রাইজিংবিডি স্পেশাল

ডিপিডিসি-তে তোলপাড়, শেষ হচ্ছে মিটার বাণিজ্য ও বৈষম্য 

গ্রাহকদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে অবশেষে টনক নড়েছে রাজধানীতে বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ঢাকা পাওয়ার ডিস্টিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি)। বেশি দামে মিটার কিনতে গ্রাহককে বাধ্য করার মাধ্যমে যে হয়রানি করা হতো, তা নিয়ে রাইজিংবিডি ডটকমে তিন পর্বের প্রতিবেদন প্রকাশের পর নড়েচড়ে বসেছে ডিপিডিসি কর্তৃপক্ষ। আসছে সমাধান। কমিশন বাণিজ্যের মিটার সিন্ডিকেটের শেষ চেষ্টা ও বিরোধিতাও ধোপে টেকেনি। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) গ্রাহকবান্ধব সমাধানের নির্দেশ দিয়েছেন। তাতেই শেষ হচ্ছে মিটার নিয়ে বাণিজ্য ও বৈষম্য। তবে, ভেতরে ভেতরে এখনো গুটি চালাচালি করছে সেই কমিশন বাণিজ্যের মিটার সিন্ডিকেট। 

ডিপিডিসি সূত্র জানিয়েছে, ডিপিডিসি’র গ্রাহকদের মিটার জটিলতা নিয়ে প্রতিবেদনগুলো প্রকাশের পর তোলপাড় সৃষ্টি হয়। প্রতিষ্ঠানটির এমডি প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ নোমান গ্রাহকদের এই দুর্ভোগের বিষয়টি অবহিত হওয়ার পর তার নির্দেশে রোববার সকাল সাড়ে ১০টায় বিদ্যুৎ ভবনে ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালকের কক্ষে জরুরি সভা হয়। 

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, এখন পুরনো উচ্চচাপ বিদ্যুতের গ্রাহকরা, ১৬০ কিলোওয়াট পর্যন্ত লোড যাদের, এইচটি মিটার নষ্ট হলে এলটিসিটি মিটার দিয়ে পুনরায় বিদ্যুৎ সংযোগ চালু করতে পারবেন। ওই গ্রাহকদের আর এইচটি মিটারের জন্য সাড়ে ৩ লাখ টাকা খরচ করতে হবে না। এখন থেকে ৪০ হাজার টাকা খরচ করলেই এলটিসিটি মিটার দিয়েই সংযোগ চালু করতে পারবেন তারা।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন—নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) কিউ এম শফিকুল ইসলাম, নির্বাহী পরিচালক (অর্থ) মো. গোলাম মোস্তফা, প্রধান প্রকৌশলী (সেন্ট্রাল) মো. জাহাঙ্গীর আলম, ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী (নর্থ) আবু হেনা মোস্তফা কামাল, ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী (সাউথ) শহীদুল মান্নান, জিএম (আইসিটি অ্যান্ড মিটারিং) মো. রবিউল ইসলাম, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (মতিঝিল) আব্দুল মজিদ, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (নারায়ণগঞ্জ) মো. কামাল হোসেন, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (তেজগাঁও) মো. হানিফ উদ্দিন, মিটারিং ডিভিশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সাহেদ বিশ্বাস এবং মিটারিং ডিভিশনের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মুনিম ইসলাম। 

ডিপিডিসি সূত্র জানায়, নতুন উচ্চচাপ বিদ্যুৎ সংযোগে ২০০ কিলোওয়াট সাব-স্টেশনে ১৬০ কিলোওয়াট লোড পর্যন্ত এলটিসিটি মিটারে সংযোগ দেওয়া যাবে, এই সুযোগ রাখা হলেও পুরনো উচ্চচাপ সংযোগে যাদের এইচটি মিটারে ১৬০ কিলোওয়াট পর্যন্ত লোড রয়েছে, তাদের কারো এইচটি মিটার খারাপ হলে তাকে এইচটি মিটারই নিতে হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নতুন উচ্চচাপ সংযোগ যারা নিচ্ছেন, তাদেরও বেশি দামে এইচটি মিটার কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। অনেকে দিনের পর দিন এলটিসিটি মিটার চেয়েও পাচ্ছেন না। তাদেরকে দেওয়া হচ্ছে না। নিয়মের মারপ্যাঁচ দেখিয়ে এইচটি মিটার কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। না কেনা পর্যন্ত তাদেরকে বিপুল অর্থ ‘ইস্টিমেট বিল’ আকারে দিতে হচ্ছে। এই বিল স্বাভাবিক আবাসিক বিলের তুলনায় তিন গুণ বেশি। এটা গ্রাহকের জন্য একপ্রকার শাস্তি। 

সূত্র বলছে, এইচটি মিটার বেশি দামে কিনতে বাধ্য করার নেপথ্যে রয়েছে কমিশন বাণিজ্য। ডিভিশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শাহেদ বিশ্বাসের তত্ত্বাবধানে এই কমিশন বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে। যখনই এলটিসিটি মিটার ব্যবহারের জন্য এ সংক্রান্ত বৈঠক হয়, তখন তিনি এর বিরোধিতা করেন। তার সঙ্গে ডিপিডিসি-তে সদ্য যোগদানকারী নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) কিউ এম শফিকুল ইসলামের নামও অভিযোগের তালিকায় উঠে এসেছে। এছাড়াও এই মিটার সিন্ডিকেটে নামে এসেছে আরো চারজনের। এদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির মিটারিং বিভাগের উত্তর বলয়ের (নর্থ বেল্ট) সহকারী প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেন। প্রায় ৯ বছর একই জায়গায় কর্মরত আছেন তিনি। তার সাথে রয়েছেন মিটারিং ডিভিশনের দক্ষিণ বলয়ের (সাউথ বেল্ট) সাব-ডিভিশনাল (এসডি) প্রকৌশলী পলাশ কৃষ্ণ চৌধুরী। তিনিও প্রায় ৮ বছর একই জায়গায় কর্মরত আছেন। মিটারিং বিভাগের মধ্য বলয়ের (সেন্ট্রাল বেল্ট) ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মুনিম ইসলাম। তাকে সহযোগিতা করছেন তার অধীনস্থ উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. আরিফ হোসেন। মো. মুনিম ইসলাম মিটারিং ডিভিশনে প্রায় আট বছর ধনে একই জায়গায় কর্মরত। এরাই গড়ে তুলেছেন মিটারের সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের কারণে গ্রাহক হয়রানি চরমে পৌঁছেছে। 

মিটারিং বিভাগের সিন্ডিকেটের একচ্ছত্র আধিপত্য ও অনিয়মের ওপর প্রথম আঘাত আসলো রোববারের বৈঠক থেকে। গ্রাহকের ৪০ হাজার টাকায় যে কাজ হতো, তা সাড়ে ৩ লাখ টাকা দিয়ে করতে বাধ্য করানো বন্ধের সমাধান আপাতত হলো। যদিও বৈঠকে এর বিরোধিতা করেছেন কমিশন বাণিজ্যের সিন্ডিকেটের কয়েকজন সদস্য। শেষ পর্যন্ত তাদের বিরোধিতা ধোপে টেকেনি। তবে, প্রশ্ন উঠেছে, মিটার সমস্যার সমাধান হলেও এই খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতির মাফিয়া হিসেবে পরিচিতি পাওয়া সিন্ডিকেটের কী হবে? তারা কি বহাল তবিয়তে থাকবেন? তবে, সূত্র বলছে, সিন্ডিকেটের বিষয়ে পদক্ষেপে যাবে কর্তৃপক্ষ।   

ডিপিডিসি’র জেনারেল ম্যানেজার (আইসিটি অ্যান্ড মিটারিং) মো. রবিউল হাসান রাইজিংবিডিকে বলেছেন, মিটার সিন্ডিকেট ও কমিশন বাণিজ্য নিয়েও পদক্ষেপ নেওয়া হবে, তদন্ত হবে। 

বৈঠকে একাধিক প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সভাতে বেশিরভাগ প্রকৌশলী পুরনো বিদ্যুৎ গ্রাহকদের এইচটি মিটারে ১৬০ কিলোওয়াট লোড পর্যন্ত এলটিসিটি মিটার দেওয়ার সুপারিশ করেছেন। যদিও নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) ও মিটারিং ডিভিশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেছিলেন ১৬০ কিলোওয়াট লোড পর্যন্ত পুরনো বিদ্যুৎ গ্রাহকদের এইচটি মিটারই কিনতে হবে। কিন্তু, সর্বসম্মতিক্রমে ওই সভায় তাদের এই যুক্তি বাদ হয়ে গেছে। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো) উচ্চচাপ সংযোগের ক্ষেত্রে ২৫০ কিলোওয়াট সাবস্টেশনে ২০০ কিলোওয়াট লোড পর্যন্ত নতুন সংযোগে এলটিসিটি মিটার স্থাপনের অনুমোদন দেওয়ার সুযোগ রেখেছে। ডিপিডিসিতে এটা নতুন সংযোগের জন্য ১৬০ কিলোওয়াট উচ্চচাপ সংযোগ পর্যন্ত রাখা হলেও পুরনোদের সাড়ে ৩ লাখ টাকা দিয়ে এইচটি মিটার কিনতে হতো। অনেক ক্ষেত্রে নতুন সংযোগপ্রত্যাশীদেরও অপেক্ষায় রাখত, যাতে তারা এইচটি মিটার ব্যবহার করেন। রোববারের বৈঠকের পর ডিপিডিসি থেকে উচ্চচাপ সংযোগের ক্ষেত্রে ১৬০ কিলোওয়াট পর্যন্ত সব ধরনের গ্রাহককে এলিটিসিটি মিটার ব্যবহারের সুযোগ রেখে ডিপিডিসি প্রজ্ঞাপন জারি করতে যাচ্ছে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে।    

জানতে চাইলে ডিপিডিসি’র জেনারেল ম্যানেজার (আইসিটি অ্যান্ড মিটারিং) মো. রবিউল হাসান রাইজিংবিডিকে বলেছেন, এইচটি ও এলটিসিটি মিটার সমস্যার সমাধান হচ্ছে। এক্ষেত্রে গ্রাহকসন্তুষ্টির বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। খুব শিগগিরই এটা জানতে পারবেন।