সাতসতেরো

বর্মা যেভাবে ব্রিটিশ শাসনাধীন হয়েছিল

ইংরেজ সৈন্যবাহিনী এবং বর্মা তথা ব্রহ্মদেশের (মিয়ানমার) মধ্যে তিনটি যুদ্ধ হয়েছিলো। এসব যুদ্ধ ইতিহাসের পাতায় বর্মী যুদ্ধ বা ইঙ্গ-বর্মা যুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত হয়। ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দের আগ পর্যন্ত বর্মার সাম্রাজ্য বিস্তৃতির ফলে দেশটির সীমান্ত পরিবর্তন হতে থাকে। এক পর্যায়ে তা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং আরও পরে ব্রিটিশ ভারতের নিকটবর্তী হয়। কিন্তু সীমানা অনির্ধারিত ও অস্পষ্ট হওয়ায় সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে বসবাসরত জনসাধারণের মধ্যে শরণার্থী হওয়ার প্রবণতা বাড়ে। যা উভয়পক্ষের সৈন্যদলকে বিব্রত করে। এই সমস্যা সমাধানে যুদ্ধ সংঘঠিত হয় এবং পর্যায়ক্রমে তিন বার ইঙ্গ-বর্মা যুদ্ধ সংঘঠিত হয়েছে। এক সময় বর্মা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে পরিণত হয়।

প্রথম ইঙ্গ-বর্মা যুদ্ধ (১৮২৪ থেকে ১৮২৬ খ্রিষ্টাব্দ): প্রথম ইঙ্গ-বর্মা যুদ্ধ ব্রিটিশ বাহিনী ও বর্মী সৈন্যদলের মধ্যে সংঘঠিত হয়। এতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি জয়লাভ করে। তারপরে উভয়পক্ষের মধ্যে ‘ইয়াণ্ডাবু সন্ধি’ সাক্ষর হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে বর্মার অধীনে থাকা আসাম, মণিপুর এবং আরাকান রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। ব্রিটিশ বাহিনী টেনাসেরিম বিভাগ ‘টেনাসেরিম’ পর্যন্ত একটি পদযাত্রা করে, এর মূল উদ্দেশ্য ছিলো টেনাসেরিমকে একটি অন্তর্বর্তী অঞ্চল হিসাবে গণ্য করে ব্রহ্মদেশ (বর্মা) ও শ্যামদেশের (থাইল্যান্ড) সঙ্গে ভবিষ্যৎ আলোচনার পথ খোলা রাখা। এরপরেও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বর্মার মূল ভুখণ্ডের ওপর নিজেদের প্রভাব বিস্তারে উদ্যোগী হয়। দ্বিতীয় ইঙ্গ-বর্মা যুদ্ধ (১৮৫২ থেকে ১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দ): ইয়াণ্ডাবুর সন্ধি চুক্তির বেশ কয়েকটি ছোট- খাটো বিষয় নিয়ে লর্ড ডালহৌসি বর্মার সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে কমান্ডার ল্যাম্বার্টকে বর্মা পাঠান। কিন্তু বর্মীরা তাকে ভালোভাবে গ্রহণ করেন না। তারা এই ব্রিটিশ গুপ্তচরকে বর্মা থেকে সরিয়ে নেওয়ার দাবি তোলেন। ঘটনাক্রমে ল্যাম্বার্ট নৌ পরিবহন সংক্রান্ত আলোচনায় আগ্রহ প্রকাশ করলে ১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় ইঙ্গ-বর্মা যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে। এই যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনী দক্ষিণ বর্মার পেগু দখল করে নেয়। বর্মার রাজসিংহাসনে নবযুগ আসে। সে সময় রাজা পাগান মিন (১৮৪৬-১৮৫২) এর পরে তার বৈমাত্রেয় ভাই মিন্দন মিন (১৮৫৩-১৮৭৮) বর্মার রাজসিংহাসন দখল করেন।

তৃতীয় ইঙ্গ-বর্মা যুদ্ধ (১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দ): রাজা মিন্দন ব্রিটিশ আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্যোগ নেন। এজন্য তিনি বর্মার দেশীয় রাজ্যগুলোকে আধুনিকীকরণ এবং অর্থনৈতিকভাবে উন্নত করার লক্ষ্যে কাজ করেন। তার শাসনামলে বর্মার নতুন রাজধানী মান্দালয়তে স্থানান্তরিত করা হয়। কিন্তু মিন্দনের ছেলে এবং বর্মার পরবর্তী রাজা থিবৌ মিন (১৮৭৮-১৮৮৫) ছিলেন অদূরদর্শী রাজা। থিবৌ মিন ব্রিটিশ আক্রমণ আটকানোর জন্য ফ্রান্সের সাহায্য প্রার্থনা করেন। এর মাধ্যমে নিজ দেশে তার আধিপত্য কমতে শুরু করে। ধীরে ধীরে অসুরক্ষিত হয়ে পড়ে রাজ্যের সীমান্তগুলো। এই ভঙ্গুর শাসনাবন্থার সুযোগ নিয়ে ব্রিটিশ বাহিনী দাবি করে যে, থিবৌ মিন তার পিতা মিন্দন মিনের স্বাক্ষরিত চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। এই দায়ে  ব্রিটিশ বাহিনী ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে আবার বর্মার বিরুদ্ধে তৃতীয় ইঙ্গ-বর্মা যুদ্ধ ঘোষণা করে। এভাবে তৃতীয় ইঙ্গ-বর্মা যুদ্ধ শুরু হয় এবং ব্রিটিশ বাহিনী সমগ্র বর্মার ওপরই নিজের আধিপত্য বিস্তার করে। এভাবে বর্মা ব্রিটিশ শাসনাধীন সাম্রাজ্যে পরিণত হয়।

তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া এবং ‘Hutchinson University Library’ আর্কাইভ