মতামত

সন্‌জীদা খাতুন: বজ্রচেরা আঁধারের আলো

ধীরে ধীরে প্রণম্য মানুষের সংখ্যা কমে আসছে দেশে। সমাজে সর্বজন স্বীকৃত আদৃত মানুষ নেই বললেই চলে। সে জায়গায় নারীদের অবস্থান আরো করুণ! আজকাল আমরা উন্নত দেশ, স্মার্ট দেশের স্বপ্ন দেখি। এই স্বপ্ন যিনি দেখতে শিখিয়েছেন তিনিও একজন নারী। বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অথচ তাঁর আমলেই মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী। পাকিস্তান আমলকে চ্যালেঞ্জ করার মতো ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে তারা। বিষয়টি এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও পড়েছেন মহা বিপাকে। তাঁকে কেন্দ্র করে যে অপমানের অপকৌশল তার ভেতরে সুপ্ত ঘৃণা আর বিরোধিতার কারণ আমরা বুঝি অথচ মানতে চাই না।

বাম ঘরানার এক বুদ্ধিজীবী উল্টো আমাকে বললেন, আরে এর চাইতে অধিক সমালোচনা তাঁর আমলে হয়েছিল। মানে এই সমালোচনা হোক, হতে থাক সেটা বড় কথা নয়, নিন্দা আর মিথ্যার আর্বজনায় ঢাকা পড়ে যাক রবীন্দ্রনাথ সেটাও বড় বিষয় নয়, বড় কথা আমাদের চুপ থাকা। আমরা বোবা থাকব মাছি ভনভন করবে- এমন এক বাস্তবতায় আজ সন্‌জীদা খাতুনের জন্মদিন। তাঁর এই জন্মদিনটা আমাদের তো রবীন্দ্রনাথকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। তিনি আর রবীন্দ্রনাথ তো এক ও অবিভাজ্য। বাংলাদেশে যাঁরা রবীন্দ্রনাথকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন তিনি তাঁদের পুরোধা একজন।

মান-অপমান রবীন্দ্রনাথের জীবনে নতুন কিছু না। ঘটনা বলছে: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে শান্তিনিকেতন বিপুল বিস্তৃত এবং পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। তো ১৯১৩ সালের নভেম্বর মাসের এক দুপুরবেলা শান্তিনিকেতনের সেই ছাতিমতলায় কলকাতা থেকে আসা শত শত মানুষে ভরে উঠল। তিল ধারণের জায়গা পর্যন্ত নেই! অতি উৎসাহী লোকেরা গাছে উঠে পড়েছে। আর এ দিকে ছাতিম গাছের নিচে বানানো বিশাল মঞ্চে বেশ খানিকটা বিহ্বল এবং বিব্রত হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বসে আছেন। কারণ এক মাস আগেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এই  উপলক্ষে কবিকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। কিন্তু এই আনন্দ উৎসবের দিনে কবি এমন বিচলিত এবং কিঞ্চিৎ বিমর্ষ হয়ে আছেন কেন?

কারণ কবি এত ভিড়ের মধ্যেও খেয়াল করলেন যারা অতিরিক্ত রকমের উৎসাহ এবং উত্তেজনা প্রদর্শন করছেন তারা কবিকে দীর্ঘদিন ধরে অনেক যন্ত্রণা দিয়েছেন, কবির লেখা নিয়ে যাচ্ছেতাই সমালোচনা করেছেন, কবির নামে ভিত্তিহীন, সস্তা, মন্দ কথা রটিয়েছেন। চিরকালের শান্ত সৌম্য স্থিতধী কবি সেদিন খানিকটা অস্থির বিচলিত অধৈর্য হয়ে উঠেছিলেন। সেদিনের সেই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের অম্লমধুর স্মৃতি এবং বহুরূপী মানুষদের কাণ্ডকারখানায় হতবিহ্বল কবি এক সপ্তাহ পরে একটা গান লিখেছিলেন: ‘আমার সকল কাঁটা ধন্য করে ফুটবে ফুল ফুটবে।  আমার সকল ব্যথা রঙিন হয়ে গোলাপ হয়ে উঠবে।’

আজকে বঙ্গদেশে সমালোচনার কালে সন্‌জীদা খাতুনের জন্মদিনে আমার বারবার এসব কথা মনে আসছে। মনে তো আসবেই তাঁর কনিষ্ঠ ভগ্নি ফাহমিদা খাতুন। পাকিস্তান আমল থেকেই রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে চিত্তজয়ী শিল্পী। সুরে তালে গায়কীতে অসাধারণ! তাঁকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করার সৌভাগ্য হয়েছিল। পরে একটি টিভি’র জন্য সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম; আলাপচারিতারও সুযোগ হয়েছিল আমার। তিনি বলেছিলেন, একাত্তরে পাক বাহিনী ও তাদের দালালেরা ফাহমিদা খাতুন ও তাঁর বড় এই আপাকে খুঁজছিল। তাদের ভাষায় মা কালীর গান গায় এরা। 

‘তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে’ গাওয়া গাদ্দার টিপ পরা নারীদের খুঁজে পায়নি বলে সম্ভ্রমসহ জানে বেঁচে গেছিলেন তাঁরা। কী আশ্চর্য! সেই ‘সোনার মন্দির’ শব্দের জন্য ‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি’ কবিতাটি এখন পাঠ্য বই থেকে নাকি উধাও, তাও এই ‘সোনার বাংলা’র আমলে। যাঁর কথা লিখছি, তাঁকে সবাই চেনেন। বাংলা ও বাঙালির বাতিঘর তিনি। পতি ওয়াহিদুল হক ও অন্যান্যদের নিয়ে যে মহীরুহ গড়ে তুলেছেন সেই ছায়ানট এখনো শিল্প সংস্কৃতির ছায়াবৃক্ষ। সমালোচনার অভাব নাই বঙ্গদেশে। বাঙালি এই কাজে নম্বর ওয়ান। তাদের অনেকে তাঁর ব্যক্তিত্ব ও রুচির জন্য তাঁকে অনুদার মনে করেন। অথচ এই তথাকথিত উদার আর সুবিধাবাদের কারণেই এখন অপসংস্কৃতিও টাউট বাটপারদের রমরমা।

‘রবীন্দ্র সঙ্গীতের ভাব সম্পদ’ নামে তাঁর যে গ্রন্থটি তা শান্তি নিকেতন বিশ্বভারতীও পাঠ্য করে নিয়েছে। এমন করে রবীন্দ্রনাথকে কেউ চিনেছেন বলে মনে হয় না। যাঁরা রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে সেলিব্রিটি বা শীর্ষে তাঁদের অনেকের  কাছে রবীন্দ্র সঙ্গীত পণ্য। এঁর কাছে জীবন সুধা। টিপ পরে অপমান মেনে নেয়া এই সমাজ ও বদলে যাওয়া বাঙালির জননী স্বরূপা নারী তিনি। এখনো আছেন, এখনো নিঃশ্বাস ও কথায় সমৃদ্ধ করেন। গেল পহেলা বৈশাখে তাঁর সকাল বেলার ভাষণ শুনে মনে হয়েছিল, আকাশ পাড়ের ডাক শুনেছি...

সন্‌জীদা খাতুনের ছায়ানট আমাদের পথ দেখায়। আমরা এই জন্মদিনে আশা করি মুক্তিযুদ্ধের সেই রবীন্দ্রনাথকে আবারো ফিরিয়ে আনবেন তিনি। যেমনটি বলেছিলেন: মুক্তিযুদ্ধেও রবীন্দ্রনাথের গান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নানা উদ্দীপক গানের সঙ্গে প্রচারিত হয় রবীন্দ্রনাথের গান। সন্‌জীদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক এঁদের সক্রিয় উদ্যোগে গড়ে ওঠে গানের দল। তাঁরা ঘুরে বেড়ান মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে। সন্‌জীদা খাতুন জানালেন:

‘‘আমাদের পালিয়ে যেতে হয়েছিল কলকাতায়। সেখানে গিয়ে আমরা ‘রূপান্তরের গান’ নামে একটি গীতি আলেখ্য তৈরি করেছিলাম। তাতে ‘সার্থক জনম আমার’ ছিল। ‘সোনার বাংলা’ তো ছিলই, আরো গান ছিল। ‘দেশে দেশে ভ্রমি তব দুখ গান গাহিয়ে, নগরে প্রান্তরে বনে বনে। অশ্রু ঝরে দু নয়নে, পাষাণ হৃদয় কাঁদে সে কাহিনী শুনিয়ে।’ কিংবা আরেকটা গান ছিল ‘ঢাকোরে মুখ চন্দ্রমা’। মানে চাঁদকে বলা হচ্ছে মুখ ঢেকে ফেলো, বড় লজ্জার দিন, বড় কষ্টের দিন, দুঃখের দিন। এই গানগুলো আমরা নতুন করে আবিষ্কার করে তখন গাইতাম। এবং এই গান হতো মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে, শরণার্থীদের শিবিরে এবং ভারতের বিভিন্ন জায়গাতে সাধারণ মানুষকে আমাদের বেদনার সাথে যুক্ত করবার জন্য আমরা এই গানগুলো গাইতাম। কাজেই রবীন্দ্র সংগীত আমাদের আন্দোলনের মস্তবড় একটা হাতিয়ার ছিল এবং এখনও আছে। এখনও আমরা বলি, রবীন্দ্রনাথের হাতে হাত রেখে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।’’

গানের ব্যাপারেও তিনি বরাবর আপোসহীন। বিনয়ের সাথে বলেছেন আজকে যারা ফিউশনের নামে রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিকৃতি ঘটায় তিনি তাদের বিরুদ্ধে। এই শুদ্ধাচার আজ গান কবিতা এবং সমাজের জন্য জরুরি। মনে আছে কবি শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন, ধর্মতলা স্ট্রিটের প্রথম দেখায় তিনি সন্‌জীদা খাতুনকে দেখেছিলেন রবীন্দ্র সঙ্গীতের ভেতর নিজ দেশের পরিচয় খুঁজছেন। বহু কাল পর শঙ্খ ঘোষের মনে হয়েছিল রবীন্দ্র সঙ্গীতে নিজেকে খুঁজে ফিরছেন সন্‌জীদা খাতুন। নব্বই পেরিয়ে যাওয়া আমাদের এই সাহসী মিতবাক রুচিময়ী লেখক ও গায়িকার জন্মদিনে একটাই প্রার্থনা: শতায়ু হন আপা। সাথে এটাও বলি, দুর্বলেরে রক্ষা করো দুর্জনেরে হানো... এই বাণীর শেষ প্রতিভু হিসেবে আমাদের সংস্কৃতিকে পথ দেখিয়ে দিন উত্তরণের। যা আজ বড় জরুরি। 

সিডনি থেকে