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা নিজেই চিকিৎসা দিয়েছেন। চিকিৎসক থাকলে আমরা আরও ভালো সেবা পেতাম।

পরশুরাম উপজেলার জয়ন্তীনগর গ্রামের খামারি আলমগীর হোসেন বলেন, খামারে বিভিন্ন সময়ে ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে মুরগি মারা যায়। তখন অভিজ্ঞ কাউকে এনে টাকা দিয়ে চিকিৎসা করাতে হয়। গত ৭ বছরে কখনো কোনো দপ্তরের সুযোগ-সুবিধা পাইনি। এসব বিষয়ে কেউ কখনো জানতেও চায়নি। 

ছাগলনাইয়া উপজেলার দক্ষিণ সতর নদীর কূল এলাকার বাসিন্দা নূর নবী বলেন, কখনো কোনো ধরনের সহায়তা পাওয়া দূরের কথা, এসব বিষয়ে শুনিওনি। গরুর কোনো সমস্যা দেখা দিলে গ্রাম্য চিকিৎসক বা ফার্মেসি থেকে ওষুধ নিয়ে খাওয়াই। প্রজননকালে এনজিওর লোকদের বাড়িতে এনে ১০০০ থেকে ১২০০  টাকা দিয়ে পশুর কৃত্রিম প্রজনন করাতে হয়।

যোগাযোগে দূরত্বের কারণে ফেনীর সমুদ্র উপকূলীয় উপজেলা সোনাগাজীর প্রাণিসম্পদ বিভাগের সেবাবঞ্চিত চরাঞ্চলের মানুষ। সরকারি ওষুধ, চিকিৎসা, প্রজনন সেবাসহ কোনো সেবাই পাচ্ছে না কয়েক হাজার গবাদিপশু। বেসরকারি বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে চড়া দামে সেবা কিনতে বাধ্য হচ্ছেন গবদিপশুর খামারিরা।

চরচান্দিয়া এলাকার খামারি জুবায়ের হোসেন রনি বলেন, আমরা বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে টিকে থাকতে পারলেও রোগবালাইয়ের কাছে হার মানতে হচ্ছে। সঠিক চিকিৎসা করতে পারছি না। চরাঞ্চল থেকে উপজেলা প্রাণিসম্পদ হাসপাতালের দূরত্ব ২৫-৩০ কিলোমিটার। গবাদিপশু আনা-নেওয়ার জন্য খরচ গুণতে হয় হাজার টাকার বেশি। সঙ্গে ওষুধ খরচ তো আছেই। এজন্য নিজেরাই অভিজ্ঞতা থেকে চিকিৎসা করি।

চর খন্দকারের মহিষ খামার মালিক শাহজালাল ভূঞা বলেন, পশু হাসপাতালটি উপজেলার এক প্রান্তে হওয়ায় সোনাগাজীর তিন ভাগ মানুষ সুবিধা ভোগ করতে পারছে না। উপজেলা সদরে প্রাণিসম্পদ বিভাগের একটি উপকেন্দ্র করা হলে সবাই সমানভাবে সুবিধা ভোগ করতে পারবে।

ফেনী সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরে সরকারিভাবে যে ওষুধ দেওয়া হয় সেটি খুবই সামান্য। এরচেয়ে বেশি ওষুধ বিভিন্ন কোম্পানি স্যাম্পল হিসেবে দেয়। এছাড়া, বাড়িতে গিয়ে পশুর চিকিৎসা বা অতিরিক্ত টাকা আদায় ও ওষুধের দাম বেশি রাখার কোনো অভিযোগ পাইনি। এ ধরনের অভিযোগ পেলে দাপ্তরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

তিনি আরও বলেন, উপজেলায় ১১টি সৃষ্ট পদের মধ্যে ভেটেরিনারি সার্জন, কম্পাউন্ডার ও ড্রেসারসহ তিনটি পদই শূন্য।পশুচিকিৎসা সম্পর্কিত প্রধান তিনটি পদে কোনো জনবল না থাকার পরেও আমরা সেবা প্রত্যাশীদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করার চেষ্টা করছি। প্রান্তিক পর্যায়ের পশুপালনকারী ও খামারিদের আধুনিক প্রযুক্তি বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া টিকাদান কার্যক্রমে গুরুত্ব দেওয়ায় আগের চেয়ে অনেক রোগবালাইয়ের সংক্রমণ থেকে পশুপাখি রক্ষা পাচ্ছে।

জেলায় চলমান কার্যক্রম প্রসঙ্গে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা  ডা. মো. মোজাম্মেল হক বলেন, বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর পশু পালনের বিষয়ে খামারিদের উদ্বুদ্ধ করতে মাঠপর্যায়ের প্রাণিসম্পদ বিভাগ কাজ করছে। বিভিন্ন ধরনের রোগবালাই থেকে গবাদি পশু রক্ষায় টিকাদান ও কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

কৃত্রিম প্রজননে বাড়তি টাকা নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রমে মাঠপর্যায়ে আমাদের একাধিক প্রশিক্ষিত টিম কাজ করছে। পশুর মালিক অনেক সময় ফোনকলে প্রজনন কার্যক্রমে নিয়োজিত এনজিওর কর্মীকে বাড়িতে নিয়ে যায়। সেক্ষেত্রে কিছু বাড়তি টাকা দেওয়ার ঘটনা ঘটে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দুর্যোগকালীন কর্মকাণ্ড ও প্রান্তিক পর্যায়ে সেবা পৌঁছে দেওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, জেলার একমাত্র উপকূলীয় উপজেলা সোনাগাজীতে বিভিন্ন দুর্যোগকালীন সময়ে মেডিকেল টিম গঠন করে পশু চিকিৎসা দেওয়া হয়। এছাড়া, চরাঞ্চল বা একদম প্রান্তিক পর্যায়ের সেবা প্রত্যাশীদের জন্য যদি ইউনিয়ন পর্যায়ে কার্যক্রম পরিচালনা করা যায় তাহলে সাধারণ মানুষ বেশি উপকৃত হবে।