সাতসতেরো

স্মৃতি জাগানিয়া নাগরপুর জমিদার বাড়ি

জমিদার সুরেশ চন্দ্রের স্মৃতি ও কীর্তি বহনকারী নাগরপুর আমার শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিতে অম্লান এক শহর। নাগরপুরের পূর্বে ধলেশ্বরী নদী আর পশ্চিমে বয়ে গেছে যমুনা নদী। নদীপথে নাগরপুরের সাথে সরাসরি কলকাতার দৈনন্দিন ব্যবসায়িক কাজে যোগাযোগ ছিল। জানা যায় এই জমিদার বংশের প্রথম পুরুষ ছিলেন যদুনাথ চৌধুরী।  তিনি প্রায় ৫৪ একর জমির উপর জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেন। যদুনাথ চৌধুরীর তিন ছেলে উপেন্দ্র মোহন চৌধুরী, জগদীন্দ্র মোহন চৌধুরী ও শশাঙ্ক মোহন চৌধুরী। বৃটিশ সরকারের শাসনামলে এই তিন ছেলের মধ্যে উপেন্দ্র মোহন চৌধুরীর বড় ছেলে সতীশ চন্দ্র রায় চৌধুরী সাধারণ জনগোষ্ঠীর জন্যে বিভিন্ন সেবামূলক কাজ করে আলোচিত হন এবং এর পুরস্কার  ও স্বীকৃতি স্বরূপ বৃটিশ সরকার তাকে রায় বাহাদুর খেতাবে ভূষিত করে। এই উপেন্দ্র মোহন চৌধুরীর ছোট ছেলে সুরেশ চন্দ্র রায় চৌধুরী ছিলেন অপেক্ষাকৃত পাশ্চাত্য সংস্কৃতিঘেষা, সৌখিন প্রকৃতির মানুষ এবং ভীষণ ক্রীড়ামোদী। তিনি ছিলেন উপ-মহাদেশের বিখ্যাত ফুটবল দল ইষ্ট বেঙ্গল ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারী। তার হাত ধরেই নাগরপুর জমিদার বাড়ি আরও পরিপূর্ণতা পায়। 

 পাশ্চত্য এবং মোঘল সংস্কৃতির মিশ্রনে নান্দনিক সৌন্দর্যে নির্মিত জমিদার বাড়ি

১৯৪৭ এর দেশ ভাগের পর তৎকালীন সরকার চৌধুরী বাড়ির সব সম্পদ অধিগ্রহণ করে। পরে পুরো পরিবার চলে যায় কলকাতায়। কিন্তু কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাশ্চত্য এবং মোঘল সংস্কৃতির মিশ্রনে নান্দনিক সৌন্দর্যে নির্মিত জমিদার বাড়ির বৈঠকখানা, নহবতখানা, ঝুলন দালান, ঘোড়ার দালান, রংমহল আরও কত কি! বর্তমানে জমিদার বাড়ির মূল ভবনটি নাগরপুর মহিলা ডিগ্রী কলেজ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। পুরো জমিদার বাড়িটি সুদৃশ্য শ্বেত পাথরের কারুকাজ খচিত। প্রাচীন ভারতের শিল্প কর্মে সজ্জিত চৌধুরী বংশের নিত্যদিনের পূজা অনুষ্ঠান হত ঝুলন দালানে। 

উপেন্দ্র সরোবর। ছবি: লেখক

শৈশবকাল থেকে প্রায় ২০ বছর নাগরপুরে অবস্থান করার কারণে এই ঐতিহাসিক জায়গা আমাকে আজও বিষ্মিত করে। মানুষের খাবার পানির পর্যাপ্ত যোগান নিশ্চিত করার জন্য ‘উপেন্দ্র সরোবর’ খনন করেন। সরোবরের চারিদিকে ঘুরলে প্রায় এক কিলোমিটার হয়। পুকুরের পারগুলো অনেক চওড়া করে বাঁধানো। পুকুরে ১২টি ঘাট রয়েছে। সরোবরের ভেতরে ৬টি বড় বড় কূপ খনন করা আছে। যাতে কখনো না শুকায়। সত্যিই তাই হয়েছে। এই সরোবর খনন করার প্রায় দেড়শো বছর অতিক্রম করেছে। এই সময়ের মধ্যে পুকুরের পানি কখনো শুকায়নি। ছোট ছোট আরও দুইটি পুকুর রয়েছে একটি বাইরের মানুষের ব্যবহারের জন্য খনন করা হয়েছিলো আরেকটি বাড়ির নারীর জন্য খনন করা হয়েছিল। নারীদের জন্য খনন করা পুকুরের ঘাট ইটের দেয়াল দিয়ে ঘেরা। 

জমিদার বাড়ির ভবন মহিলা কলেজ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে

স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল সবই আছে এই ছোট্ট নাগরপুরে। উপেন্দ্র সরোবরের পাশে ‘যদুনাথ পাইলট হাই স্কুল’। আমি ওই স্কুলেরই শিক্ষার্থী। আমার বাবা ছিলেন ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। স্কুল সংলগ্ন বিশাল মাঠে অনেক খেলেছি। মাঠে ঘাসে ও ধূলায় মিশে রয়েছে কত শত দিনের স্মৃতি। এই মাঠের পাশেই ‘পুন্ডরীকাক্ষ দাতব্য চিকিৎসালয়’। জানা যায়, পুন্ডরীকাক্ষ ছিলেন রায় বাহাদুর সতীশ চন্দ্র চৌধুরীর একমাত্র সন্তান। তিনি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। পিতা সতীশ চন্দ্র তার চিকিৎসায় অনেক অর্থ ব্যয় করেন। কিন্তু পুন্ডরীকাক্ষকে বাঁচাতে পারেননি। একমাত্র সন্তানের মৃত্যুতে সতীশ চন্দ্র চৌধুরীর মনে বৈরাগ্য সৃষ্টি হয়। সন্তানের অকাল মৃত্যুতে তিনি জনদরদী হয়ে ওঠেন। স্থানীয়দের চিকিৎসার জন্য ১৯১৬ খ্রীষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন পুন্ডরীকাক্ষ দাতব্য চিকিৎসালয়। এই হাসপাতালে তিনি বিদেশি ট্রেনিং প্রাপ্ত চিকিৎসক নিয়োগ দেন। আজও চিকিৎসা নিতে আসে অনেক মানুষ। 

‘পুন্ডরীকাক্ষ দাতব্য চিকিৎসালয়’। ছবি: লেখক

শুনেছি এই বাড়ির নহবত খানা থেকে প্রতি ভোরে বেজে উঠতো সানাই-এর ভৈরবী ধ্বনি। সেই ধ্বনি পড়ার পরপরই পুরো এলাকার মানুষ জেগে উঠতো। দেশভাগের পর জমিদারি প্রথা বিলোপের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেছে সেই ধ্বনি কিন্তু স্থাপনা আর সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো আজও মানুষের উপকারে আসে। পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়ে এই বাড়ির নিবিড় সৌন্দর্য। 

দুঃখের বিষয় এই বাড়ির গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো সংরক্ষণে সরকারের কোনো পদক্ষেপ নেই। নাগরপুর জমিদার বাড়িটি পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণে করার সময় এসেছে। সংশ্লিষ্টরা এই বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ নেবেন বলেই বিশ্বাস করি।