‘দেশ স্বাধীন হয়তে (হতে) হবি, না হয়তে (যদি না হয়) নিজে শহিদ হমু’- বাড়িতে এ কথা বলে গত ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিতে যান ষাটোর্ধ্ব রিকশা চালক আব্দুল মান্নান। বর্তমান বাজার দরের সঙ্গে রিকশা চালিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না তিনি। তার মনে হয়েছিল, বিগত সরকারের কারণেই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও সরকার তা নিয়ন্ত্রণ করছে না। তাই তিনি এমন পণ করে বাড়ি থেকে বের হন। কথাগুলো বলছিলেন, নিহত আব্দুল মান্ননের স্ত্রী আসমা বেগম।
আব্দুল মান্নান গত ৪ আগস্ট (রোববার) দুপুর ১২টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গিয়ে বগুড়া শহরের কাঠালতলা এলাকায় গুলিতে নিহত হন। তিনি বগুড়ার বানদীঘি এলাকার বাসিন্দা ছিলেন।
স্থানীয়রা জানান, ৪ ছেলে ও ৩ মেয়ের জনক ছিলেন আব্দুল মান্নান। বড় দুই ছেলে বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছেন। তিন মেয়েকেও বিয়ে দিয়েছেন আব্দুল মান্নান। এরুলিয়া বানদীঘি এলাকায় মাসিক দুই হাজার টাকা ঘর ভাড়া দিয়ে দুই ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করতেন তিনি। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনিই ছিলেন।
নিহত আব্দুল মান্নানের স্ত্রী আসমা বেগম ও দুই সন্তান
বাড়িতে থাকা আব্দুল মান্নানের দুই ছেলের মধ্যে এক ছেলের বয়স ১৬। হাতের দুটি আঙ্গুল না থাকায় তিনি কোনো কাজ করতে পারেন না। অপর সন্তান এখনো ছোট। আব্দুল মান্নান মারা যাওয়ার পর স্থানীয় লোকজন মিলে এলাকা থেকে চাল-ডাল উঠিয়ে তার পরিবারকে দিয়েছে। তবে, সরকারিভাবে কোনো সহযোগিতা এখনো পরিবারটি পায়নি। কোনো খোঁজও নেওয়া হয়নি তাদের।
নিহত আব্দুল মান্নানের বড় মেয়ে মনিরা আক্তার বলেন, ‘বাবা আন্দোলনে গেছে আমরা জানতাম না। দুপুরের দিকে আমার এক জা জানায়, বাবার গুলি লেগেছে। কথাটা শুনে আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। পরে বাবার বাসায় গিয়ে মা আর ভাবিদের বিষয়টি জানাই। তারাও জানতো না। পরে আমার ভাইদের ফোন করি। তারাও আন্দোলনে গিয়েছিলো। পরে জানতে পারি, গুলি লাগার পর ছাত্ররা বাবাকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে গেছে। বাবার লাশ পরে হাসপাতাল থেকে বাসায় আনা হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি ভাবতেই পারছি না, আমার বাবা মারা গেছেন। মনে হয় তিনি বেঁচেই আছেন। তিনি আমাকে ডাকবেন এখন। বাবা প্রতিদিন সকালে বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর আমার সঙ্গে দেখা করতেন। আজ দেশের জন্য আমার বাবা শহিদ হয়েছেন। বাবা হারানোর শোক যেমন ভেতরটা পুড়িয়ে দিচ্ছে, অন্যদিকে একজন শহিদের সন্তান হিসেবে আমি গর্ববোধও করছি।’
আব্দুল মান্নানের স্ত্রী আসমা বেগম জানান, একদিন তিনি (আব্দুল মান্নান) রিকশা নিয়ে বের না হলে খাবার জুটতো না। যে কারণে বয়স ৬০ বছর পেরিয়ে গেলেও তিনি প্রতিদিন রিকশা নিয়ে বের হতেন। ঘটনার দিন সকালেও তিনি রিকশা নিয়ে বের হয়েছিলেন। অল্প কিছুক্ষণ পর রিকশা রেখে বাসায় ফিরে আসেন তিনি। সেসময় তিনি বলেন, ‘হামি রিকশা বন্ধ করে আসলাম। হামি মিছিলে যাচ্ছি। যদি দেশ স্বাধীন হয়তে হবি হবে। না হয়তে নিজে শহিদ হমু’- এই কথা বলে বাড়ি থেকে বের হন। দুপুরের দিকে তারা জানতে পারেন, আব্দুল মান্নান গুলিতে মারা গেছেন।
আসমা বেগম বলেন, ‘অভাবের সংসার একদিন যদি রিকশা নিয়ে বের না হয়, তালে (তাহলে) সংসার চলে না। সেদিন হয়তে না খেয়ে থাকা লাগবি। বাড়িত একটা ছোল (ছেলে) আছে, তার ষুলো বছর বয়েস। তার হাতের দুড্যা লোক (আঙ্গুল) নাই, কাটা গ্যাছে। সে কাজ করতে সেরকম পারে না। আরেকটা ছোট বাচ্চা। আর দুড্যা বড় ছোল তারা তো বিয়্যা করে আলাদা সংসার পাতিছে। এখন এই দুড্যা ছোলক নিয়্যা নিজের সংসার তো নিজেক দেখতে হবি।’
আব্দুল মান্নানের ছেলের হাতের দুটি আঙ্গুল না থাকায় তিনি কাজ করতে পারেন না
তিনি আরো বলেন, ‘হামার নিজের বাড়ি নাই, ঘর নাই, মাথা লুকানোর জাগা (জায়গা) নাই। বাচ্চা দুড্যা নিয়্যা ভাড়া বাড়িত থাকি। হামি (আমি) এখন কিভাবে চলমু আর জাগাঠি (জায়গা) কিভাবে করমু? এড্যাই তো হামার বড় টেনশন। দুই হাজার টেকা বাড়ি ভাড়া দেওয়া লাগে। এই টেকা হামি দিমু কিভাবে? সংসার চলবি কিভাবে? ছোলগুলাক (ছেলেগুলো) মানুষ করমু কিভাবে? ছোট দুড্যা বাচ্চা। তাদের মুখোত যে হামি দানা (খাবার) তুলে দিমু এই সমর্থ্য তো হামার নাই। নিজে তো খাওয়ার চিন্তা করিচ্চি না, বাচ্চা দুড্যার চিন্তা বেশি।’
মান্নানের ছোট মেয়ে স্মৃতি আক্তার বলেন, ‘আমাদের বাবা চলে গেছে। কাউকে বললে হয়তো বুঝতে পারবে না আমাদের মনের ভেতর কী হচ্ছে। বাবা চলে যাওয়ায় আমার মা আর ছোট দুই ভাইয়ের জীবন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেলো। তাদের সংসারে তো আর উপার্জনের কেউ নেই। এই মুহূর্তে আমরা মাকে কিছুদিন সাহায্য করতে পারবো। তারপর তো আমরা কিছুই করতে পারবো না। সরকারের কাছে আমাদের আবেদন, ছোট দুই ভাই আছে, মা আছে তাদের সহযোগিতা যেন তারা করেন। মাথা গোজার ঠায় যেন সরকার করে দেয়।’
নিহতের বড় ছেলে রানা হামিদ জানান, আগে একই বাড়িতে থাকলেও এখন তিনি আলাদা থাকেন। তাদের আলাদা চুলো জ্বলতো। বাবা মারা যাওয়ার পর মা এবং ছোট দুই ভাইকে নিয়ে এখন এক চুলোতেই রান্না হচ্ছে। সরকারিভাবে এখনো কোনো সাহায্য সহযোগিতা তারা পাননি।
‘হয় দেশ স্বাধীন হয়তে হবি, না হয়তে নিজে শহিদ হমু’- আপনার বাবা এই কথাটি আপনার মাকে বলে আন্দোলন গিয়েছিলেন? তিনি তো এই বয়সে আন্দোলনে না গেলেও পারতেন, এ ধরণের কথা বলে যাওয়ার কারণ কি?- জানতে চাইলে রানা হামিদ বলেন, ‘এই কথা শুধু বাড়িতেই না। আন্দোলনে যাওয়ার সময় এলাকার অনেক মানুষকেও বলে গেছেন তিনি (আব্দুল মান্নান)। এই কথা বলার কারণ, আগের সরকারের ওপর মানুষ অতিষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। দ্রব্যমূল্যের দাম বেশি। আমরা গরিব মানুষ, আমাদের তো অর্থনীতির অত কিছু বোঝার দরকার নাই। আমরা দিন করে দিন খাই। আমার দিনে ইনকাম ৫০০ টাকা। বাজারে কেনাকাটা করতে গিয়ে আমার খরচ পড়ছে ৮০০ টাকা। আমার তো সেই টাকা ইনকাম হচ্ছে না।’
বগুড়া জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, আমরা কিছু সহযোগিতা করবো। এটা আমার ব্যক্তি উদ্যোগে। স্টুডেন্ট (শিক্ষার্থী) যারা তাদেরকে আমরা প্রায়োরিটি (অগ্রাধিকার) দিচ্ছি। দুপচাঁচিয়ায় আন্দোলন চলাকালে একজন স্টুডেন্ট মারা গেছেন, আমরা তার পরিবারের খোঁজ নিচ্ছি। আরো যারা নিহত হয়েছেন তাদের খোঁজ খবর নিচ্ছি। তাদের পারিবারিক অবস্থা সম্পর্কে জানছি। আমাদের তরফ থেকে কিছু সহযোগিতা করবো। সম্মানজনক কিছু একটা করতে হবে।’