মতামত

অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা করতে হবে

দেশের মোট শ্রমিকের একটি বড় অংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক। তারা সমৃদ্ধ করে চলেছেন দেশের কৃষি, মৎস্য চাষ ও প্রক্রিয়াকরণ, নির্মাণ কাজ, হকার, চাতাল, বিড়ি কারখানা, সেলাই কাজ, ওয়েল্ডিং, তাঁত, প্রিন্টিং, হোটেল ও রেস্তোরাঁ, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান, ইটভাটা, গৃহস্থালি কর্ম, ক্ষুদ্র কারখানা প্রভৃতি খাত। অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। কিন্তু আপনার চারপাশের অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকেরা কেমন আছে?

এই তাপদাহের দিনেও অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকেরা কাজের আশায় রাস্তায় জড়ো হচ্ছে। প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তি যার যার প্রয়োজন অনুযায়ী তাদেরকে চুক্তিভিত্তিতে কাজে নিয়োগ দেওয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছে। এই গরমে খুব প্রয়োজন না হলে তেমন কেউ রাস্তায় বের হচ্ছে না। রিকশাচলকদের আয় রোজগার কমে গেছে। অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা পুরো দিন রাস্তায় টিকতেও পারছেন না। তিন-চার ঘণ্টা কাজ করে বাসায় ফিরতে হচ্ছে। এই অস্বস্তিমূলক গরমের দিনে গৃহপরিচালিকারা যেসব পরিবারে নিয়োগ পেয়েছেন, সেখান থেকে বাড়তি কোনো সুযোগ পাচ্ছেন বলে মনে হয় না। এই অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মীদের নিরাপত্তা, ভালো-মন্দ দেখার মতো, তদারকি করার মতো কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। এজন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের কর্মঘণ্টা অনির্দিষ্ট।

তাদের নিরাপত্তার দিকটি দেখারও কেউ নেই। আমরা প্রায়ই এমন খবর পাই যে, বহুতল ভবন রং করতে গিয়ে একজন রং মিস্ত্রি পরে মরে গেছে। কিংবা একজন রাজমিস্ত্রি মরে গেছে। গৃহকর্মীদের অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবর আসে। কিন্তু এদের মৃত্যুতে কোথাও কোনো মিছিল হয় না, মিটিংও হয় না। অথচ জাতীয় উন্নয়নে তাদের অবদান মোটেও কম নয়। আরও জোর দিয়ে বললে আমাদের সমাজে তাদের অবদান কোনো অংশেই তুচ্ছ নয় বরং অমূল্য।

জানা যায়, ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটের ম্যাসাকার শহীদদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে পালিত হয়। সেদিন দৈনিক আট ঘণ্টার কাজের দাবিতে শ্রমিকরা হে মার্কেটে জমায়েত হয়েছিল। আর তাদেরকে ঘিরে থাকা পুলিশের প্রতি এক অজ্ঞাতনামার বোমা নিক্ষেপের পর পুলিশ শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। ওই ঘটনায় ১০-১২ জন শ্রমিক ও পুলিশ নিহত হয়। ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লবের শতবার্ষিকীতে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে থেকে শিকাগো প্রতিবাদের বার্ষিকী আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে পালনের প্রস্তাব করেন রেমন্ড লাভিনে। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেসে এই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়।

বাংলাদেশে মে দিবসে সরকারি ছুটি উদযাপন করা হয়। দিনটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বাণী দিয়ে থাকেন। নতুন নতুন নির্দেশনাও আসে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠন দিনটি পালন করতে শোভাযাত্রা, শ্রমিক সমাবেশ, আলোচনা সভা, সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা কর্মসূচি নিয়ে থাকে। বিশেষ করে মে দিবসে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রমিক ফেডারেশনসহ বিভিন্ন সংগঠন পৃথক কর্মসূচি পালন করে।

কিন্তু এই দিনেও অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের নিয়ে আলাদা করে কোনো কর্মসূচি আসে না। কারণ তাদের আলাদা সংগঠন নেই, ইউনিয়ন নেই। কিন্তু বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। সময় এসেছে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি আরও মজবুত করার। এক্ষেত্রে শুধু সরকার নয় বড় বড় কোম্পানিগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। আমরা দেশ হিসেবে উন্নত হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। সেই লক্ষ্যে উন্নত দেশের নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার দিকেও একটু একটু করে এগিয়ে যেতে হবে।

এই অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকরা বড় বড় কোম্পানিগুলোর উন্নত করতে অবদান রাখছেন। সুতরাং সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর উচিত তাদের উন্নয়নে দায়িত্ব পালন করা। কোম্পানিগুলোর করপোরেট রেসপনিবিলিটি থেকেই এই দায়িত্ব নিতে হবে। সর্বপরি শ্রম মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনায়  শ্রমিক মনিটরিং সেল থাকা উচিত।

যেসব খাতের অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকে সংখ্যায় কম যাদেরকে সংগঠনের আওতায় আনা সম্ভব নয়; আমরা যেন যে যার জায়গা থেকে তাদের প্রতি মানবিক থাকি। এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে দেশ উন্নত হলেও, দেশের নাগরিকদের একটা বড় অংশই সামাজিকভাবে তারা নিরাপত্তাহীনতায় থাকবেন।

মে দিবসের প্রকৃত দাবি প্রতিষ্ঠিত হোক। মে দিবসে সব শ্রমিককে শুভেচ্ছা এবং লাল সালাম।