সাতসতেরো

‘লেখকের কাজ হচ্ছে পাঠককে পাঠের অবারিত উৎসের সঙ্গে যোগ করে দেওয়া’

অলাত এহ্‌সান মূলত গল্পকার। সাহিত্য সমালোচনা ও প্রবন্ধও লেখেন তিনি। অবসরে চর্চা করেন জাপানি ভাষা। ২০২৫ বইমেলায়  ‘জ্ঞানকোষ’ থেকে প্রকাশ হবে অলাত এহ্‌সানের ‘বৃদ্ধাশ্রম হয়ে ওঠা কফি হাউসটি’ গল্পগ্রন্থ। তার প্রথম গল্পগন্থ ‘অনভ্যাসের দিনে’ পাঠকনন্দিত হয়েছে। তরুণ প্রজন্মের এই গল্পকারের কাছে রাইজিংবিডি জানতে চেয়েছিলো বই প্রচারণায় একজন তরুণ লেখক কীভাবে কাজ করতে পারেন? 

অলাত বলেন, ‘‘বিশ্বের বহু প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আছে, যেখান থেকে (পরিচিত-অপরিচিত) যেকারও বই বের হলে আপনি চোখ বুঝে কিনতে পারেন, লেখার মান নিয়ে ঠকবেন না। এটা ওইসব প্রকাশনীর সম্পাদনা পরিষদ নিশ্চিত করে। আমাদের মনে হয় অমন ব্রান্ড হয়ে ওঠা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান তেমন নেই। আবার লেখকও তার লেখার মানে তেমন ব্যাপারে যত্নশীল নন, সেই যে এক লেখক বলেছিলেন না— অনেক লেখক আছেন যাদের অনেক পড়ার দরকার ছিল, কিন্তু তারা লেখেন। বিপদ হলো, বহু প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আছে যারা বই প্রকাশের ব্যয় লেখকের ওপর চাপিয়ে দেয়, এখন বই বিপননের দায়িত্বও তাদের ওপরই দিচ্ছে। মানে নিজের খরচে প্রকাশনা অনুষ্ঠান করা, বই রিভিউ করানো ও সুহৃদ সাহিত্য সম্পাদককে বলে ছাপার ব্যবস্থা করা, পরিচিত স্টলে বলে বই রাখা, এমনি টাকা আদায় পর্যন্ত। একজন সম্ভাবনাময় লেখক যেমন উদ্যোমী হয়ে লিটনম্যাগ করতে গিয়ে নানা বিরূপ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে তার শেষপর্যন্ত লেখক সত্তাটাই মারা যায়, তেমনি বই বিপণন করতে গিয়ে আমাদের লেখকদেরও মৃত্যু হতে পারে।’’

তিনি আরও বলেন, ‘‘ দেখুন, নাই নাই করে তো দেশে বই প্রকাশ কম হচ্ছে না, সারা বছর ও বইমেলা মিলিয়ে। দেশে পেশাদার সম্পাদনা প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়েছে কয়েকটি, তাহলে বই মার্কেটিংয়েও পেশাদার প্রতিষ্ঠান দাঁড়ানো তো খুবই সম্ভব, সময়ের দাবি। তাহলে ব্যক্তিভিত্তিক মার্কেটিংয়ের দরকার পড়ে না। বইয়ের মার্কেটিং তো পাঠক জরিপের (মার্কেট অ্যানালাইস) ওপর নির্ভর করে। পাঠকের পাঠরুচি, সংখ্যার ওপর নির্ভর করবে কোন বই কতটা ও কীভাবে প্রচার দরকার হবে। তাছাড়া এখন তো প্রচার মাধ্যমও বহু, লিখিত থেকে ভিয্যুয়াল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তো আছেই। সেখানে, প্রশ্ন হলো লেখক কি আদৌও বই মার্কেটিং করতে পারেন?— এটা তো সেই পুরোনো বিদ্যা— বর্ষায় পানির প্রাচুর্য দেখে খুশি হয়ে কেউ যদি খালের মুখ বন্ধ করে পানি আটকে রাখতে চায়, তাহলে বর্ষা শেষেই শুকিয়ে মরবে। সেচ চলবে না। বড় নদীর সঙ্গে সংযোগ রক্ষা না করে তা সম্ভবও না। অনেক লেখক মানে করেন, তার পাঠক গোষ্ঠী তৈরি করবেন, আর তাকে ধরে রাখবেন। কিন্তু তাতে শেষে পাঠকেরই মৃত্যু হতে পারে। জরুরি হচ্ছে, পাঠককে পাঠের অবারিত উৎসের সঙ্গে যোগ করে দেওয়া। আপনার বই পড়ে যদি পাঠক আরেকটা বই পড়ার উৎসাহ পায়, নতুন লেখকের বইয়ের সন্ধানে উৎসাহিত হয়, তাহলেই মঙ্গল। তাহলেই সাহিত্যের সেচ কাজ চলতে পারে। এই শুভ বোধ সব লেখকের থাকা জরুরি।’’

বাংলাদেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় লেখক ধরে বই কেনার প্রবণতা। সেক্ষেত্রে একজন লেখক পাঠকের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করবেন কীভাবে?—প্রশ্নের জবাবে অলাত বলেন, ‘‘দেশে যেহেতু নির্ভাবনায় বই কেনার মতো প্রকাশনী কম, তাই পাঠকেরা অনেক সময় লেখক ধরে বই কেনেন। সেই হিসেবে লেখক খানিকটা প্রচারে সহযোগিতা করতে পারে মাত্র। তাই লেখালেখি বা লেখক নিয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ায় জরুরি, কিন্তু তার অবস্থা তো করুন এদেশে, যাও হয় তার অনেকটাই গোষ্ঠী চর্চার আদলে। অনেক সময় পাঠক লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল ঘেটে, সার্চ করে দেখতে চান পছন্দের লেখকের নতুন বই আছে কি না। তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখকের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে তথ্যগুলো থাকা দরকার। লেখক যদি তার ব্যক্তি ও লেখক সত্তাকে আলাদা করতে পারেন, মানে লেখকের নামে একটা পেজ থাকে, তাহলে সেখানে লেখার অংশ নিয়মিত তুলে দিতে পারেন। এমনটা পাওলো কোয়েল, স্টিফেন কিংস, নীল গ্যেইম্যান থেকে শুরু করে সালমান রুশদীরও আছে। কিন্তু এগুলো তো তার বা তাদের এজেন্ট করেন, তাতে তাদের ব্যক্তিগত লেখায় পড়ায় কোনো প্রভাব পড়ে না। আমাদের এখানে লেখকদের পাঠের জায়গায়টা পোক্ত হওয়া খুব জরুরি। সেটারই বড় অভাব। বহু লেখক তার লেখার জন্য পাঠকমানস গড়ে তোলার জন্য বহু বিদেশি সাহিত্য অনুবাদ করেছেন। এখন পাঠ ভিত্তিক সমাজ তৈরিতে লেখকদের থাকা দরকার। তাতে পাঠক সমাজ গড়ে উঠলে বইয়ের বিক্রিও বাড়বে।’’

অলাত এহ্‌সান গল্পের চরিত্র রূপায়নে নিজস্বতা তৈরি করতে পেরেছেন। জীবনের এই বিপুল-বিস্তর ক্যানভাস থেকে তিনি উপস্থাপন করেন পরিস্থিতির সঙ্গে অভ্যস্ত হতে না পারা দ্রোহের চরিত্র। যাদের নিজস্ব দর্শন পাঠককে আলাদা ভূবনে নিয়ে যায়। ৭ বছরের বিরতিতে প্রকাশ হচ্ছে তার দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ।অলাত এহ্‌সান বলেন, ‘‘সময়ের বিচারে প্রথম গল্পগ্রন্থ প্রকাশের ৭ বছরে পর দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ প্রকাশ হচ্ছে। প্রথম গ্রন্থও প্রকাশ হয়েছিল প্রথম গল্প প্রকাশের ৬-৭ বছর পর। আর প্রথম গল্পও প্রকাশ হয়েছিল লেখা শুরু করার অনেক পর। বলছিলাম, একটা প্রকাশ বিরতি লেখালেখির একটা বদল আনে। প্রথম গল্প প্রকাশের স্বীকৃতির পর যেমন দ্বিতীয় লেখাটা নিয়ে ভাবতে হয়েছে, আরো যত্নশীল মনোযোগী হতে হয়েছে। তেমনি প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘অনভ্যাসের দিনে’ প্রকাশের পাঠক, সমালোচকদের সমাদর পাওয়ায়, দেশের বড় লেখকদের মন্তব্য পাওয়া, শেষ পর্যন্ত গত বছর বইটার ‘নতুন সংস্করণ’ প্রকাশের পর দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ প্রকাশেও ভাবতে হয়েছে। লেখালেখি তো একটা যাত্রাপথ, সময়ের সঙ্গে, পাঠের মধ্যদিয়ে আপনাকে বদল-সমৃদ্ধ হতেই হয়। আমি যেহেতু এখনো উপন্যাস লিখছি না, আসলে সমীহের জায়গা থেকে বললে— প্রস্তুতিই শেষ হয়নি মনে করি, তাই দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থটি প্রথমটির বলয় থেকে সচেতনভাবেই বের করতে চেয়েছি আঙ্গিক, বিষয়, কাহিনীর দিক দিয়ে। দেখুন প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘অনভ্যাসের দিনে’ নামটা মাথায় ফিকশন তৈরি করে, অনেক প্রশ্ন, কৌতুহল তৈরি করে। সেখানে চরিত্রগুলো সত্যি পরিস্থিতির সঙ্গে অভ্যস্ত হতে পারছিল না, অস্বস্তি, দ্রোহ ছিল। জার্নিটা সেখান থেকে শুরু ধরে এগুনো যেতে পারে। আমি তো গল্পে সময়কে ধারণ করি। মানে এবারের গল্পগুলো দ্রোহের পরে মানুষ কী করতে পারে তা নিয়ে খানিকটা এগিয়েছ। এর কিছু চরিত্র একটা আবহ, অবগুণ্ঠনও তৈরি করেছে। যেমন—মিজান (মিজানের ইঁদুর-বেড়াল), সুমিত (অভাবনীয় সুমিত ও তার কবিতার চিহ্ন আবিস্কার), ইদ্রিস (একটি প্রতিশ্রুত ঝড়ের পূর্বাভাস), ছেলেটি (নাজিমুদ্দিন রোডের অপেক্ষমান ছেলেটি)— এরকম কিছু। তারা কেউ কেউ দার্শনিকতায় উন্বিত হতে চায়। কিছু চরিত্র আগের গল্পগুলোর মতো দ্রোহী, অনভ্যস্ত এখনো। সময়ের সঙ্গে চরিত্রের মিথস্ক্রিয়াটা অন্য।’’

কী আছে ‘বৃদ্ধাশ্রম হয়ে ওঠা কফিহাউটি’ গল্পে? লেখক বলেন, ‘‘ গল্পটার ছোট্ট প্রিভিউ দেয়া যেতে পারে নাম গল্প হিসেবে, সেটা জরুরিও। গল্পে দেখা যায়, শহরের প্রায় পরিত্যাক্ত এলাকায় একটা কফি হাউসে টিভিতে ক্রিকেট দেখে জুয়া খেলছে বৃদ্ধরা। সেখানে ‘ব্রেফফাস্ট অ্যাট টিফানি’ সাইবোর্ডের নিচে পেছন ফেরানো একটা নারীকে দেখে গল্পকথক যুবক। তার সঙ্গে খাবার খেতে গিয়ে কফি হাউসের নানা শর্তে জড়িয়ে যায় সে। পরে আবিস্কার করে, ওই নারী আসলে কফি হাউসের একটা ফাঁদ। এই ফাঁদে পড়ে ওই বৃদ্ধরা বহু দেখায় প্রায় মুখস্ত ক্রিকেট খেলার ভিডিও দেখতে দেখতে জুয়া খেলছে! ওই নারীকে উদ্ধার করতে গিয়ে হফি হাউসের লোকজনের মারধরের শিকার হয় যুবক। বাঙালির আলস্য, লোভ, অহেতুক সময় নষ্ট, জুয়া, ফাঁদ নিয়ে গল্প।’’

অলাত বিশ্বাস করেন চিন্তাহীন কোনো গল্পই টিকে থাকে না শেষ পর্যন্ত। গল্পে যেমন একটা কাহিনী থাকলে সহজ হয় পাঠককে একটা যাত্রায় (জার্নি) যুক্ত করতে, আবার শেষে একটা চিন্তায় উন্নিত হতে হয় লেখকের জায়গা থেকে। এখন পাঠক শুধু কাহিনী পড়ে তৃপ্ত হতে পারেন, সেই সৌন্দর্য গল্পে আছে, আবার মনোযোগী পাঠকের জন্য চিন্তার খোরাক আছে, যা নিয়ে লেখক-পাঠকের মিথস্ক্রিয়া হতে পারে। সমাজ, সময়কে বুঝতে, ব্যাখ্যা করতে সহায়ক হতে পারে গল্প।

অলাতের ভাষ্য, ‘‘আমাদের দেশে গল্পগুলো সংকটও এখানে। সৌন্দর্য তৈরি করে বটে, কিন্তু ভাবনায়-দর্শনে উন্নিত হয় না। আমি জেনেছিলাম, হারুকি মুরাকামি গল্পের ভেতর দিয়ে মূলত বৌদ্ধ দর্শনকে চালান করে দেন। সংকটে দিশা দেন। তার মতো দেশের ইতিহাস সচেতন কম লেখকই আছেন। আমরা সবটা না বুঝলেও বড় লেখকদের প্রায় সবাই এটা করেছেন। আমার মনে হয় এটা লেখকেরই কাজ— দারুন গল্পের ভেতর দিয়ে আপনাকে ভাবনায় তাড়িত করবেন।’’

দীর্ঘ বিরতির পর প্রথম বইয়ের গল্পের চরিত্রদের সঙ্গে এই বইয়ের গল্পে চরিত্রদের পরম্পরা তৈরি করা বিষয়ে অলাত এহ্‌সান জানান, ‘অনভ্যাসের দিনে’ গল্পগ্রন্থে চরিত্রগুলো সত্যি পরিস্থিতির সঙ্গে অভ্যস্ত হতে পারছিল না, অস্বস্তি, দ্রোহ ছিল। সেই দ্রোহী, সংবেদনশীল, নাজুক মানুষগুলো তার পরে কী করবেন এবারের গল্পগুলো তাকে দেখতে চেয়েছে। কিছু চরিত্র একটা আবহ, অবগুণ্ঠন, নিজস্ব জগৎ তৈরি করছে। একার্থে, উপন্যাসের প্রথম খণ্ড থেকে দ্বিতীয় খণ্ডে যাওয়ার স্বাদ পেতে পারেন কিছু গল্পে। একটি বিষয় মনে হয় দুটি গল্প বইয়ের ক্ষেত্রেই সত্য।

অলাত বলেন, ‘‘আমরা বইটি কোনো একক ঘরানার পাঠকের জন্য না, বরং অনেক ঘরানার পাঠকই তার খোরাক পেতে পারেন এখানে। কেউ প্রেমের গল্প পড়তে চাইলেও পাচ্ছেন, আবার রাজনীতি সচেতন চিন্তাশীল পাঠকের জন্যও কয়েকটি গল্প আছে। আবার ফ্যান্টাসি, থ্রিলার, ডিটেকটিভ, ডিসটোপিয়ান, রিয়ালিস্টিক ধারার সাহিত্যের পাঠকও তার গল্প পাচ্ছেন। আসলে ঘরানায় আটকে থাকলে সাহিত্য সর্বগামী হবে না, পাঠকও বহুগামী হতে পারবেন না। থ্রিলার, ফ্যান্টাসি একটা জনপ্রিয় ধারা এখন, সেখানে পাঠক সংখ্যাও বহু, এটা পাঠকের সঙ্গে দ্রুত সম্পর্ক তৈরি করে, লেখককে এর থেকে বাইরে থাকলে হয় না। সেখানে সিরিয়াস ধারার লেখক ঢুকে পাঠকের নতুন দিগন্ত তৈরি করতে পারেন, নতুন পথ তৈরি করে দিতে পারেন। যুগে যুগে এমনটাই হয়েছে। এক ধারার লেখক অন্যধারার লেখাকে প্রভাবিত করেন, নতুন সৌন্দর্য তৈরি করেন। আবার সবাই একটা ধারাকেও সর্বোচ্চ শৈলিতে উন্নিত করতে পারেন, নিজের দক্ষতার চূড়ান্ত প্রদর্শন করতে পারেন। আসলে প্রথমেই লেখাটা ভালো হতে হবে, সুখপাঠ্য হবে; তারপর আপনি এর ভেতর কত মুন্সিয়ানা দেখতে পারেন, চিন্তায় কতটা সমৃদ্ধ করতে পারেন সেটা আপনার দক্ষতা। পাঠকের মনোঞ্জন করতে গিয়ে যেমন হ্যাংলামো করতে পারেন না, আবার পাঠককে মেরে ফেলে আপনি সাহিত্যে দক্ষতা দেখাতেও পারেন না। আর কে না জানে, পাঠ চর্চা একটা প্রস্তুতির ব্যাপারও আছে, পাঠককেও ক্রমাগত প্রস্তুত হতে হয়। নয়তো পৃথিবীর বহু স্বাদ তার অধরাই থেকে যাবে। যেমন একটা আন্তর্জাতিক ভাষা জানা না থাকলে আপনাকে জগতের বহু শ্রেষ্ঠ সাহিত্য পাঠ বঞ্চিত থেকেই মরতে হবে, চিন্তায়-অভিজ্ঞতায় খাটো থাকতে হবে।’’