মতামত

বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় তরুণ প্রজন্ম

‘সীমাবদ্ধতা সত্তেও শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ইতিহাসের দরজা খুলে যায়, সেই দরজা দিয়ে আমরা আমাদের নিয়তির সঙ্গে প্রতিনিয়ত পাঞ্জা লড়ছি।’- বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ কিংবা সিক্রেট ডকুমেন্ট অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ (আইবি) অন ফাদার অব দা নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর প্রতিটি খণ্ড পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তারুণ্যের ওপর বঙ্গবন্ধুর অগাধ বিশ্বাস ছিল। তরুণদের তিনি নির্ভরতার প্রতীক মনে করতেন।  বঙ্গবন্ধুর তরুণ জীবনের একটি চিত্রও এই গ্রন্থগুলোতে পাওয়া যায়। যেখানে একজন আপোসহীন, দৃপ্ত ছাত্রনেতার প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। বঙ্গবন্ধু বলতেন, নিজের ওপর বিশ্বাস রাখো, অভয় মানো, যেখানে অন্যায়-অবিচার সেখানে প্রতিরোধ গড়ে তোল। বঙ্গবন্ধু একদিকে ছিলেন তরুণদের জন্য আদর্শ, দিক নির্দেশক, আবার অন্যদিকে তরুণ বঙ্গবন্ধুর অনমনীয়, সাহসী চারিত্রিক দৃঢ়তা তরুণদের জন্য অবশ্য অনুকরণীয় চরিত্র।

বঙ্গবন্ধুর বৈশিষ্ট্য ছিল চূড়ান্ত ত্যাগ, সততা, নিষ্ঠা, দৃঢ়তা, সময়োচিত সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, আপোসহীন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পূঙ্খানুপূঙ্খভাবে অনুসরণ, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, তীব্র আত্মমর্যাদাবোধ, যুক্তিযুক্ত অধিকার সচেতনতা, নির্লোভ, সাংগঠনিক রীতিনীতি অনুসরণ, সিদ্ধান্তে অটল, কর্মীবান্ধব, ক্ষমতা আকড়ে ধরে না রাখার প্রবণতা। বঙ্গবন্ধু নিজের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে এ দেশের তরুণদের গড়ে তুলতে চেয়েছেন। 

১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা, শান্তি ও প্রগতির পতাকাবাহী ছাত্রলীগ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন এবং রক্ষার প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে থেকেছে নিয়ামক শক্তি হিসেবে। ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা, ১১ দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন, সর্বোপরি একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের চালিকা শক্তির ভূমিকায় রচিত হয়েছে দেশ ও জাতির সকল গৌরবগাথা। সামরিক শাসনের কঠোরতার মধ্যে একটি ছাত্রসংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগের এই অর্জন সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শি নেতৃত্বে।  

১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ ঢাকায় ছাত্রলীগের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে দেওয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলছিলেন, ‘আমি দেখতে চাই যে, ছাত্রলীগের ছেলেরা যেন ফার্স্টক্লাস বেশি পায়। আমি দেখতে চাই, ছাত্রলীগের ছেলেরা যেন ওই যে কী কয়, নকল, ওই পরীক্ষা না দিয়া পাস করা, এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে।’

ভাষা আন্দোলনের সময় থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তরুণদের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ‘তরুণদের বঙ্গবন্ধু’নিবন্ধে লিখছেন, তারুণ্যের স্বপ্ন এবং প্রত্যাশাকে তিনি নিজের ভেতর ধারণ করতেন, তারুণ্যের ক্ষোভ এবং দ্রোহের সঙ্গে একটা তাৎক্ষণিক সংযোগ তিনি ঘটাতে পারতেন। তাঁর সক্রিয়তা তিনি তরুণদের ভেতর সঞ্চারিত করতে পারতেন। 

তরুণ রাজনৈতিক সংগঠক হিসেবে তরুণদের উদ্বুদ্ধ করার তাঁর যে ক্ষমতা ছিল, তা ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগের পতন ঘটানোর পেছনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল। বাঙালির ইতিহাস ও সংস্কৃতি থেকে শক্তি নিয়ে তিনি এগোতেন, সে জন্য তিনি পথ ভুল করেননি। ১৯৫৪-এর নির্বাচন তরুণদের বিশাল সমাবেশ ঘটিয়েছিল। ১৯৫৮ সালে যখন পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হয় এবং বাঙালিদের ওপর দমন-পীড়ন শুরু হয়, বঙ্গবন্ধু এসবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার জন্য তরুণদেরই সংগঠিত করেন; তিনি কারান্তরীণ থাকলে তাঁর তরুণ সহকর্মীদের সেই কাজ করার দায়িত্ব দেন। ষাটের দশকে একটির পর একটি ছাত্র আন্দোলন যে পাকিস্তানের সেনাশাসকের ভিত্তি কাঁপিয়ে দেয়, তার পেছনে ছিল তারুণ্যের জাগরণ। 

এই জাগরণ শুধু রাজনৈতিক ছিল না, ছিল সাংস্কৃতিক এবং মৌলিকভাবে মুক্তিকামী। ষাটের দশকে সারা বিশ্বেই প্রথা এবং অচল নানা পদ্ধতি ও রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ হয়, তার প্রভাব ঢাকায়ও পড়েছিল। বাঙালি এই প্রথম নিজেদের এক বৈশ্বিক মাত্রায় দেখতে অভ্যস্ত হলো। এর ফলে বাঙালির মুক্তি আন্দোলন বিশ্বের মুক্তিকামী নানা আন্দোলনের সঙ্গে একটি যোগসূত্র স্থাপন করল। একাত্তরে এটি মূল্যবান একটি সংযোগ হিসেবে দেখা দিল।

১৯৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু যখন ঢাকার রেসকোর্স মাঠে বাঙালির স্বাধীনতার ডাক দিলেন, দেশের মানুষকে প্রস্তুত হওয়ার বার্তা দিলেন, তা সারা দেশে সব মানুষের কাছে পৌঁছে গেল। অনেক দুর্গম জায়গায় সেই বার্তা নিয়ে গেল তরুণেরা। পরিবারকে আর প্রতিবেশীদের জাগাল তরুণেরা। প্রতিটি ঘর একেকটি দুর্গ হয়ে দাঁড়াল।

তরুণদের সঙ্গে একটা অন্তরের সম্পর্ক ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। তিনি তাঁদের সংগ্রামের বাণী দিতেন, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সক্রিয়তায় উৎসাহিত করতেন, শিক্ষা এবং শিক্ষার আদর্শগুলো নিজেদের জীবনে ধারণ করার জন্য অনুপ্রাণিত করতেন। তরুণদের তিনি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে, অসত্য, অর্ধসত্যকে প্রত্যাখ্যান করতে, বঞ্চনা-অনাচার এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে উদ্দীপনা জোগাতেন। তিনি চাইতেন বাঙালি তরুণ যুগের আদর্শগুলো ধরে রেখে বিশ্বমানব হোক। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তারুণ্যের প্রেরণা এবং তারুণ্যের উদ্দীপনা। তারুণ্যের দ্রোহ দিয়েই তিনি বাঙালিকে জাগিয়েছিলেন। এ জন্য তরুণরা বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ ছিল এবং বঙ্গবন্ধুর নিউক্লিয়াস বলা হতো এই তরুণদেরকে। তরুণদের উপর ভর করেই তিনি স্বাধীকার আন্দোলন করেছিলেন, দেশ স্বাধীন করেছিলেন। তারুণ্যের শক্তিতেই তিনি নতুন দেশ উপহার দিয়েছিলেন জাতিকে। সেজন্যই তিনি জাতির পিতা।

বঙ্গবন্ধু সবসময় তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে ভাবতেন। তিনি বলতেন, ‘আমি যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখি, সে স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে পারে আমার নবীন প্রজন্ম।’ বঙ্গবন্ধুর পুরো রাজনৈতিক জীবন তারুণ্যে ভরপুর। তিনি তাঁর তারুণ্য সবসময় ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করতেন ছাত্র নেতাদের মধ্যে। ১৯৪৭ সালে ১৫০ মোগলটুলিতে মুসলিম লীগ নতুনভাবে সংগঠিত করতে গড়ে তোলা হয় ওয়ার্কাস ক্যাম্প। তরুণ শেখ মুজিব কেবল কলকাতা থেকে ফিরে ঢাকায় রাজনীতিতে মনোযোগ দিয়েছেন। শেখ মুজিবের সেই তরুণ বয়সের নেতৃত্ব নিয়ে কামরুজ্জামান লিখেছেন, ‘তরুণরা শেখ মুজিবের নেতৃত্বের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। তাঁর চোখে মুখে একটা দীপ্তি ছিল। কর্মীদের মধ্যে ভবিষ্যৎ তাঁর মুঠোয় আসতে বাধ্য সে বিশ্বাস জন্মাবার ক্ষমতা তাঁর ছিল। যেসব কর্মী তাঁর সান্নিধ্যে যেত তাদের সঙ্গে একটা কল্পনার সুখী সমাজের স্বপ্ন সৃষ্টি করার শক্তি তাঁর ছিল।’ 

১৯৭৩ সালের ১১ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের চতুর্দশ জাতীয় সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতা পেলেও এদেশের মানুষের প্রকৃত মুক্তি এখনো আসেনি। এই মুক্তি সেদিনই আসবে যেদিন তারা ভাত, কাপড়, শিক্ষা, বাসস্থান পাবে। সেদিন গড়ে উঠবে শোষণমুক্ত সোনার বাংলা। আর এটি গড়তে পার তোমরা তরুণরা। তোমরা সমাজতন্ত্রের কর্মীরাই পার দেশকে সমৃদ্ধ করতে।’

বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন তরুণ প্রজন্মকে যথার্থভাবে গড়ে তুলতে হলে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। তাই তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করেই শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার সিদ্ধন্ত নেন। বাহাত্তরের সংবিধানে সর্বজনীন শিক্ষা প্রবর্তনের অঙ্গীকার ঘোষণা করেন। শাসনভার গ্রহণের মাত্র ৬ মাসের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বে বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন নিয়োগ করেন। কুদরত-ই-খুদা কমিশন দেড় বছর কঠোর পরিশ্রম করে ব্যাপক জরিপ ও পর্যালোচনাভিত্তিক বাংলাদেশের শিক্ষা সংস্কারের একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করে একটি রিপোর্ট ১৯৭৪ সালের ৩০ মে সরকারের নিকট দাখিল করেন। কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের মাধ্যমে জাতীয় শিক্ষানীতি ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ বঙ্গবন্ধুই নিয়েছিলেন। 

১৯৭৩ সালের ১৯ আগস্ট সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বাবারা, একটু লেখাপড়া শিখ। যতই জিন্দাবাদ আর মুর্দাবাদ কর, ঠিকমত লেখাপড়া না শিখলে কোনো লাভ নেই। আর লেখাপড়া শিখে যে সময়টুকু থাকে বাপ-মাকে সাহায্য কর। প্যান্ট পরা শিখেছো বলে বাবার সাথে হাল ধরতে লজ্জা করো না।’ 

তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর এই ভাবনা মৃত্যুর শেষ দিনটি পর্যন্ত অটুট ছিল। বঙ্গবন্ধু জানতেন তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা তরুণদের ছাড়া সম্ভব নয়। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ শেষবারের মতো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসলেন বঙ্গবন্ধু। সেখানে তিল ধারণের স্থান নেই। সেই উদাত্ত কণ্ঠ, সেই মমতাময়ী ভাষা, কিন্তু যেন রয়েছে কিছু ব্যতিক্রম। সেই ভাষণেও ছিল তরুণ প্রজন্মের প্রতি দিক নির্দেশনা। ‘ছাত্র ভাইয়েরা, লেখাপড়া করুন। আমি দেখে খুশি হয়েছি, আপনারা নকল-টকল বন্ধ করেছেন একটু।’দ্বিতীয় বিপ্লবের জন্য, দেশ গঠনের জন্য চাইলেন তরুণদের সাহায্য। ‘আমার যুবক ভাইয়েরা, আমি যে কো-অপারেটিভ করতে যাচ্ছি গ্রামে গ্রামে, এর ওপর বাংলার মানুষের বাঁচা নির্ভর করবে। আপনাদের ফুলপ্যান্টটা একটু হাফপ্যান্ট করতে হবে। পাজামা ছেড়ে একটু লুঙ্গি পরতে হবে। আর, গ্রামে গ্রামে গিয়ে এই কো-অপারেটিভকে সাকসেসফুল করবার জন্য কাজ করতে হবে। এ কাজে যুবক চাই, ছাত্র চাই, সকলকে চাই।’

বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন তরুণ প্রজন্মের সত্যিকার দেশপ্রেম সৃষ্টির জন্য বাংলা ও বাঙালির আত্মপরিচয়ের ইতিহাস জানতে হবে। জানতে হবে আমাদের জাগরণের পথ। তাই ১৯৭১ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের ২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ঢাকার রমনা গ্রীণে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘বাংলার মানুষ বিশেষ করে ছাত্র এবং তরুণ সম্প্রদায়কে আমাদের ইতিহাস এবং অতীত জানতে হবে। বাংলার যে ছেলে তার অতীত বংশধরদের অতীত জানতে পারে না সে ছেলে সত্যিকারের বাঙালি হতে পারবে না। আজও বাংলাদেশের গৌরবময় ইতিহাস রচিত হয় নাই। নতুন করে বাংলার ইতিহাস রচনা করার জন্য দেশের শিক্ষাবিদদের প্রতি আমি আহ্বান জানাচ্ছি। এই ইতিহাস পাঠ করে যেন বাংলার ভবিষ্যৎ বংশধররা তাদের গৌরবময় অতীতের পরিচয় পেয়ে গর্ব অনুভব করতে পারে এবং মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে।’

এ ভাষণে তিনি ছাত্রলীগকে আত্মকলহে লিপ্ত না হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। নির্দেশ দিয়েছেন নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ফ্যাসাদ না করার। ‘তোমরা আত্মকলহে লিপ্ত হয়ো না। আজ ছাত্রলীগ কর্মীদের মধ্যে একতা প্রয়োজন সবচাইতে বেশি। এই একতা অক্ষুণ্ন না থাকলে ৬ দফার সংগ্রাম দুর্বল হয়ে পড়বে। ছাত্রলীগের মত বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান ভেঙে যেতে পারে, এমন কিছু করো না।’ 

বঙ্গবন্ধু সব সময় ইতিহাস থেকে বিপ্লবের শিক্ষা গ্রহণ করার কথা বলতেন। ছাত্রলীগের কর্মীদের বিপ্লবের ইতিহাস পড়ার পরামর্শ দিতেন। ‘জনগণকে ছাড়া গণবিপ্লব হয় না। রাতের অন্ধকারে গুলি মাইরা কোনদিন বিপ্লব হয় নাই। পড় সোভিয়েত রাশিয়ার বিপ্লবের ইতিহাস, পড় অন্যান্য দেশের বিপ্লবের ইতিহাস। পড় আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস। দেখ সেখানে কী হয়েছে। দেখ আমদের সাব-কন্টিনেন্টে কি হয়েছে। পড়, জান, শেখ, বোঝ। তারপর বিপ্লবের কথা বল। বিপ্লব রাতের অন্ধকারে গুলি কইরা, টেররিজম কইরা হয় না।’

বঙ্গবন্ধু রাজপথ থেকে উঠে আসা নেতৃত্ব, কর্মী থেকে নেতা হওয়া, তিনি সব সময় রাজপথে ভরসা রাখতেন, ভরসা রাখতেন আন্দোলনে। যেটা আজকের ছাত্র আন্দোলনে কিংবা নেতৃত্বে অনুপস্থিত।

১৮ জানুয়ারি ১৯৭৪ আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলের উদ্বোধনী বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বলছিলেন, ‘দেশ শাসন করতে হলে নিঃস্বার্থ কর্মীর প্রয়োজন। হাওয়া-কথায় চলে না। সেদিন ছাত্ররা আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। তাদের বলেছিলাম, আত্মসমালোচনা করো। মনে রেখো, আত্মসমালোচনা করতে না পারলে নিজকে চিনতে পারবা না। তারপর আত্মসংযম করো, আর আত্মশুদ্ধি করো। তাহলেই দেশের মঙ্গল করতে পারবা।’

১৯ জুন ১৯৭৫ বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক, বঙ্গবন্ধু বাকশালের তরুণ নেতৃত্বকে উদ্দেশ্য করে আবারো আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম আর আত্মশুদ্ধির কথা বললেন : ‘আজকে এই যে নতুন এবং পুরান যে সমস্ত সিস্টেমে আমাদের দেশ চলছে, আমাদের আত্মসমালোচনা প্রয়োজন আছে। আত্মসমালোচনা না করলে আত্মশুদ্ধি করা যায় না। আমরা ভুল করেছিলাম, আমাদের বলতে হয় যে, ভুল করেছি। আমি যদি ভুল করে না শিখি, ভুল করে শিখব না, সে জন্য আমি সবই ভুল করলে আর সকলেই খারাপ কাজ করবে, তা হতে পারে না। আমি ভুল নিশ্চয়ই করব, আমি ফেরেশতা নই, শয়তানও নই, আমি মানুষ, আমি ভুল করবই। আমি ভুল করলে আমার মনে থাকতে হবে, আই ক্যান রেকটিফাই মাইসেলফ। আমি যদি রেকটিফাই করতে পারি, সেখানেই আমার বাহাদুরি। আর যদি গোঁ ধরে বসে থাকি যে, না আমি যেটা করেছি, সেটাই ভালো। দ্যাট ক্যান নট বি হিউম্যান বিইং।’

তাঁর লক্ষ্য ছিল বাংলার মানুষের মুক্তি। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন তরুণরা একদিন সত্যি তাঁর ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলবে। ছাত্রলীগ কর্মীদের উপর তাঁর আস্থা ছিল। তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন ছাত্রলীগ কর্মীদের নৈতিক চরিত্রের প্রশিক্ষণের। ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নকে একসাথে কাজ করতে হবে। তরুণদের জন্য শিক্ষাকে যুগোপযোগী করেছেন, শিক্ষা কমিশন গঠন করেছেন। কারিগরি শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তরুণদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। যুব একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছেন। নৈতিক চরিত্র গঠনে জোর দিয়েছেন। রাজনীতিতে তাদের প্রাধান্য দিয়েছেন। তরুণ প্রজন্মকে দিয়েই দ্বিতীয় বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত শোষণহীন সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে আজকে এই যে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার গল্প, এই স্বপ্নটিই আজীবন চোখে মুখে বয়ে বেড়াতেন বঙ্গবন্ধু। লিখেছেন আসাদ চৌধুরী, 

‘তুমিই চেয়েছিলে আমাদের ঘাড় থেকে নেমে যাবে  দুঃখ-অপমানের ভারি ভারি বোঝা দু’চোখ থেকে দুঃস্বপ্নে দিনগুলো রাতগুলো চিরকালের জন্য অদৃশ্য হয়ে যাবে; ক্ষুধা আর অভাব  আঁতিপাতি করে খুঁজলেও এদেশে আর পাওয়া যাবে না, আবেগহীন শব্দ হয়ে শুধু অভিধানেই থেকে যাবে।’ (আমাকে দিয়েছিলে তুমি অসীম আকাশ)

লেখক: শিক্ষক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ট্রাস্টি সম্পাদক, গণহত্যা জাদুঘর