রাইজিংবিডি স্পেশাল

পরীমনি-নাসিরের অভিযোগ সত্য, মামলার বিচার কত দূর?

তিন বছর আগে সাভারের বোট ক্লাবে শ্লীলতাহানি ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে ওই ক্লাবের পরিচালক নাসির উদ্দিন মাহমুদের বিরুদ্ধে মামলা করেন চিত্রনায়িকা পরীমনি। মামলা দায়েরের পর গ্রেপ্তার করা হয় নাসির উদ্দিনকে। পুলিশ তার বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। অন্যদিকে, নাসির কারামুক্ত হয়ে আদালতে পরীমনির বিরুদ্ধে মারধর, ভাঙচুর ও ভয় দেখানোর অভিযোগে মামলা করেন। সে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে মর্মে প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। দুজনের করা অভিযোগেরই সত্যতা মিলেছে। এ দুই মামলায় বিচার প্রক্রিয়া কত দূর এগিয়েছে, জানার আগ্রহ অনেকের।

পরীমনিকে মারধর-শ্লীলতাহানি:

২০২১ সালের ১৪ জুন নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও তার বন্ধু অমির নাম উল্লেখ করে সাভার থানায় মামলা করেন পরীমনি। তদন্ত শেষে ওই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সাভার মডেল থানার পরিদর্শক কামাল হোসেন আদালতে নাসিরসহ তিনজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দেন। ২০২২ সালের ১৮ মে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৯ এর তৎকালীন বিচারক মোহাম্মদ হেমায়েত উদ্দিনের আদালত নাসির উদ্দিন মাহমুদ, তুহিন সিদ্দিকী অমি, শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন।

এদিকে, মামলার বিচার শুরুর পর আদালত সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ১০টি তারিখ ধার্য করেন। ইতোমধ্যে নয়টি ধার্য তারিখ শেষ হলেও কোনো সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়নি। ২০২২ সালের ১ আগস্ট সাক্ষ্য গ্রহণের প্রথম ধার্য তারিখে পরীমনি আদালতে উপস্থিত না হয়ে সময় চেয়ে আবেদন করেন। ওই বছরের ২৯ নভেম্বর পরীমনি আদালতে উপস্থিত হয়ে সাক্ষ্য দেন। ওইদিন তার জবানবন্দি গ্রহণ শেষ না হওয়ায় আদালত গত বছরের ১১ জানুয়ারি তার অবশিষ্ট সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য পরবর্তী তারিখ ধার্য করেন। পরে ওই বছরের ৬ মার্চ ও গত ২৩ মে এ মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য ছিল। তবে, পরীমনি অসুস্থ থাকায় আদালতে উপস্থিত হননি। দুই ধার্য তারিখ পর গত ২৪ জুলাই তিনি আদালতে উপস্থিত হন। ওইদিন অবশিষ্ট জবানবন্দি দিতে গিয়ে তিনি আদালতের সাক্ষীর ডকে দাঁড়িয়ে কান্না করতে থাকেন। পরে আদালত ক্যামেরা ট্রায়ালে মামলাটির বিচার কার্যক্রম চলবে বলে জানান। ওইদিন আদালত পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ৯ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেন। কিন্তু, পরীমনি এই ধার্য তারিখে আদালতে হাজির হননি। পরে চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি ধার্য তারিখ থাকলেও তিনি আসেননি। দেশে না থাকায় গত ২০ মার্চ পরীমনির আইনজীবী সময় চেয়ে আবেদন করেন। তখন আদালত পরীমনিকে শেষবারের মতো সময় দেন। পাশাপাশি, আসামিদের প্রত্যেককে যাতায়াত ভাড়া বাবাদ ১ হাজার করে টাকা দিতে নির্দেশ দেন। আগামী ২২ সেপ্টেম্বর সাক্ষ্য গ্রহণের পরবর্তী দিন ধার্য রয়েছে।  

পরীমনির বিরুদ্ধে ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিনের মামলা: ২০২২ সালের ৬ জুলাই আদালতে ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন বাদী হয়ে পরীমনির বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে পিবিআইকে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। পরে গত ১৮ মার্চ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা জেলার পিবিআই’র পরিদর্শক মো. মনির হোসেন অভিযোগের সত্যতা পেয়ে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। এতে পরীমনিসহ জুনায়েদ বোগদাদী জিমিকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। গত ১৮ এপ্রিল ঢাকার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এম সাইফুল ইসলাম আদালত পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে পরীমনিসহ দুই আসামিকে আদালতে হাজির হতে সমন জারি করেন।

আইনজীবীরা বলছেন, বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে কে দোষী, কে নির্দোষ, তা প্রমাণ হবে। 

পরীমনির শ্লীলতাহানির মামলা সম্পর্কে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৯ এর পাবলিক প্রসিকিউটর শহিদুল ইসলাম বলেছেন, ‘সাক্ষী হাজির না করে সময়ের আবেদন করা হয়। বাদীপক্ষ কোনো যোগাযোগ করে না। এসব কারণে মামলার বিচার বিলম্বিত হয়। এ মামলা নিয়ে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে আছি। দ্রুত বিচার হোক। আমরা এ বিষয়ে আদালতকে সব সময় সহযোগিতা করি। কিন্তু, বাদীপক্ষের কারণে মামলায় জট সৃষ্টি হচ্ছে।’ 

নাসির উদ্দিনের আইনজীবী আবুল কালাম মোহাম্মদ সোহেল বলেন, ‘পরীমনির করা মামলায় তার সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ করার জন্য আবেদন করেছি। আগামী ধার্য তারিখে তিনি না আসলে আদালত এ বিষয়ে আদেশ দেবেন। এ মামলায় নিয়মিত সাক্ষ্য গ্রহণ না হলেও আসামিরা আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন। এতে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এছাড়া, আদালতের পরামর্শে পরীমনির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। পিবিআই সত্যতা পেয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দেন। সেই মামলায় হাজিরের জন্য আদালত সমন জারি করেছেন। পরীমনি হাজির না হলে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হতে পারে।’ 

পরীমনির আইনজীবী নীলাঞ্জনা রিফাত (সুরভী) বলেন, আসামিরা ব্যবসায়িক কারণে দেশের বাইরে থাকেন। আদালত সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দীর্ঘ দিন পর পর তারিখ দেন। এ সময় পরীমনি ফ্রি থাকলেও সাক্ষ্য গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া, পরীমনি অসুস্থ ও শ্যুটিংয়ের কারণে আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসতে পারেননি।’

পরীমনির বিরুদ্ধে মাদক মামলা:  বোট ক্লাব কাণ্ডের পর ২০২১ সালের ৪ আগস্ট বিকেলে রাজধানীর বনানীর ১২ নম্বর সড়কে পরীমনির বাসায় অভিযান চালায় র‌্যাব। এ সময় ওই বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য জব্দ করা হয়। পরে তাকে গ্রেপ্তার করে কয়েক দফা রিমান্ডে নেওয়া হয়। ৩১ আগস্ট জামিন পান পরীমনি। পরদিন তিনি কারামুক্ত হন।

এদিকে, ২০২১ সালের ৪ অক্টোবর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগরে (সিআইডি) পরিদর্শক কাজী গোলাম মোস্তফা পরীমনিসহ তিনজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দেন। ২০২২ সালের ৫ জানুয়ারি পরীমনিসহ তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। মামলার অপর আসামিরা হলেন—পরীমনির ম্যানেজার আশরাফুল ইসলাম দিপু ও খালু কবীর হাওলাদার। তারা সবাই জামিনে আছেন।

২০২২ সালের ১ মার্চ এ মামলায় বাদী র‍্যাব-১ এর ডিএডি মজিবর রহমান সাক্ষ্য দেন। তবে, তার সাক্ষ্য শেষ হয়নি। এরইমধ্যে মামলা বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে যান পরীমনি। ২০২২ সালের ১ মার্চ হাইকোর্ট মামলার বিচারিক কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দেন এবং রুল দেন যে, কেন তার বিরুদ্ধে মামলা বাতিল করা হবে না? পরীমনির বিচারাকার্য নিয়ে রুল নিষ্পত্তি করে ২০২৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট আদেশ দেন পরীমনির মামলার বিচার চলবে। এ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেছে পরীমনি। এ কারণে বিচারিক আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণ হচ্ছে না।