মতামত

নববর্ষ: বিবিধ ভাবনা

বারো মাসে তেরো পার্বনের দেশ আমাদের এই জন্মভূমি। কথায় বলে, বাঙালি আমুদে জাতি, উৎসবপ্রিয় জাতি; উৎসব পেলে অন্য সব কিছু ভুলে থাকতে পারে বাঙালি। তবে লক্ষ করলেই দেখা যাবে, এত উৎসবের ভিড়েও ধর্মনিরপেক্ষ মিলিত বাঙালির উৎসবের সংখ্যা খুব বেশি নয়। কয়টা উৎসব আছে আমাদের, যেখানে সবাই একনিষ্ঠভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে, ধর্মীয় ও সামাজিক দেয়ালের ঊর্ধ্বে উঠে একাত্ম হয়ে পালন করতে পারে প্রকৃত অংশগ্রহণকারীর ভূমিকা? 

সবার অংশগ্রহণে মিলিত বাঙালি যে কয়টা অনুষ্ঠানে মুখর হয়ে ওঠে বাংলা নববর্ষ তার অন্যতম। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাঙালি জনগোষ্ঠী ধর্মীয়-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে মিলিতভাবে পালন করে আসছে বাংলা নববর্ষ উৎসব। উত্তরালে একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, বসন্ত উৎসবের মতো অনুষ্ঠান বা উৎসব পালনের দিন আমরা পেয়েছি বটে, তবে এ ক্ষেত্রে নববর্ষ উৎসব যে ভিন্ন মাত্রাসঞ্চারী, তা লেখাই বাহুল্য।

২ বাংলা নববর্ষের উদ্ভব ও প্রবর্তন সম্পর্কে দীর্ঘদিন ধরে একটা বিতর্ক চলে আসছে। বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ কখন কীভাবে চালু হয়েছে, ইতিহাসে তার কোনো সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। বাংলা সনের প্রবর্তক কে- এ সম্পর্কে পন্ডিত-গবেষক সর্বসম্মত কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেননি। যথাযথ তথ্য-প্রমাণ ও উপাত্ত ব্যবহার করে এ বিষয়ে প্রকৃত সত্য বা সর্বসম্মত কোনো মিমাংসায় পৌঁছা যাবে বলেও মনে করার কোনো কারণ নেই। বিভিন্ন পন্ডিত-ইতিহাসবিদ-গবেষক নানাভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ উপস্থাপন করে ভিন্ন ভিন্ন মত প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন। এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে মিমাংসার অযোগ্য নানা মত। 

ইতিহাসবিদ-গবেষকদের মত অনুসারে বাংলা সনের প্রবর্তক হিসেবে যাদের নাম পাওয়া যায়, তারা হচ্ছেন- ষষ্ঠ শতকের প্রারম্ভে উত্তরবঙ্গের বিশাল এলাকা দখলকারী তিব্বতি রাজা সংসন, সপ্তম শতাব্দীর গৌরাধিপতি শশাঙ্ক, সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ (রাজত্বকাল: ১৪৯৩-১৫১৯) এবং মোঘল সম্রাট আবু আল-ফাতাহ্ জালাল আল-দীন মুহম্মদ আকবর (রাজত্বকাল: ১৫৫৬-১৬০৬)। এ প্রসঙ্গে গবেষক জয়নাল আবেদীন খান ভিন্ন এক মত উপস্থাপন করেছেন। তার মতে, মহারাজা বল্লাল ওরফে নবাব আবুল ওরফে বাদশাহ মঙ্গল রায় এবং মুর্শিদকুলি খান (রাজত্বকাল: ১৭০৭-১৭২৬), বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তবে উপরের কোনো মতই সর্বজনস্বীকৃত নয়। তাই এ বিষয়ে বিতর্কেরও কোনো মিমাংসা পাওয়া যায় না।

অতীতে অগ্রহায়ণ ছিল বছরের প্রথম মাস। সংস্কৃত ‘হায়ন’ শব্দের অর্থ বছর বা বর্ষ, আর অগ্র অর্থ প্রারম্ভ বা শুরু। বছরের শুরুর মাস বলে এর নাম হয়েছে অগ্রহায়ণ। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীর বাংলার ইতিহাস ও সাহিত্য থেকে জানা যায়, এক সময়ে এ দেশে অগ্রহায়ণ মাসে নববর্ষ উৎসব উদযাপিত হতো। মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর (আনুমানিক ১৫৪০-১৬০০) কবিতায় নববর্ষ হিসেবে অগ্রহায়ণ-বন্দনা পাওয়া যায়। বছরের শুরুর মাস হিসেবে অগ্রহায়ণের এই বিশিষ্ট অবস্থানের অন্য একটা ব্যাখ্যাও এখানে দেওয়া যেতে পারে। বাংলা বারো মাসের এগারোটিরই নাম এসেছে নক্ষত্রের নাম থেকে। বিশাখা থেকে বৈশাখ, জ্যাষ্ঠা থেকে জ্যৈষ্ঠ- এভাবে আষাঢ়া, শ্রাবণা, পূর্বভাদ্রপণা, অশ্বিনী, কৃত্তিকা, পৌষী, মঘা, ফাল্গুনী ও চিত্রা নক্ষত্র থেকে যথাক্রমে আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিনী, কার্তিক, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন এবং চৈত্র মাস। একমাত্র ব্যতিক্রম অগ্রহায়ণ। কারণ হিসেবে এটা কি ধরে নেওয়া যায়, বছরের শুরু বলে নামটা হায়নের অগ্রে বলে অগ্রহায়ণ রাখা হয়েছে? 

বস্তুত, বছরের শুরুতে বা অগ্রে অবস্থানের কারণে নক্ষত্রের নামের সঙ্গে সম্পর্কহীন একমাত্র মাস হচ্ছে অগ্রহায়ণ। আনুমানিক ৫ হাজার বছর পূর্বে প্রণীত গীতায় শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় মাস হিসেবে অগ্রহায়ণের কথা বলা হয়েছে। অগ্রহায়ণ মাসসহ বাংলা অব্দের মাসগুলো, বহু পূর্ব থেকেই ভারতবর্ষে প্রচলিত আছে। এখানে অবশ্য উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, কোনো কোনো গবেষক মনে করেন, অগ্রহায়ণ যে বছরের প্রথম মাস তা মূলত ফসলি সনের বেলায় প্রযোজ্য, অন্য কোনো ক্ষেত্রে নয়। বাংলা সনের প্রবর্তক হিসেবে সম্রাট আকবরের নামই বেশিরভাগ গবেষক উল্লেখ করেছেন। তবে বাংলা সনের প্রবর্তক হিসেবে কেউ কেউ রাজা শশাঙ্ক কিংবা সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহের কথাও বলেছেন। অধিকাংশ গবেষক বাংলা সনের প্রবর্তক হিসেবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আকবরের সংশ্লিষ্টতার কথা বললেও, ইতিহাসবিদ মুখময় মুখোপাধ্যায় ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। তিনি লিখেছেন:

১. আকবরের সময়কার প্রমাণিত ইতিহাস গ্রন্থ ‘আইন-ই-আকবরী’ বা ‘আকবরনামা’তে অথবা অনান্য সমসাময়িক ঐতিহাসিকদের লেখা বইগুলোতে কোথাও আকবর কর্তৃক হিজরীকে সৌরবৎসরে পরিবর্তিত করার উল্লেখ পাওয়া যায় না। 

২. আকবরের আমলে শুধু হিজরীই ব্যবহৃত হতো তাই নয়, হিন্দুরা শকাব্দ, বিক্রম সংবৎ প্রভৃতি ব্যবহার করতেন, মুসলমানদের অনেকেই ফার্সী পঞ্জিকা ব্যবহার করতেন। এ সমস্তরই বছর ৩৬৫ দিনের সৌর বছর।

৩. চাষীরা তারিখ অনুসারে ফসল কাটে না, তারা নির্দিষ্ট ঋতুতে ফসল কাটে। সুতরাং তাদের জন্য হিজরিকে সৌর সংবতে পরিবর্তিত করার কোনা কারণ নেই।

হিজরি থেকে বঙ্গাব্দ হয়েছে- এই মত এসেছিল কয়েকজন আধুনিক ঐতিহাসিকের মাথা থেকে, এঁদের মধ্যে যার কণ্ঠস্বর সবচেয়ে জোরালো ছিল, তাঁর নাম কে.পি. জয়সোয়াল। প্রধানত তাঁরই প্রচারের ফলে একটি কাল্পনিক মত আজ ঐতিহাসিক সত্যের স্থলাভিষিক হয়েছে। কিন্তু এই কাল্পনিক মতের ভিত্তি কী? ভিত্তি একটা তুচ্ছ বিষয়। সেটি হলো এই আকবরের সিংহাসন আরোহণের বছর ছিল ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ বা ৯৬৩ বঙ্গাব্দের সমান। এর থেকেই এঁরা স্থির করলেন যে, হিজরি থেকেই বঙ্গাব্দ চালু হয়েছে এবং তা চালু করেছিলেন আকবর।

... বঙ্গাব্দের প্রবর্তক যে কে তা যখন জানা যাচ্ছে না, তখন তাকে বাংলার প্রবল প্রতাপশালী রাজা শশাঙ্কের নামে চিহ্নিত করলে ক্ষতি কি!

সুখময় মুখোপাধ্যায়ের শেষ বাক্যটি খুবই আকর্ষিক এবং কাল্পনিক। কোনো ইতিহাসবেত্তার এমন বক্তব্য মান্য হতে পারে না। অন্যদিকে বাংলা সন-তারিখ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পুঁথি-সংগ্রাহক যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্যের মতে- সুলতান হোসেন শাহের সময় এই সন (বঙ্গাব্দ) প্রচলিত হয়। কিন্তু কোন সূত্রে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, তার কোনো উল্লেখ নেই। এ কারণেই এই সিদ্ধান্ত মান্যতা পায়নি। গবেষক সুনীলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বঙ্গাব্দের উৎসকথা’ গ্রন্থে রাজা শশাঙ্ককে বাংলা সনের প্রবর্তক হিসেবে উল্লেখ করে লিখেছেন: ‘শশাঙ্কের রাজত্বকালে ৫৯৪ খৃষ্টাব্দের ১২ই এপ্রিল সোমবার ১লা বৈশাখে বঙ্গাব্দের শুরু।’ তবে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ব্রতীন্দনাথ মুখোপাধ্যায়সহ অনেকেই মত প্রকাশ করেছেন যে, শশাঙ্ক যে ৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনভাবে বাংলা অঞ্চল শাসন করেছেন তার কোনো নিশ্চিত প্রমাণ নেই, বরং ৭ম শতকের প্রারম্ভে তার রাজত্বকালের পক্ষে নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায়। কাজেই ৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দে শশাঙ্ক-কর্তৃক বঙ্গাদের সূত্রপাত একান্তই কাল্পনিক।

এবার আসা যাক আকবর প্রসঙ্গে। সম্রাট আকবরই যে বাংলা সনের প্রবর্তক, সে-সম্পর্কে জোরালো কী যুক্তি গবেষকরা উপস্থাপন করেছেন? আকবরের শাসনামলে মোঘল সাম্রাজ্যে বেশ কয়েকটি সন বা অব্দ প্রচলিত ছিল। এগুলোর মধ্যে উত্তর-পশ্চিমের ফসলি সন, উড়িষ্যায় আমনি মন, বাংলায় বিলায়িতি অব্দ, মল্লাব্দ ইত্যাদির কথা জানা যায়। বঙ্গাব্দ শব্দটার আগে ব্যবহার ছিল না, এটা একান্ত আধুনিককালের ব্যবহার। পূর্বে ব্যবহৃত হতো সন বা সাল। সন আরবি শব্দ, সাল হলো ফারসি। শব্দের এই সূত্র ধরে গবেষক পলাশবরণ পাল, তার ‘সাল-তারিখের ইতিহাস’ গ্রন্থে বলেছেন এই কথা: ‘হিজরি ক্যালেন্ডার থেকেই কোনভাবে উদ্ভূত আমাদের বাংলা অব্দ বা বাংলা সাল। তা যদি হয় তাহলে আকবর থিয়োরির চেয়ে বিশ্বাস্য অন্য কোনো থিয়োরির সন্ধান পাওয়া মুশফিল।’ 

শামসুজ্জামান খান প্রসঙ্গত মন্তব্য করেছেন ‘মনে রাখতে হবে ‘সন’ শব্দটি আরবি আর ‘সাল’ শব্দটি ফার্সি। অতএব, বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ প্রবর্তনের সঙ্গে যে মুসলমান সুলতান বা সম্রাটদের সম্পর্ক আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’

উড়িষ্যার বিশ্বখ্যাত ইতিহাসবিদ কাশীপ্রসাদ জয়সোয়াল, বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা, নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ-সমাজচিন্তক অমর্ত্য সেন প্রমুখ সম্রাট আকবরকেই বাংলা সনের প্রবর্তক হিসেবে মত প্রকাশ করেছেন। ভারতীয় সন শকাব্দের অন্যতম সংস্কারক মেঘনাদ সাহা সম্রাট আকবরের ইলাহি সন এবং তা  থেকে উদ্ভূত বাংলা সন সম্পর্কে উল্লেখ করেন: "In 1079AP Sultan Jelaluddin Matik shah of Iran introduced a solar calendar for Iran, and this was introduced by emperor Akbar in India in 1584 AD under the name Tarikh-i- Ilahi. Akbar's Calendar as used to date all events from his accession (1556 AD) and was official calendar during the reign of Jahangin and early part of Sahjahan's reign when it fall into disuse. But it gave rise to a number of hybrideras like the Bengali san and the Fasti Fra which are still in use, ... In the Hijri year 992, the Emperor Akbar declared that thence forth all calculations regarding year would be made according to solar years. Bangabda can be derived from the Hijra Era 992 by sotor method of calcutation'

ড. মেঘনাদ সাহার উপর্যুক্ত ব্যাখ্যা থেকে যে সত্য প্রকাশিত হয় তা হলো সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে (৯৯২ হিজরি) সৌরসন হিসেবে তারিখ-ই-ইলাহি বা ইলাহি সন প্রবর্তন করেন এবং তার সিংহাসনে আরহণের দিন থেকে (১৪ই ফেব্রুয়ারি ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে) তা কার্যকর হয়েছে বলে ধরা হয়। বাংলা সনের উৎস এখান থেকেই বলে তিনি মত প্রকাশ করেছেন। 

আকবর কর্তৃক সৌরসন প্রবর্তনের পেছনে ইরানি সৌরসন, বিশেষ করে নওরোজের প্রভাব কার্যকর ছিল বলে ধারণা করা হয়। প্রথমত উদ্ধৃত করা যায় প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ স্যার যদুনাথ সরকারের মন্তব্য: "The  encient Kings of Persia, and following them the Muslim rusers of that country as well as the Mughat Sovereigns of India, used to observe the day when the sun enters the Aries as a time of reforing, because was the Nwe years day of the Zoroastrian caterdar."

স্মর্তব্য, আবুল ফজলের ‘আকবরনামা’তেও উল্লেখ আছে: সিংহাসনে আরোহণের ২৫দিন পড় ২৮শে রবিউসসানী (১১ই মার্চ) তারিখে অর্থাৎ ইরানী নববর্ষের (নওরোজ) প্রথম দিনে ভুবন আলোককারী নতুনবর্ষের (তারিখ-ই- ইলাহি) শুরু হয়।

সুশাসন, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও বহুমাসিক অগ্রগামী ভাবনার ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসে সম্রাট আকবর স্মরণীয় হয়ে আছেন। একটি নতুন সহস্রাব্দকে (millennium) সামনে রেখে তিনি ভারতীয় সন সংস্কারের পরিকল্পনা করেছিলেন বলে আবুল ফজল ‘আইন-ই-আকবরি’তে উল্লেখ করেছেন। তিনি হিজরি চান্দ্র সনের পরিবর্তে ভারতবর্ষের বছর-মাস গণনাকে সহজ করার মানসে নতুন সন প্রবর্তনের কথা ভেবেছেন। আকবরের নির্দেশে তার জ্যোতির্বিজ্ঞানী পন্ডিত ফতেউল্লাহ সিরাজী বিজ্ঞানভিত্তিক ইলাহি সন উদ্ভাবন করেন। রাজ্যের সুশাসন প্রাতিষ্ঠা এবং বছর মাস গণণার অভিন্ন রীতি প্রবর্তনের জন্য আকবর পঞ্জিকা সংস্কার ও নতুন সন প্রবর্তন করেন।

বিশ্বখ্যাত চিন্তাবিদ অমর্ত্য সেনও প্রকাশ করেছেন অভিন্ন মত। ‘The Idea of Justice’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন: ‘‘As the first millennium of The Muslim Hijri calendar came to an end in 1591-2 (it was a thousand lunar years after Muhammad's epic journey from Mecca to Medina in AD 622), Akbar reaching serutiû social engaged in a far- and political values regal culto Cultural practice. He paid parti- cular attention to the challenges of inter- community relations and the abiding need for communal peace and fruitful collaboration in The already multicultural India of the sixteenth century."

আকবর যে বাংলা সন প্রবর্তন করেন এবং তার আদেশেই যে ওই সন ভারতবর্ষের সর্বত্র চালু হয়েছিল, তার প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণও কোনো কোনো গবেষক উপস্থাপন করেছেন। এ প্রসঙ্গে প্রত্নতত্ত্ববিদ অমিতাভ ভট্টাচার্যের The Bengal Era প্রবন্ধের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। ওই প্রবন্ধে গবেষক নানা প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ উপস্থাপন করে আকবরই যে বাংলা সনের প্রবর্তক তা প্রমাণ করার প্রয়াস পেয়েছেন। জয়নাল আবেদীন খান মগরাজা বল্লাল ওরফে নবাব আবুল ওরফে বাদশাহ মঙ্গল রায় যে বাংলা সনের প্রবর্তক তার পক্ষে বিশ্বাসযোগ্য অকাট্য কোনো তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করতে সমর্থ হননি।

আকবর-পরিকল্পিত নতুন সন (ইলাহি সন) হিজরির ৩৫৪ দিনের চান্দ্র বছরের পরিবর্তে ৩৬৫ দিনের সৌর বছর হিসেবে চালু হয়। বাংলায় এই প্রথম সৌরমতে বছর গণনা শুরু হয়। অভিন্ন সময়ে হিজরি ও বাংলা সন চালু হলেও দিনের হিসেবে হিজরি চান্দ্র বছর ১০.৮৭ দিন কম হওয়ার কারণে বাংলা সন অপেক্ষা হিজরি সনের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আপাত কঠিন বঙ্গাব্দের হিসাব বেশ সহজে করা যায়। যে-কোনো খ্রিষ্টাব্দ বছর এপ্রিলের শেষার্ধ থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সময় থেকে ৫৯৩ এবং জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধ পর্যন্ত সময় থেকে ৫৯৪ বাদ দিলে বঙ্গাব্দ পাওয়া যায়। যেমন ২০২৪ থেকে ৫৯৩ বাদ দিলে পাওয়া যায় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ।

ভারতবর্ষে মোঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পরেও বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন বর্ষপঞ্জি (যেমন: বিক্রমাব্দ, শকাব্দ ইত্যাদি প্রচলিত ছিল। আকবর লক্ষ করেন যে, তার সাম্রাজ্যে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন বর্ষপঞ্জি প্রচলিত, ফলে খাজনা আদায়ে সৃষ্টি হচ্ছে নানা ধরনের জটিলতা। এই সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি প্রথম বিশাল মোঘল সাম্রাজ্যের জমিজরিপ কাজ সমাপ্ত করেন। তারপর রাজস্ব আদায়ের শৃঙ্খলার জন্য একটি অভিন্ন বর্ষপঞ্জি প্রচলন করেন, যা ফসলি সন নামে পরিচিত। সম্রাট আকবর হিজরি চান্দ্র সনকে ফসলি সৌর সনে রূপান্তরিত করেন। কিন্তু ভারতবর্ষে দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত বিভিন্ন মাস ও দিনের নাম অপরিবর্তিত রাখেন। বর্তমানে হিজরি ও বাংলা সন যথাক্রমে ১৪৪৫ ও ১৪৩১। এই দুই সনের মধ্যে যে ১৪ বছরের ব্যবধান, তা ঘটেছে হিজরি সন চান্দ্র এবং বাংলা সন সৌর বছর বিধায়। লেখাই বাহুল্য যে, দুই সনের মধ্যে এই ব্যবধান দুই বছরে বছরে বৃদ্ধি পেতেই থাকবে। 

আকবরের প্রধান আমর্ত্য আবুল ফজলই প্রথম লিখিতভাবে সম্রাটকে জানান যে, সৌরবর্ষের ৩০ বছর পেরোনোর সময় চান্দ্রবর্ষের পেরিয়ে যাবে ৩১ বছর। তাই স্থানীয় সময় হিজরি প্রচলিত পঞ্জিকা কিংবা প্রশাসনিক কাজে প্রচলিত বছর অনুযায়ী খাজনা নিলে কেবল যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায়ই গোলযোগ ঘটে তা নয়, চাষীদের উপরেও অত্যাচার করা হয়ে যায়। 

৯৯২ হিজরি বা ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে রাজগণিতজ্ঞ ফতেহউল্লাহ সিরাজীর নেতৃত্বে প্রণীত হয় আকবরি সাল বা ফসলি সাল- যার পোশাকি নাম তারিখ-ই-ইলাহি। অবশ্য প্রচলনের বছরটাই ছিল আকবরি সালের ২৮ তম বছর, কেননা সম্রাটের নির্দেশে নতুন বছরের প্রথম দিন নির্ধারিত হয়েছিল পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে তার বিজয়ের দিনটি (৫ই নভেম্বর ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ)।

আকবরের তারিখ-ই-ইলাহির মাসগুলোর আদি নাম ছিল কারওয়াদিন, আর্দি, বিহিসু, খোরদাদ, তীর, অমরদাদ, শাহরিয়ার, আমান, আজুর, দাই, বাহাম এবং ইস্কান্দার মিজ। বঙ্গাব্দে এসে মাসগুলোর নাম ফের হয়ে যায় বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র। আকবর তারিখ-ই- ইলাহির প্রথম মাসের সঙ্গে হিজরি ৯৬৩ সালের প্রথম মাস মহররমের মিল রেখে সে-বছরে মহররমের সবচেয়ে কাছাকাছি মাস বৈশাখের পহেলা তারিখকে বংলা নববর্ষের প্রথম দিন হিসেবে নির্ধারণ করেন অর্থাৎ হিজরি ৯৬৬ সালকেই বঙ্গাব্দের ৯৬৩ সাল হিসেবে ধরা হয়। এখন যে হিজরি অব্দ ১৪৪৫ আর বঙ্গাব্দ ১৪৩১ তার কারণ হিজরি সন বাংলা সনের চেয়ে বছরে ১০.৮৭ দিন কম- যা পূর্বেই ব্যক্ত হয়েছে। এর ফলে ইতোমধ্যে বাংলা সনের চেয়ে হিজরি সন ১৪ বছর বেশি হয়ে গেছে এবং ক্রমশই এ ব্যবধান বৃদ্ধি পেতে থাকবে। এই সহজ গাণিতিক হিসাবটা বুঝতে পারলে হিজরি সনের সঙ্গে বাংলা সনের সম্পর্কটা অনুধাবন করতে পারাটা সহজতর হবার কথা।

৩ নববর্ষ বাঙালির দ্রোহচেতনা ও সংঘশক্তির অবারিত উৎস। তার অন্তরে আছে সম্প্রীতির মেলবন্ধনের অনেকান্ত আহ্বান। শতাব্দী পরম্পরায় চলে আসা নববর্ষ উৎসব বাঙালির কাছে কেবল উৎসব নয়, এ তার আপন উৎসে সংলগ্ন হবার দিন। নিজের ঠিকানায় আশ্রয় নেয়ার দিন। মিলিত বাঙালিকে তার চেতনার মূলস্রোতে সংহতি দিতে নববর্ষের দিনটি পালন করে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা। বছরের একটি দিনে ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সব বাঙালি নিজ সংস্কৃতির ধারায় স্নাত হয়ে শুদ্ধ হওয়ার সাধনা করে। 

ব্যক্ত হয়ে হয়েছে যে, নববর্ষ আমাদের কাছে এখন সংঘচেতনার উজ্জ্বল স্মারক। নববর্ষের প্রভাতে মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন চারুকলার সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে গোটা দেশে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক মাত্রাকে ছাপিয়ে নববর্ষের শরীরে ও সত্তায় এখন প্রবলভাবে ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক চারিত্র্য। সম্রাট আকবর-প্রবর্তিত নববর্ষ উৎসব ছিল প্রধানত অর্থনৈতিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। উনিশ শতকের শেষ দশকে রাজনারায়ণ বসু ইংরেজদের অনুসরণে নববর্ষ পালনের যে আয়োজন শুরু করেন, তাতে ক্রমে উৎসবটি অর্জন করে সামাজিক মাত্রা। এখন আমাদের নববর্ষ উৎসবের সঙ্গে আাছে বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রেরণা, সকল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উন্মাদনা, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী প্রেরণা। এভাবে নববর্ষ উৎসব অর্জন করে প্রতিবাদী রাজনৈতিক চারিত্র্য। তাই এখন সমবেত বাঙালি যখন পয়লা বৈশাখকে বরণ করে তখন কেবল একটি দিন বা একটি বছরকেই আবাহন করে না; বরং আবাহন করে আমাদের সংঘবদ্ধ চেতনাকে, আবাহন করে বাঙালির সংগ্রামী ভূমিকাকে, স্মরণ করে তার উজ্জ্বল ঐতিহ্যকে।

বিভাগোত্তর কালে, পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক আমলে বিশেষ করে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে এসে নববর্ষ উৎসবের আর্থিক-সামাজিক চারিত্র্যের পরিবর্তন ঘটে। নববর্ষ উৎসব হয়ে ওঠে উপনিবেশবাদবিরোধী সংগ্রামের রাজনৈতিক এক হাতিয়ার। এ ক্ষেত্রে ছায়ানট পালন করে ঐতিহাসিক এক ভূমিকা। নববর্ষ উপলক্ষ্যে রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আমাদের নববর্ষ উৎসবকে নতুন মাত্রায় অভিষিক্ত করে। ক্রমে এই আয়োজনের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলাদেশে- গ্রামে-গঞ্জে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার মঙ্গল-শোভাযাত্রা নববর্ষ উৎসবকে আনে সমষ্টিচেতনার মাত্রা। পয়লা বৈশাখে এখন দেখা দেয় মিলিত বাঙালির সংঘচেতনার শক্তি। ঔপনিবেশিক আমলে যেমন, তেমনি স্বাধীনতা-পরবর্তী কালেও নববর্ষের আয়োজনসমূহ আমাদের জাতিগত ঐক্যের প্রতীকে পরিণত হয়। ঔপনিবেশিক শক্তি ভয় পেয়েছে নববর্ষের এই চারিত্র্য বদলে- স্বাধীন দেশেও তাদের প্রেতাত্মারা পরাজিত দানবেরা ভয় পায় নববর্ষের এই নতুন শক্তিকে। তাই রমনার বটমূলে তাদের বোমা ফাটাতে হয়, মারতে হয় নিরীহ মানুষকে। নববর্ষ উৎসব এখন বাঙালির কাছে সংঘচেতনার উদ্দীপ্ত হওয়ার উৎসব, আপন সত্যানুসন্ধানের উৎসব, জাতির ঠিকানা খোঁজার উৎসব। বৈশাখে এসে পুরনোকে সরিয়ে নতুনকে আবাহন করি- এই ভাবনার  চেয়ে উৎসবের রাজনৈতিক চারিত্র্যই এখন নতুন তাৎপর্য বলে মনে হয়।

ধর্মনিরপেক্ষ চারিত্র্যই নববর্ষের শ্রেষ্ঠ লক্ষণ। এ কারণেই নববর্ষ হয়ে ওঠে সম্প্রীতির মেলবন্ধনের অবিনাশী উৎস। ধর্মের ভেদ, সামাজিক স্তরবিন্যাসগত পার্থক্য, হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান কিংবা ধনী-দরিদ্র নারী-পুরুষের বিষমতা এ দিনে অনেকটাই দূর হয়ে যায়। নববর্ষ কেবল মধ্যস্তরের মানুষের নয়, বরং তা দূর কৃষক-শ্রমিক-দিনমজুর-সাধারণ মানুষ সকলের। একদিনের জন্য হলেও বাঙালি এই দিনে ধর্মবিভেদকে দূর করে একাত্ম হয়ে যায়। নববর্ষের ভোরে খোলা আকাশের নিচে সমবেত হয়ে বাঙালি বুক ভরে বাতাস নিয়ে মনে করে আমি বাঙালি, বাংলা আমার মাতৃভাষা, বাংলাদেশ আমার জন্মভূমি। এই চেতনার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীও। তারাও নিজ নিজ ঐতিহ্য অনুসারে নববর্ষকে আহ্বান করে- সে আহ্বানে গোষ্ঠীচেতনার পাশাপাশি জাতীয় চেতনার উত্তাপও অনুভূত হয়। সন্দেহ নেই, বাঙালি হয়ে ওঠার এই আয়োজনে কখনও কখনও দেখা দেয় অসঙ্গতি কিংবা হাস্যকর কোনো অনুষঙ্গ। কিন্তু তা কোনোভাবেই মূলচেতনাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে না।

বাঙালির আছে দুটো প্রত্নবিভাজন রেখা- একটি সম্প্রদায়গত, অপরটি আর্থনীতিক। প্রথমটি আলম্ব, সে-বিভাজনে বাঙালি বিভক্ত হয়ে পড়ে হিন্দু কিংবা মুসলমানে; দ্বিতীয় বিভাজনটি আনুভূমিক। সেক্ষেত্রে বাঙালি হয়ে পড়ে ধনী কিংবা গরিব। পয়লা বৈশাখ বা নববর্ষ বাঙালির এই দুই প্রাচীন বিভাজন রীতির বিপ্রতীপ চেতনা। কেবল বিপ্রতীপ নয়, বিপাক্ষিকও বটে। পয়লা বৈশাখ অসাম্প্রদায়িক- তার মেলা হিন্দুমেলা নয়, তার মেলা মোহররমের মেলাও নয়। তার মেলা সম্প্রীতির মেলা, তার মেলা বাঙালির মেলা, তার মেলা মিলিত বাঙালির মেলা। বৈশাখি মেলায় হিন্দু কিংবা মুসলমান আসে না, আসে বাঙালি নর-নারী আর সে-মেলায় যে পণ্য ওঠে তাও বিশ্বায়নের পণ্য নয়, পুঁজিবাদের পণ্য নয়, সে-পণ্য একান্তই বাঙালির ঘরের পণ্য, আমাদের জাতীয় চেতনার পণ্য। এভাবে বিশ্ব-পন্যায়নের বিপক্ষে অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে যায় পহেলা বৈশাখ। নববর্ষ ধনী ও গরিবকে এক কাতারে নিয়ে আসে, সবাইকে সে এক করতে চায়। পারে কিনা সে-প্রশ্ন বড় নয়, তার চাওয়াটাই বড় কথা। এই চাওয়াটা আছে বলেই পহেলা বৈশাখ পুঁজিবাদের বিপক্ষে দাঁড়ায়; তার বুকের মধ্যে আছে সাম্যের চেতনা, আছে ভেদ-বিলোপের বাসনা।

পুঁজিবাদ মানুষকে ইতিবাচক অনেক কিছু দিয়েছে, কিন্তু তার নেতিবাদী চেতনার সবচেয়ে বড় দান বিচ্ছিন্নতা। পুঁজিবাদ কিংবা একালের বিশ্বয়ান মানুষকে কেবল বিচ্ছিন্ন করে, ধ্বংস করে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের মৌল-বন্ধন। আত্মরতির পক্ষে মানুষের সামূহিক বিপন্নতাই যেন পুঁজিবাদের অন্তিম গন্তব্য। এ প্রেক্ষাপটেই জরুরি হয়ে ওঠে পহেলা বৈশাখ। শিক্ষিত শাহরিক মধ্যবিত্ত বাঙালির কাছে পহেলা বৈশাখ মিলনের। আহ্বান নিয়ে আসে, ডাক দেয় তাকে বৃহত্তর লোকসমাজের সঙ্গে মিলনের। মাটি ও মানুষের সঙ্গে, দেশ ও ভাষার সঙ্গে একাত্ম হতে আহ্বান জানায়। নববর্ষের প্রথম ভোর বিচ্ছিন্নতাপীড়িত মধ্যবিত্ত মানুষকে লোকপুরাণের ফিনিক্স পাখির মতো পুনর্গঠিত হবার আহ্বান জানায় । পুঁজিবাদসৃষ্ট মানুষের সঙ্গে মানুষের বিচ্ছিন্নতা কাটাতে চায় নববর্ষ তার আহ্বানটা মিলনের, একাত্মতার, সহযোগের সংহতির এবং সম্প্রীতির।

৪ আমাদের জীবনে নির্দিষ্ট সময়ে নববর্ষ আসে, কিন্তু এসেও যেনো আসে না, এসেই চলে যায়; আর এ কারণেই মনে আসে নানা ভাবনা, বিচিত্র চিন্তা। নববর্ষ-উৎসবের রূপ- রূপান্তরের কথা ভাবতে ভাবতে আমার চেতনায় দেখা দিচ্ছে ভিন্ন এক ভাবনা। পূর্বেই ব্যক্ত হয়েছে যে, নববর্ষই আমাদের শ্রেষ্ঠতম ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব। অতীতে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী বাঙালি মিলিতভাবে নববর্ষ পালন করেছে, করছে এখনো। কিন্তু জাতীয় জীবনে এখনো দূর হয়নি সংকীর্ণ সম্প্রদায়চেতনা, সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি। নববর্ষ উৎসবের অন্যতম শিক্ষাই হচ্ছে অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি ও মিলিত জীবন-চেতনা। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো এ ক্ষেত্রে বিরাজ করছে এক বিশাল শূন্যতা। গণতান্ত্রিক চেতনা এ দেশে কখনো স্বাবলম্ব হতে পারেনি, কখনো চর্চা হয়নি সুস্থ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির। চারদিকে কেবল ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থ উদ্ধারের গোপন-প্রকাশ্যে প্রতিযোগ। বাংলাদেশ এখন বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর খবরদারির অবাধ লীলাক্ষেত্র। চারদিকে বিরাজ করছে হতাশা, নৈরাশ্য, অসহায়তা, চরম নিরাপত্তাহীনতা। এ অবস্থা থেকে পহেলা বৈশাখ কি আমাদের মুক্তির কোনো পথ দেখাতে পারে?

ঔপনিবেশিক আমলে পহেলা বৈশাখ উদযাপন ছিল বাঙালির একটি সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ। আজকে আবার এই  জাতীয়তাবাদী চেতনা নিয়ে নববর্ষ উদযাপন করা জরুরি। নববর্ষের মিলিত শক্তি দিয়ে দাঁড়াতে হবে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক চারিত্র্য অর্জনের কারণেই পহেলা বৈশাখ আমাদের কাছে এই দাবি নিয়ে হাজির হয়- অপশক্তির পৃষ্ঠপোষকদের নিবৃত্ত করা হোক। মহান মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তির বিরুদ্ধে গোটা জাতিকে সম্মিলিতভাবে দাঁড়াতে হবে। বাংলা ভাষা নিয়ে হালে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, প্রমিত বাংলাকে যেভাবে উদ্দেশ্যচালিত তাত্ত্বিক প্রচার করছেন সংস্কৃত বাংলা বলে, তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। কর্পোরেট পুঁজিনিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্রসমূহে বাংলাভাষার নানামাত্রিক ব্যবহার সৃষ্টি করছে বহুমুখী বিভ্রান্তি, বানান রীতিতে মানা হচ্ছে না ব্যাকরণের নিয়ম-রীতি, বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে বেতারে প্রচারিত হচ্ছে উদ্ভট জগাখিচুড়ি ভাষার অনুষ্ঠান, টিভি-নাটকে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার নিয়ে চলছে এক মহোৎসব- এসব প্রবণতার বিরুদ্ধে পয়লা বৈশাখের চেতনায় মিলিতভাবে রুখে দাঁড়ানো প্রয়োজন। শিক্ষা ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে চলছে চরম ইংরেজ-প্রীতি। দেখেশুনে মনে হয় বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা নয় ইংরেজি। কখনো কখনো মনে হয় বায়ান্ন সেনানীদের মতো আমাদের কি আবার দাবি তুলতে হবে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘বাংলার প্রকৃত রাষ্ট্রায়ন চাই।’

আমাদের চারধারে এখন এমন সব প্রবণতা চলছে, যা সুকৌশলে ঐতিহ্য থেকে বাঙালিকে উন্মুলিত করার অপপ্রয়াসের নামান্তর। অথচ আমরা তো জানি, পহেলা বৈশাখ মানে বাঙালির ঐতিহ্য-অন্বেষা, পহেলা বৈশাখ মানে বাঙালির আপন শিকড়-অন্বেষা। পহেলা বৈশাখে নববর্ষ উদযাপনকে একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে না দেখে, দেখতে হবে ঔপনিবেশিক আমলের মতো রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে। রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করে বিষ্ণু দে একটা কাব্যের নাম রেখেছেন ‘তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ’। বিষ্ণু দে-র অনুসরণে আমাদেরও বলতে ইচ্ছা হয় ‘তুমি শুধু পয়লা বৈশাখ?’ না, পয়লা বৈশাখ কেবলই পয়লা বৈশাখ নয়। এই বৈশাখের বুকের ভিতরে আছে আগুন; প্রতিরোধের আগুন। কেবল সাংবাৎসরিক নববর্ষ নয়, ওই প্রতিরোধের আগুনসম্ভব পহেলা বৈশাখ উদযাপন হোক নববর্ষে আমাদের অঙ্গীকার।

আমাদের সংস্কৃতির মূল বৈশিষ্ট্য সমন্বয়ধর্মিতা, আমাদের সংস্কৃতির মূল শক্তি সংঘচেতনা। কিন্তু পঞ্জিকা সংস্কারের ফলে এ ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে ভিন্ন এক ভেদরেখা। এই বৈশাখে আমাদের ভাবনায় দেখা দেয় এ কথা- বাঙালি এখন নববর্ষ পালন করে দুটি ভিন্ন দিনে। এই ভিন্নতা কীভাবে দূর হবে? এ ভিন্নতা তো নববর্ষের মৌনচেতনার পরিপন্থি। নববর্ষের এই শুভার্থী মুহূর্তে আমাদের ভাবনা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী উঠে আসুক কেন্দ্রে, উত্থান ঘটুক প্রান্তজনের। গ্রামীণ অর্থনীতিকে পুনর্গঠিত করার জন্য ইতিবাচক উদ্যোগ নেওয়া হোক, বিস্তৃত হোক আমাদের নববর্ষের চেতনা, বিকশিত হোক বাঙালির আবহমান মিশ্র-সংস্কৃতি।

দেশের বর্তমান দুরবস্থা ও নানামাত্রিক বিপন্নতা থেকে উত্তরণের আশা নিয়ে পুবদিকে উঠেছে ১৪৩১ বঙ্গাব্দের প্রথম সূর্য। এই বৈশাখ আমাদের কাছে আসুক দুরবস্থা উত্তরণের সৃষ্টিশীল বিকল্পের উৎস হয়ে। বহুবিধ বিপর্যয় ও বিপন্নতার মধ্যেও এই বৈশাখে আমরা মিলিতভাবে আশায় বুক বাঁধি বহুশ্রুত এক মিথ-কাহিনির অনুষঙ্গে। মিথ-কাহিনির সেই ফিনিক্স পাখিই আপন দেহভস্ম থেকে যে আবার জেগে উঠতে পারে সপ্রাণ সত্তায়- আমাদের রক্ষা করবে। বাংলাদেশের জনগণের মাঝেই আছে ফিনিক্স পাখির সেই জেগে ওঠার শক্তি। তাই তারাই এ দেশের অগ্রযাত্রায়, উন্নত সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে, বৈশাখিচেতনা বিস্তারে, শেষ প্রতিরোধ, অন্তিম ভরসা।

সহায়ক গ্রন্থ ও প্রবন্ধপঞ্জি

আদিত্য কবির, ‘'পহেলা বৈশাখের ভূত-ভবিষ্যৎ', বণিকবাতা, নববর্ষ সংখ্যা, ১৪ই এপ্রিল ২০১২, ঢাকা জয়নাল আবেদীন খান, বাংলা সন: ইতিহাস, উৎপত্তি ও বিকাশ, ২০০৬, ঢাকা  নিত্যানন্দ চক্রবর্তী (সম্পাদক), শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, শ্রীশ্রী গীতা সংঘ বাংলাদেশ, ২০১৬, ঢাকা পলাশ বরণ পাল, সাল তারিখের ইতিহাস, ১৯৯৪, কলকাতা। ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, বঙ্গ, বাঙ্গালা ও ভারত, ২০০০, কলকাতা শামসুজ্জামান খান, ‘বাংলা সন ও পঞ্জিকা: ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কার-প্রয়ার্স', যুগান্তর, বৈশাখ সংখ্যা ১৪১৮, ঢাকা  শামসুজ্জামান খান, ‘বাংলা নববর্ষ: ইতিহাস ঐতিহ্য ও নবরূপায়ণ, বৈতার বাংলা, বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ ১৪২১, ঢাকা সুখময় মুখোপাধ্যায়, বাংলা সনের ইতিহাস প্রসঙ্গ, এক্ষণ, শারদীয় সংখ্যা ১৪০০, কলকাতা Abul Fayl, Ain-i-Akbari, 1967 edition, Royal Ontario, Lahore. Amartya Sen, The Idea of Justice, 2009, Allen Lane, London. Amartya Sen, An Assesment of the Millennium, UNESCO Lecture, 1998, Nwe Delhi. Amitava Bhattacharjee, The Bengal Era in the inscriptions of late mediaeval Bengal, Indian Museum Bulletin, Vol. 21, 1986, Kolkata. Jadunath Sarkar, India of Aurangyib, 1998, Kolkata, Jadunath Sarkar, History of Aurangyib, Yol. iii, 1972, Kolkata, Meghnad Saha, Collected Works, 1988, Kolkata.