ভ্রমণ

দোগারি পর্বতে বাংলাদেশের প্রথম অভিযান

পুতা হিমচুলীর ওপাশেই ‘দোগারি’ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু যাওয়ার পথ নেই। কিলু, নিমা আর তামটিং প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার মিটার পর্যন্ত রাস্তা তৈরি করতে পেরেছে। তারপর বরফের পরিমাণ এতো বেশি যে এই মুহূর্তে সামনে যাওয়া আত্মহত্যার সামিল। অন্য দিকে আবহাওয়াও খারাপ হয়ে আসছে। তাই দ্রুত সবাই ক্যাম্পে ফিরে এলাম। 

সবার শরীরের অবস্থা ভীষণ খারাপ। প্রচণ্ড ঠান্ডা আর প্রায় কোমর পর্যন্ত বরফ ভেঙে রাস্তা করে এগিয়ে যাওয়ায় শরীরে ক্লান্তি চরম পর্যায়ে। কারো মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। কিচেন স্টাফরা আমাদের মগে করে গরম গরম হরলিক্স দিলো। তাবুর ভিতরে বসে খেয়ে স্লিপিং ব্যাগের ভিতরে ঢুকে গেলাম। শরীর গরম হওয়ার আগেই দুপুরের খাবারের জন্য ডাকা হলো। খাবার খেতে চলে এলাম কিচেন তাবুতে। ডাল ভাতের সাথে আজ মুরগির মাংসও রান্না করা হয়েছে। দুপুরের খাবার খেয়ে তাবুতে চলে এলাম। মুহিত ভাই আর বিপ্লব ভাই আমাদের তাবুতে এসেছেন। দুপুরের পর থেকেই তুষারপাত শুরু হয়েছে। পুরো বিকেল তাবুর ভিতরে বসে তাস খেলে, গল্প করে সময় পার করতে হলো। 

সন্ধ্যার আগেই আজ রাতে খাবার দেওয়া হয়েছে। আবহাওয়া ভালো হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। তুষারপাতের পরিমাণ বেড়েই চলছে। রাতের খাবার খেয়ে আবার বসা হলো অভিযানের পরিকল্পনা নিয়ে। মুহিত ভাই আর কিলু শেরপা দফায় দফায় স্যাটালাইট ফোনে কাঠমাণ্ডুতে মিংমার সাথে কথা বললেন। মিংমা কাঠমাণ্ডু থেকে আগামী কয়েক দিনের আবহাওয়ার তথ্য সংগ্রহ করে মুহিত ভাইকে জানালেন। মিংমা, মুহিত ভাই এবং কিলু স্যাটালাইট ফোনে কথা বললেন। আমাদের সবাইকে নিয়ে বসে সিদ্ধান্ত হলো, রাতে আবহাওয়া যদি ভালো হয় এবং আগামীকাল দিনের আবহাওয়া ভালো থাকে তাহলে  আবার চেষ্টা করা হবে। আর যদি আবহাওয়া ঠিক না হয় তাহলে সকালেই নেমে গিয়ে ফেরার পথ ধরতে হবে। অভিযানের সমাপ্তি এখানেই। 

সবার মুখেই বিষাদের ছাপ। কারো মুখে হাসি নেই। কেউ জানে না আমাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে। এক আকাশ দুঃশ্চিন্তা নিয়ে চুপচাপ সবাই তাবুতে চলে এলাম। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। ভয় হচ্ছে, চিন্তা হচ্ছে। কী হবে? কাল কি উপরের দিকে যেতে পারবো? আর যেতে পারলেও ফিরে আসতে পারবো তো? নাকি অভিযান থেকে ফিরে যাব? প্রশ্ন যেন শেষই হচ্ছে না। কিন্তু প্রশ্নের উত্তর নেই। বাইরে প্রচুর তুষারপাত হচ্ছে। তাবুর ভিতরে বসে ডায়েরি লিখছি। আজ লিখতে ইচ্ছে করছে না কিচ্ছু। শুধু কান্না পাচ্ছে। মনে হচ্ছে গলা ছেড়ে চিৎকার করি। সানভি ভাইও কোনো কথা বলছে না। যেভাবে তুষারপাত হচ্ছে তাতে ভয় হচ্ছে পাশের পর্বতের গাঁ থেকে কখন যেন তুষার ধ্বস আমাদের বরফ চাপা দিয়ে দেয়। সারারাত আর ঘুম হলো না। এপাশ-ওপাশ করেই কাটল। মনে হচ্ছে এই রাত হাজার বছরের দীর্ঘ রাত। সময় যেন থমকে আছে কোনো এক অজানা বাধায়।  

ঘড়িতে তখন সময় রাত আড়াইটা। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। দম নিতে পারছি না। তাবুর ভিতরে বাতাস ঢুকতে পারছে না। কিন্তু ভেন্টিলেশন যাতে হতে পারে সেজন্য আমার তাবুর জিপার সবসময় একটু খোলা রাখি। আজকেও খোলা রাখা আছে। তাহলে দম বন্ধ হয়ে আসছে কেনো? মনে হচ্ছে বরফে চাপা পড়ে আছি। বুকের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। ভয়ে সারা শরীর কেঁপে উঠলো। তাহলে কি তুষার ধ্বস হয়েছে? আমরা এখন তুষারের নিয়ে চাপা পড়ে আছি? 

আমি সানভি ভাইকে ধক্কা দিয়ে ডাকলাম, সানভি ভাই, সানভি ভাই। সানভি ভাই বললেন, কী হয়েছে বলেন। আমি বললাম, ভাই মনে হচ্ছে আমার বরফে চাপা পড়েছি। তাবুর ভিতরে নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। আপনার কি শ্বাসকষ্ট হচ্ছে না? সানভি ভাই বললেন, হ্যাঁ তেমনটাই মনে হচ্ছে। তাবুর জিপার খোলেন তো দেখি। আমি স্লিপিং ব্যাগ থেকে বেরিয়ে তাবুর জিপার খুললাম। খোলার সঙ্গে সঙ্গে তাবুর ভিতরে বরফ ভেঙে পড়লো। সামনে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। আমরা আরো বেশি ভয় পেয়ে গেলাম। একি! আমরা তো সত্যি সত্যি তুষারের নিয়ে চাপা পড়ে আছি। 

হাত দিয়ে বরফ সরিয়ে কোনো ক্রমে আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম। তারপর সানভি ভাইও বাইরে এলেন। সবগুলো তাবুর উপরেই বরফের আবরণ পড়ে আছে। প্রত্যেকটা তাবুর তিন ভাগের এক ভাগ বরফে উপরে আছে বাকি দুই ভাগ বরফের নিচে। যে অংশটুকু বরফের উপরে সেটুকুও তুষারের আবরণ পড়ে আছে। আমি আর সানভি ভাই আমাদের চারটি তাবুর ভেন্টিলেশনের অংশ থেকে বরফ সরিয়ে দিয়ে তাবুতে ঢুকে গেলাম। 

সকালে আকাশ পরিষ্কার হয়ে আছে। তুষারপাতও থেমেছে। কিন্তু যে পরিমাণ তুষার পড়েছে তাতে উপরের দিকে যাওয়া মনে হয় না সম্ভব হবে। সবাই তাবুর উপর থেকে বরফ সরালাম। কিচেন স্টাফ আমাদের সবাইকে প্রথমে চা দিলেন। চা খেতে খেতেই পরিকল্পনা হচ্ছে এখন আমাদের করণীয়? গতকাল উপরে কিলুরা যে পরিমাণ বরফ দেখে এসেছে এবং সারারাত যে পরিমাণ তুষারপাত হয়েছে তাতে উপরে যাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব না। এখন উপরে যাওয়ার অর্থ আত্মহত্যা। আবার নিচে নেমে ফিরে যাওয়ার পথটাও এখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। আরো যদি আবহাওয়া খারাপ হয়, আর আমরা যদি এখানে অপেক্ষা করে থেকে যাই তাহলে পরবর্তীতে নেমে যাওয়াটাও অসম্ভব হবে। তাই সবার কথা চিন্তা করে, সবাই যেন সুস্থভাবে ফিরে যেতে পারি তার জন্য অভিযান এখানেই সমাপ্তি ঘোষণা করা হলো। 

মুহিত ভাই আমাদের সবার জীবনের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সবার সাথে আলোচনা করে সবার মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন এবং বললেন, আমরা এখান থেকেই বাড়ি ফিরে যাবো। যদি বেঁচে থাকি আমরা আবার আসতে পারবো। আমরা এমন কোনো ঝুঁকি নেবো না যে, আমাদের এবং আমাদের পরিবারের বড় কোনো ক্ষতি হয়। সবার চোখে তখন ফিরে যাওয়ার কষ্টের অশ্রু ছলছল করছে।

সকালের নাস্তা করে ক্যাম্প গুটিয়ে ফেরার পথ ধরলাম। পর্বত পর্বতের জায়গায় থাকবে। আমরা আবার আসবো। চোখ মুছতে মুছতে বারবার পিছন ফিরে তাকিয়ে বলতে লাগলাম, পর্বত আবার আসবো বলেই ফিরে যাচ্ছি। ফিরে যাওয়া মানেই ব্যর্থতা না, অনেক অভিজ্ঞতা নিয়ে যাচ্ছি। এই অভিজ্ঞতাই আমাদের আরো অধিক যোগ্য করে তুলবে। (শেষ)   

পড়ুন ১৩তম পর্ব : দোগারি পর্বতে বাংলাদেশের প্রথম অভিযান