মতামত

দুঃসময়ের সারথি

সাংবাদিকদের নিয়মিত আড্ডা বসে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) চত্বরে। ঢাকার প্রাণকেন্দ্র সেগুনবাগিচায় ডিআরইউ কার্যালয় হওয়ায় বিভিন্ন কার্যালয়ে দিনের সংবাদ সংগ্রহে দায়িত্বরত সাংবাদিকরা দুপুরের পর সেখানে এসে হাঁফ ছেড়ে বসেন। বিশেষ করে সচিবালয়ে দায়িত্বরতরা। ডিআরইউ এর নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সদস্যদের জন্য স্বল্পমূল্যে দুপুরের স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের ব্যবস্থা থাকে। ফলে কাজের ফাঁকে সেখানে বসে দুপুরের খাবারটাও সেরে নেওয়া যায়।

ডিআরইউ-এর বাইরে জাতীয় প্রেসক্লাব চত্বর, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন বা ডিইউজের কার্যালয়েও সাংবাদিকরা জড়ো হয়। আড্ডা দেয়। আর সাংবাদিকদের বিভিন্ন ইউনিটের নির্বাচন ও জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের একসঙ্গে মিলিত হওয়ায় সুযোগ মেলে। সেখানে বর্তমান ও সাবেক সহকর্মী, বন্ধুদের মধ্যে কথা হয়, ভাবের আদান-প্রদান হয়, পেশা সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য আদান-প্রদান হয়।

আমাদের দেশে সাংবাদিকতা পেশা এখনও ভ্রাম্যমাণ ফেরিওয়ালার মতো। যখন যে হাউজের সঙ্গে মিলমিশ হয়, সেখানে কিছু সময়ের জন্য বেচাকেনা হয়। শ্রমিক বা মালিক কোনো পক্ষের না পোষালে সেই বারের মতো সম্পর্ক ছেদ। সাংবাদিকের আবারও বেকার হওয়া। কিছুদিন পর আবারও নতুন স্বপ্ন, নতুন হাউজ, নতুন সহকর্মী।  সম্পর্ক ছেদ না হওয়া পর্যন্ত সেটাই তার কর্মস্থল। কর্মস্থল পরিবর্তন হয়, পেশাটা একই থাকে। পেশার প্রতি যে সাংবাদিকের যতবেশি কমিটমেন্ট থাকে, তিনি তার কর্মস্থলকে ততবেশি দিতে পারেন। তবে সাংবাদিকরা সকার-বেকার যাই থাকুক, ডিআরইউয়ে আড্ডায় তাকে পাওয়া যায়।

একজন সাংবাদিককে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকতে হয়। তিনি অনেক কিছু দেখেন বা জানেন; না দেখেও অনেক ঘটনার বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারেন, কিন্তু সবকিছু লিখতে পারেন না। প্রকাশিত তথ্যের সত্যাসত্য, সামাজিক দায়বদ্ধতা, মামলা-হামলার দায় তাকেই বহন করতে হয়। তিনি অনেক কিছু বলতে চান, কিন্তু পারেন না। আবার অনেক সাংবাদিক নিজের বা মালিকের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অনেক কিছু বলেন, যা সাংবাদিকদের নীতিমালায় মধ্যে যায় না। প্রকৃতি অর্থে সেটা সাংবাদিকতা নয়। স্বাধীন সাংবাদিকতা আজ অনেকাংশে রুদ্ধ, তেমনি ইন্টারনেটের কল্যাণে অপসাংবাদিকতারও দ্রুত বিস্তার ঘটছে। এর মধ্যে আজ আমরা যারা সত্যিকার অর্থে সাংবাদিকতা করে টিকে থাকতে চাইছি, তাদের বড় দুঃসময়।

পড়ুন: রাইজিংবিডির এক যুগে পদার্পণ, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

সাংবাদিকতায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলার পর সিনিয়রদের কাছ থেকে জেনেছি, ধনী হওয়ার পেশা এটা নয়। যিনি বিত্ত-বৈভবের স্বপ্ন দেখেন, তার এ পেশায় না থাকায় ভালো। এ পেশা দেশ ও জাতির বৃহত্তর উন্নতির সাধনের জন্য। এ পেশা সম্মানের। এটা ঠিক পেশা নয়, এক ধরনের নেশা। যে পেশায় নেশায়-নেশায় আধো জাগ্রত, আধো ঘুমে ঘুমে জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটে যায়। যখন চেতন হয়, তখন রিক্ত হাতে রোগে-শোকে নিদারুণ অনিশ্চয়তার মধ্যে জীবনের বাকি সময়টুকু কোনো রকমে টেনে নেওয়া দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। তখন জীবনের এই পড়ন্ত সময়ে প্রবীণ মানুষগুলো দলবেঁধে প্রেসক্লাব বা ডিআরইউয়ে আড্ডা দেন, সময় কাটান।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ফুটপাতে চায়ের দোকানে কয়েকজন সাংবাদিক আড্ডায় বসতেন। সারা দিনের অ্যাসাইনমেন্ট সেরে অফিসে রিপোর্ট করে সেখানে উপস্থিত হতেন সবাই। অনেকটা রাত পর্যন্ত আড্ডা চলত। একদিন আড্ডার মাঝপথে এক সাংবাদিকের স্ত্রী ফোন করলেন। বাসায় পেঁয়াজ নেই, জানাতেই সাংবাদিক অনেকটা ক্ষেপে গেলেন। স্ত্রীকে বলতে লাগলেন, তুমি জানো, তোমার স্বামী আজ কাদের কাদের সঙ্গে মিটিং করেছে। সকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে, বিকেলে পুলিশের আইজির সঙ্গে, এরপর সচিবালয় থেকে বের হয়ে প্রেসক্লাসে আরেকটি..জাতির জন্য এতটা গুরুত্বপূর্ণ তোমার স্বামী। আর তার জন্য এতটুকু সমীহ নেই। তাকে বলছো, পেঁয়াজ কিনতে? তার দিকে তাকিয়ে বন্ধুরা মুখ চেপে হাসছে। ওই দিন ওই সাংবাদিকের চায়ের বিল দেওয়ার টাকাও পকেটে ছিল না।

বেশ কয়েক বছর আগে, একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ হয়। ওই পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক চিন্তা-চেতনায় ছিলেন পশ্চিমাধাচের। তিনি বাংলাদেশে ওয়াশিংটন পোস্টের আদলে অফিস-প্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। যদিও পরে তাকে ওই পত্রিকা ছেড়ে চলে যেতে হয়। মালিকপক্ষ কর্পোারেট জগতের মানুষ। তারা পত্রিকার দায়িত্ব পুরোপুরি হাতে নিলেন এবং তাদের শিল্পগ্রুপের কয়েকজন বিশ্বস্ত কর্মকর্তাকে সেখানে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসলেন। তারা চাচ্ছিলেন পত্রিকাটি তাদের মতো করে চালাবেন। চেষ্টাও করলেন। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যে সাংবাদিকদের সঙ্গে তাদের বিরোধ হতে লাগল। তারা বুঝতে চাইছিলেন না, কর্পোরেট কালচারে সাংবাদিকদের অভ্যস্ত করা যাবে না। দুটি ভিন্ন সংস্কৃতির পেশা। পত্রিকাটি এখনও টিকে আছে, তবে শুরুর সেই প্রভাব এবং গ্রহণযোগ্যতা নেই।

তথ্য-প্রযুক্তি উৎকর্ষের কারণে এখন গণমাধ্যমের ইয়াত্তা নেই। দেশে এখন কয়েক ডজন টেলিভিশন, কয়েক হাজার নিউজ পোর্টাল, শত শত দৈনিক পত্রিকা প্রতি মুহূর্তে সংবাদ প্রচার-প্রকাশ করছে। এর বাইরে বেশি তথ্য প্রচার হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এখন সাংবাদিক অগুনতি। এখন সাংবাদিক হতে প্রশিক্ষণ লাগে না। নিবন্ধনের প্রয়োজন হয় না। যার যখন খুশি সাংবাদিক হন। কারও জবাবদিহিতা নেই। যার যা খুশি প্রচার করে। ফেক তথ্যের ভিড়ে আসল তথ্য হারিয়ে যায়। রাষ্ট্রে অস্থিরতা বাড়ে। তথ্যের গুরুত্ব বা সামাজিক দায়বদ্ধতা না মেনে প্রচার করা সংবাদে সমাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যারা সাংবাদিকতা জানেন বা বোঝেন, তারাও সবাই আগে ও বেশি পাঠকের কাছে পৌঁছানোর প্রতিযোগিতায় অসহায়। মনে হচ্ছে, এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে শিগগিরই মুক্তি নেই। এর সঙ্গে ডিজিটালের প্রভাবে প্রিন্ট মিডিয়ার চাহিদা কমছে। যে সিনিয়র সাংবাদিকরা ডিজিটালে পেরে উঠছেন না, তারা অসহায় হয়ে পড়ছেন। আবার বিজ্ঞাপন মার্কেটও এখন রমরমা নেই। বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে তা ভাগ হয়ে যাচ্ছে। নিজের আয়ে গণমাধ্যম-প্রতিষ্ঠান ঠিকে থাকতে পারছে না। এতে গণমাধ্যমের ওপর কর্পোরেট জগতের প্রভাব বাড়ছে। যত প্রভাব বাড়ছে, গণমাধ্যম ক্রমে স্বাধীন সাংবাদিকতা হারাচ্ছে। ব্যবহৃত হচ্ছে প্রতিষ্ঠানিক বা রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারে। সত্যিই দুঃসময় গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে।

গত দুই-তিন দশকে দেশে অনেক প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া প্রতিষ্ঠা হয়েছে, তার বেশিরভাগ ঠিকে থাকতে পারেনি। কয়েকটি মাত্র ভালোভাবে ঠিকে আছে। কেন স্বকীয়তা নিয়ে কোনো গণমাধ্যমে দাঁড়াতে পারছে না, তার কারণ বহুবিধ। এর একক কোনো সমাধানও নেই। তবে সর্বাগ্রে, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে স্বাধীন সাংবাদিকতা দিয়ে জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে। এর বিকল্প নেই।

সাংবাদিকরা নিতান্তই কলম পেশা শ্রমিক। কলম আর আড্ডা তার সম্বল। আড্ডায় আড্ডায় তার জীবন কাটে। আড্ডার মধ্যে নিজের অপ্রাপ্তি-ব্যর্থতা লুকিয়ে রাখে। আনন্দ খোঁজে। আড্ডার মধ্যে নতুন আইডিয়া আবিষ্কার করে। সাংবাদিকেরাও শ্রমিক তবে অন্য পেশা থেকে কিছুটা আলাদা।

লেখক: সাংবাদিক