কিউবার দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত মার্কিন নৌঘাঁটির অধীনের পরিচালিত কুখ্যাত গুয়ানতানামো বে বন্দিশালা সম্প্রসারণে নির্দেশ দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। নতুন বন্দিশালায় রাখা হবে অবৈধ অভিবাসীদের, বিশেষ করে নৌকা নিয়ে সাগর পথে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের সময় ধরা পড়া অভিবাসীদের গুয়ানতানামোয় পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
বুধবার ট্রাম্প জানান, গুয়ানতানামো বে বন্দিশালায় হাজার ত্রিশেক অবৈধ অভিবাসীকে বন্দি রাখার মতো উপযুক্ত পরিকাঠামো নির্মাণের জন্য অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা দপ্তরকে (ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি) নির্দেশ দেবেন তিনি। এ ক্ষেত্রে সবার আগে ‘আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তার’ যুক্তি দিয়েছেন তিনি।
এই সেই কুখ্যাত গুয়ানতানামো বে বন্দিশালা, মার্কিন বাহিনীর হাতে অপহরণ, গুম ও আটকের পর যেখানে বহু মানুষকে বিনা বিচারে বছরের পর বছর বন্দি রাখা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের নামে বর্বর রিমান্ড কৌশল ব্যবহার করা হয়; বন্দিদের ওপর ওয়াটার বোর্ডিং চালানো হয়। পুরো মুখোমণ্ডল কাপড় দিয়ে বেধে তার ওপর গরম পানি ঢেলে জিজ্ঞাসাবাদের পদ্ধতি হলো ওয়াটার বোর্ডিং।
টুইন টাওয়ারে হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আটক বহু মানুষকে বিনা বিচারে গুয়ানতানামো বে বন্দিশালায় আটকে রাখা হয়। নির্যাতনের মধ্যেই অনেকে মারা যান। কুখ্যাত বন্দিশালাটি চিরতরে বন্ধের জন্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর চাপ থাকলেও ট্রাম্প আবার সেই গুয়ানতানামোয় নতুন বন্দিশালা নির্মাণ করতে যাচ্ছেন।
বুধবার (২৯ জানুয়ারি) ‘লেকেন রাইলি অ্যাক্ট’কে আইনে রূপান্তরের জন্য স্বাক্ষর করার সময় ট্রাম্প গুয়ানতানামোয় নতুন বন্দিশালা নির্মাণের ঘোষণা দেন। ওই আইনে চুরি বা সহিংস অপরাধের জন্য গ্রেপ্তার অবৈধ অভিবাসীদের বিচারের জন্য কারাগারে রাখা বিধান রাখা হয়েছে।
ট্রাম্প বলেন, কিউবায় যুক্তরাষ্ট্রের নৌঘাঁটিতে যে হাই-সিকিউরিটি সামরিক কারাগার রয়েছে, নতুন বন্দিশালাটি সেটি থেকে পৃথক হবে। এই বন্দিশালায় স্থান হবে সেই সব ‘জঘন্যতম’ অবৈধ অভিবাসীদের, যারা আমেরিকার জনগণের জন্য হুমকির কারণ।
হোয়াইট হাউজের ইস্ট রুমে স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে ট্রাম্প বলেন, নতুন নির্বাহী আদেশে প্রতিরক্ষা ও হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগকে গুয়ানতানামোয় ৩০ হাজার ধারণ ক্ষমতার এই স্থাপনা নির্মাণে ‘প্রস্তুতি শুরু করতে’ নির্দেশ দেওয়া হবে।
ট্রাম্পের দাবি, “তাদের (অভিবাসীদের) মধ্যে কিছু এতটাই খারাপ যে, তাদের ধরে রাখার জন্য আমরা সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকেও বিশ্বাস করি না, কারণ আমরা চাই না তারা ফিরে আসুক। তাই আমরা তাদের গুয়ানতানামোতে পাঠাতে যাচ্ছি। সেখান থেকে বের হওয়া খুব কঠিন ব্যাপার।”
ট্রাম্পের নির্দেশনা অনুযায়ী, অবৈধ অভিবাসীদের জন্য গুয়ানাতানামোর ধারণক্ষমতা দ্বিগুণ করা হবে।
ট্রাম্পের ‘বর্ডার সিজার’ টম হোম্যান বুধবার বলেছেন, সেখানে বর্তমানে যে স্থাপনা সুবিধা রয়েছে তা বর্ধিত করা হবে। আর তা পরিচালনা করবে ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইসিই)।
তিনি বলেন, সাগরে মার্কিন কোস্ট গার্ডের হাতে অভিবাসী ধরা পড়ার পর তাদের সরাসরি সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে এবং ওই বন্দিশালায় ‘সর্বোচ্চ’ মান নিশ্চিত করা হবে।
এদিকে, কিউবা সরকার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের স্থাপনা সম্প্রসারণের পরিকল্পনার নিন্দা জানিয়েছে। তাদের মতে, দীর্ঘদিন ধরে গুয়ানাতানামো বেকে ‘দখল’ করে রাখা হয়েছে। ১৯৫৯ সালে ফিদেল কাস্ত্রো ক্ষমতায় আসার পর থেকে দ্বীপটিতে মার্কিন নৌঘাঁটির অস্তিত্ব নিয়ে নিন্দা প্রকাশ করে আসছে কিউবা।
কিউবার প্রেসিডেন্ট মিগুয়েল দিয়াজ-কানেল বারমুদেজ এক্স পোস্টে বলেছেন, “নৃশংসতার অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সরকার ঘোষণা দিয়েছে- তারা অবৈধভাবে দখল করা কিউবার ভূখণ্ডে অবস্থিত গুয়ানতানামো নৌঘাঁটির যে কারাগার নির্যাতন ও অবৈধ আটকের জন্য পরিচিত, তার কাছে জোর করে বিতাড়িত হাজার হাজার অভিবাসীকে রাখবে।”
কিউবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রুনো রদ্রিগেজ বলেছেন, এই ঘোষণা ‘মানবিক পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি অবজ্ঞার’ বহিঃপ্রকাশ।
বিবিসি জানিয়েছে, ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১ হামলার ঘটনায় গুয়েনতানামো বে কারাগার তৈরি করা হয়েছিল। মূলত সন্ত্রাসীদের জন্য তৈরি এই কারাগারে বহু মানুষকে বিনা বিচারে আটক করে রাখা হয়েছিল বলে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অভিযোগ। তখন থেকেই এই কারাগারি নিয়ে নানা বিতর্ক। কারাগারের ভিতর নিপীড়নের বহু কাহিনি আছে।
বারাক ওবামা জানিয়েছিলেন, ধীরে ধীরে এই কারাগার বন্ধ করে দেওয়া হবে। ক্ষমতা ছাড়ার আগে জো বাইডেন বেশ কিছু ব্যক্তিকে এই কারাগার থেকে মুক্তি দিয়েছেন, এক যুগ কেটে গেলেও যাদের কোনো বিচার হয়নি। সেই কারাগারেই অবৈধ অভিবাসীদের রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন ট্রাম্প।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণার সময়, ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে বড় পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ২০ জানুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের পর, যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি রাজ্যে অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করা হয়েছে।
ফক্স নিউজ বিভিন্ন আইসিই ফিল্ড অফিসের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, কেবল রবিবারেই ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইসিই) প্রায় এক হাজার জনকে গ্রেপ্তার করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান চলছে।